বেচাকেনা: ‘হাঁড়িয়া নয়, রাইস বিয়ার’! পুরুলিয়ার বলরামপুর ব্লকে ঘাটবেড়ায়। —নিজস্ব চিত্র।
সূর্য তখন মাঝ আকাশে। গনগনে রোদের তাপ। পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড় ঘেরা পাঁচটি ব্লকেই অবশ্য ভোটের তাপে এ বার শুকিয়ে গিয়েছে ঘাসফুল। জনজাতি অধ্যুষিত বলরামপুরের ঘাটবেড়া-কেরোয়া তেমনই এক গ্রাম পঞ্চায়েত।
পুরুলিয়া থেকে বেরিয়ে আরশা, মুদালি, রাজপতি হয়ে পৌঁছানো গেল ঘাটবেড়াতে। গ্রামে ঢোকার মুখেই গাছগাছালির ফাঁকে হাঁড়িয়া বিক্রয় কেন্দ্র। একেবারে ঘরোয়া পদ্ধতিতে তৈরি হাঁড়িয়ার পসরা নিয়ে বসে দুই জনজাতি মহিলা। মাঝদুপুরে মজদুরির ফাঁকে উপাদেয় পানীয়-সহ জিরিয়ে নেওয়ার জন্য জড়ো হয়েছেন অনেকে। গুটিকয় যুবককেও দেখা গেল।
জনজাতির মানুষের মন বুঝতে হাঁড়িয়ার আসরের চেয়ে উত্তম স্থান আর কী-ই হতে পারে? ছোড়া হল প্রশ্ন, কী খাওয়া হচ্ছে? ‘‘দাদা, রাইস বিয়ার। খাবেন নাকি?’’, চটজলদি জবাব দিলেন পেটানো চেহারার জনজাতি যুবক কাশীনাথ সিং। ‘রাইস বিয়ার’! এ তো দেখছি হাঁড়িয়া। ফের সপাটে উত্তর কাশীনাথের, ‘‘ও সব বাপ-জ্যাঠারা বলতেন। আমরা এখন রাইস বিয়ার বলি।’’ মন বদলের খোঁজ নিতে এসে পাওয়া গেল জনজাতি সমাজ বদলেরই নজির। হাঁড়িয়া এখন ‘রাইস বিয়ার’। কাশীনাথকে বেশ সপ্রতিভ মনে হচ্ছিল। জানতে চাইলাম, মমতা দিদি এত কিছু দেওয়ার পরও কেন এমন বদলে গেল ঘাটবেড়ার মতো তৃণমূল ঘাঁটি? কাশীনাথের নিমেষে জবাব, ‘‘দিদি ভাল, কিন্তু দাদারা খারাপ। চার দিকে শুধু চুরি আর চুরি। খেয়ে খেয়ে পেট মোটা হয়ে গিয়েছে নেতাদের।’’
না, কাশীনাথকে আর বলতে দিতে রাজি নন প্রৌঢ় লুড়কু সিং। দুই জামবাটি হাঁড়িয়া খাওয়ার পর টলমল অবস্থা তাঁর। রাজনীতির কথা উঠতেই টানটান লুড়কুবাবু। শোনালেন তাঁর অভি়জ্ঞতা। জানালেন, তাঁর স্ত্রী স্বনির্ভর দলের সদস্যা। সেই দলকে মোরাম ফেলে এলাকা সমতল করার কাজ দিয়েছিল পঞ্চায়েত। প্রথমে কাজ না করে টাকা তোলা, পরে যে ক’দিন কাজ হয়েছে তার চেয়ে বেশি দিন কাজের হিসাব পেশ করতে বাধ্য করেছেন পঞ্চায়েত সদস্য। শেষ পর্যন্ত ঘুষের টাকা দিতে বাড়ির ধান বিক্রি করে দিতে হয়েছে তাঁকে।
আরও পড়ুন: জিটিএ ভোট এখনই নয়, বার্তা মমতার
লুড়কুর আক্ষেপ, ‘‘শুধু খেতে চায়। যত খাওয়াবেন তত চাহিদা। দুঃখ পেলাম। তাই বদলে দিয়েছি।’’ সেই বদলের ছবি দেখা গিয়েছিল ঝাড়গ্রামের দিগলপাহাড়ি জঙ্গলেও। এড়গোদা পঞ্চায়েতের ভালকাচুয়ার বাসিন্দা ভবেশ দেশওয়ালি, সতীশ মাহাতো, সোনারাম মাহাতো, অজিত মাহাতোরা জঙ্গলে ছাগল চরাতে যাচ্ছিলেন। ভালকাচুয়াও বদলেছে জেনে মন বুঝতে পথ আটকানো তাঁদের। ভবেশ বললেন, ‘‘আবাস যোজনার ঘর পেলেই ১০ হাজার টাকা দাবি। না দিলে টাকা বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি। আমি তো ঘরই পেলাম না।’’ সতীশবাবুর ক্ষোভ, ‘‘বিপিএলে নাম থাকার পরেও কিছু পেলাম না। নেতার পিছুধরা লোকগুলো সব পেল।’’
অজিতের আরও ক্রদ্ধ। জানালেন, মায়ের মৃত্যুর পর শ্রাদ্ধ-শান্তির জন্য ২৫ কেজি চাল চাইতে গিয়েছিলেন পঞ্চায়েত সদস্যের কাছে। ফিরিয়ে দিয়েছিলেন কর্তা। ভোটে শোধ তুলেছেন তিনি। সোনারাম বললেন, ‘‘কারও নামে বাড়ি বা ভাতার টাকা ব্যাঙ্কে ঢুকলেই নেতারা হাজির। ব্যাঙ্কের সামনে পাহারা দিচ্ছেন। টাকা না দিলে ছাড় নেই। পায়খানা তৈরি, বুড়া-ভাতার টাকারও ভাগ চাইছেন নেতারা। হকের টাকা দিব কেন?’’
বুঝতে অসুবিধা হয় না, মুখ্যমন্ত্রী সুবিধা বিলি করে যে উপভোক্তা শ্রেণি তৈরি করেছেন, তাঁরাই এখন হক বুঝে নিতে চাইছেন। ডোল-রাজনীতি কি তা হলে ব্যুমেরাং হতে চলেছে? উত্তর রয়েছে রানিবাঁধের চালকিগোড়ার বুলু সর্দারের কথাতেই। বুলু বলেন, ‘‘কই, আমি পায়খানা ছাড়া কিছুই পেলাম না। অনেকে তো আরও কিছু পেয়েছে। পয়সা খাওয়ালে সব দিত।’’
জঙ্গলমহলের সর্বত্র শাসক দলের পঞ্চায়েত সদস্যদের নিয়ে এই ‘খাওয়া-খাওয়া’ হাওয়া। ওদোলচুয়া স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সামনে কথা হচ্ছিল অশ্বিনী মাহাতোর সঙ্গে। স্থানীয় স্কুলে অশিক্ষক কর্মী তিনি। জানালেন, জঙ্গলমহলে না কি রাস্তাও খেয়ে নিয়েছে পঞ্চায়েত কর্তাদের কেউ কেউ। যেমন, প্রধানমন্ত্রী সড়ক যোজনার বোর্ডে লেখা ঢাঙিচুয়া থেকে ঢাঙিকুসুম রাস্তা পাকা হয়েছে। বাস্তবে হয়েছে চিড়াকুঠি থেকে ঢাঙিকুসুম। শুরুর তিন কিমি রাস্তা হয়ইনি। পর পর উদাহরণ দিচ্ছিলেন অশ্বিনীবাবু। তাঁকে সমর্থন করছিলেন অন্যরা।
বাঁকুড়ার বেলা গ্রাম পঞ্চায়েতে দেওয়াল লিখন চোখে পড়েছিল। ‘চাল দিচ্ছে মোদী, টাকা নিচ্ছে দিদি।’ ‘ঘর দিচ্ছে মোদী, ঘুষ নিচ্ছে দিদি।’ মনে হচ্ছিল, যদি মুখ্যমন্ত্রী জানতেন দলের নিচুতলার নেতা-কর্মীদের একাংশের জন্য তাঁর এত চেষ্টা কী ভাবে মাঠে মারা যাচ্ছে। আমলাশোলের নন্দকিশোর মুড়া যেমন অকপট, ‘‘চোর পুষেছেন মুখ্যমন্ত্রী। চাল থেকে ঘর, সব লুঠপাট হয়ে যাচ্ছে।’’
তা হলে কি ভাল নেই জঙ্গলমহল? আমলাশোলে দু’টাকা কেজি চাল বিলোন যিনি, সেই রেশন ডিলার সুনীলকুমার মানকীর বাড়ির সামনে নতুন এসইউভি। গোটা তিনেক বাইক। তাঁর ছেলে দক্ষিণ কলকাতার ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ছে। সুনীলবাবু ভালই আছেন। যদিও তিনি জানান, গাড়ি এসেছে শ্বশুরবাড়ি থেকে।
ইস্, যদি নন্দ মুড়া বা ভবেশ দেশওয়ালিরও এমন ‘শ্বশুরবাড়ি’ থাকত!
(চলবে)