ঋজু: ‘আনন্দ’ পুরস্কার সন্ধ্যায় বক্তা সন্তোষ রাণা। মঞ্চে রয়েছেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় এবং প্রাবন্ধিক সুধীর চক্রবর্তী। ফাইল চিত্র
প্রশ্ন: আপনার ‘রাজনীতির এক জীবন বই’য়ের অনেকখানি জায়গা জুড়ে আছে নিজের শিক্ষাজীবন ও শিক্ষকতার সময়ের কথা। আপনার রাজনৈতিক সচেতনতা এবং দৃষ্টিভঙ্গির অনেকখানিই আপনার শিক্ষাপর্বেই নির্মিত মনে হয়েছে। রাজনৈতিক ব্যস্ততা সত্ত্বেও আপনি শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন। আজকের শিক্ষা ব্যবস্থাকে আপনি কী ভাবে দেখছেন? বর্তমান ছাত্র-যুব সমাজকে কি আপনাদের তুলনায় বেশি আত্মকেন্দ্রিক এবং অ-রাজনৈতিক বলে মনে হয় আপনার?
উত্তর: এটা একটা সময়ের ব্যাপার। এমন নয় যে কেবল ষাট-সত্তরের দশকে কিছু ছেলে মেয়ে কেরিয়ার ছেড়ে রাজনীতি করতে নামল। তার আগে, চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকেও ঘটেছে। আমার ধারণা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপুল জয়, ফ্যাসিবাদের পরাজয়, চিন বিপ্লব, সব মিলে একটা আবহ তৈরি করে, যেটা প্রধানত জাতীয়তাবাদী, কিন্তু তার মধ্যে বামপন্থারও যোগ ঘটে। দেশ স্বাধীন করতে হবে, কিন্তু তারপর কী? শ্রমিকদের, কৃষকদের কী হবে? তেভাগা, তেলেঙ্গনা হয়েছিল। এটা বিভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসা ছাত্র যুবকদের মধ্যে দেশেরও সমাজের জন্য কিছু করার আকাঙ্খা সঞ্চার করেছিল। ১৯৬৭ তে রিসার্চের কাজ ছেড়ে যখন গোপীবল্লভপুর ফিরে যাই, তখন যাঁরা যাননি তাঁরাও একটা নৈতিক সমর্থন দিয়েছিলেন। কেউই মনে করেননি যে এটা ফালতু কাজ। আমার রিসার্চ গাইড, যিনি নিজে বিজ্ঞানী, তিনিও বলেছিলেন, ‘যে কাজটা করতে যাচ্ছো সেটা খুব ভাল কাজ। যদি করতে পারো তাহলে করো।’ পরিমণ্ডলটা ছিল এই রকম। আজকে নানা কারণে সমাজতন্ত্রে অনেক ধরনের সমস্যা দেখা দিয়েছে। নতুন দুনিয়া সম্পর্কে মানুষের চিন্তাভাবনা অনেক ধাক্কাও খেয়েছে, ফলে একটা বিভ্রান্তিকর অবস্থা। কিন্তু আমার মনে হয় না আমাদের দেশের ছাত্র যুবদের মধ্যে এই ধারাটা একেবারে শুকিয়ে গিয়েছে। জেএনইউ, হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়, রোহিত ভেমুলা, দলিত সমাজের একটা উত্থান, অনেক যুবক-যুবতী এগিয়ে আসছে। এমন কী আইআইটি’র দলিত ছেলেরাও একটা পার্টি বানাবে বলে ঠিক করেছে। দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু ধারাটা আছে। সমস্যাও আছে। যুবসমাজ অন্যরকম হয়ে গিয়েছে বা অতিরিক্ত স্বার্থপর হয়ে গিয়েছে বলে আমার মনে হয় না। তবে সময় ও রাজনীতি বদলেছে। তার সঙ্গে যুবসমাজের সমীকরণ কী হবে বর্তমান রাজনীতিকেই তা ভাবতে হবে।
প্রশ্ন: নকশালপন্থী যাঁরা আত্মজৈবনিক লেখা লিখেছিলেন, তাঁদের অনেকের লেখাতেই পুলিশি তথা রাষ্ট্রের অত্যাচারের অনেক বিবরণ পাই আমরা। সেদিক থেকে আপনার আত্মজীবনীটি ব্যতিক্রমী মনে হয়েছে আমাদের। আপনি কি সচেতন ভাবেই বহু আলোচিত বলে বিষয়টি নিয়ে কিছু লেখেননি, নাকি আপনার অভিজ্ঞতা ভিন্নতর?
উত্তর: লিখিনি, কারণ, নকশাল আন্দোলন মানে দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল নকশাল বনাম পুলিশ। নকশালরা যাকে পারছে মেরে দিচ্ছে, পুলিশ যাকে পারছে মেরে দিচ্ছে, এই চিত্রটা, এরকম মোটা দাগের ব্যাপার তো নয়। ঘটনাটা তো আসলে, সমাজের মধ্যে যে সঙ্কটগুলো হয়েছিল, যে পরিবর্তনগুলোর জন্যে সমাজের মধ্যে আকুতি গড়ে উঠেছিল, যার জন্যে এই আন্দোলন, আমি আমার লেখায় সেইটা আনার চেষ্টা করেছি। এই যে মহাজনি প্রথা, জমিদারি, সামন্ততন্ত্র, জাতিভেদ, জগদ্দল পাথরের মতো ব্যবস্থাগুলো, প্রায় দু’হাজার বছরের পুরনো যার ইতিহাস, সেটাকে নড়ানোর জন্যে মানুষের যে চেষ্টা, এই স্ট্রাকচারাল–কাঠামোগত- দিকগুলোই আমার কাছে অনেক বেশি জরুরি। পুলিশি অত্যাচার হয়নি তা নয়, হয়েছে তো বটেই, সে সব কথার উল্লেখ করেছি কিছু। কিন্তু এই বইটায় আমার বক্তব্য একটা বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা হিসেবে রাখতে চেয়েছি, মারামারির বিবরণ হিসাবে নয়।
প্রশ্ন: সত্তরের দশকের প্রথমার্ধে, জেলে থাকার সময়েই আপনার মনে হয়েছিল অসংসদীয় সংগ্রামের পাশাপাশি সংসদীয় সংগ্রামকেও যুক্ত করতে হবে। একটি লেখায় আপনি ভারতের মাওবাদী দলগুলির একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার কর্মসূচিতে অনড় থাকার সমালোচনা করে লিখেছিলেন, লালগড় আন্দোলন থেকে তাঁদের শিক্ষা নেওয়ার আছে। পরবর্তীকালে যে মাওবাদী প্রভাবিত এলাকায় দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিপত্তি বাড়ছে, তার জন্য কি মাওবাদী দলগুলির এই নীতি দায়ী?
উত্তর: এটাকে একটু অন্যভাবে বলা যায়। জঙ্গলমহলে ১৯৭৮ এর পঞ্চায়েত ভোট আমি দেখেছি। সেটা জনগণের উৎসবের চেহারা নিয়েছিল। প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে, টুকটাক ঝগড়াঝাটিও হচ্ছে, কিন্তু কাউকে প্রার্থী-ই হতে দেওয়া হবে না, এমন ব্যাপার ছিল না। মানুষের যেন একটা মুক্তি ঘটে গিয়েছিল। তখন তো পঞ্চায়েতের হাতে টাকা নেই। একটা গ্রাম পঞ্চায়েতকে পাঁচ হাজার টাকা দিল তো ঢের। কিন্তু পঞ্চায়েত অফিসে লোক ভিড় করে বসে থাকতো, কত টাকা এল? কী কাজ হচ্ছে? মানে এটা ‘আমাদের কিছু’! মানুষের মধ্যে ‘আমরা কিছু একটা অর্জন করেছি’ এই জিনিসটা খুব জোরালো ছিল। পাশাপাশি অপারেশন বর্গা, মজুরির ওই আন্দোলনগুলো যখন চলছে, তখন আরও কতগুলো আন্দোলনও দেখা গেছিল, কিন্তু সেগুলো নিয়ে চর্চা হয়নি। যেমন সাঁকরাইল থানায় রগড়া বলে একটা বড় গ্রাম আছে। সেখানে খুব বড় একটা শিবমন্দির ছিল, আর সেই গ্রামেই একটা খুব বড় বাগদি পাড়া ছিল। বাগদিরাই গ্রামের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক। ওই মন্দিরে বাগদিদের ঢুকতে দেওয়া হত না। বাগদিরা পুজো পার্বণের সময় যেত, বাইরে লাঠি ইত্যাদি খেলত, কিন্তু ভেতরে ঢুকতে পারত না। মজুরির আন্দোলন, জমির আন্দোলনের সময়ে তারা দাবি করল- তারাও মন্দিরে যাবে। অর্থাৎ অবদমিত জাতিগুলির উত্থান, একটা বিদ্রোহের পরিস্থিতিও তৈরি হল। ১৯৭৭-৭৮ সালের এই সব আন্দোলন আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ভেঙে সমাজে গণতান্ত্রিকরণের একটা রাস্তা তৈরি করছিল। তার একটা স্থায়ী ফল পেতে সময় লাগে, কিছু উপাদানও যুক্ত হতে হয়। এমন অনেক গোষ্ঠী ছিল, যারা জনসংখ্যার অর্ধেক বা তার বেশি, কিন্তু তাদের মধ্যে একজনও সাক্ষর ছিল না। কলেজ তো দূরের কথা, তাদের কেউ স্কুলেই যেত না। এক ছটাকও জমি নেই এমন পরিবারও ছিল বহু। দশ কাঠা জমিতে বিশাল কিছু পরিবর্তন হয়ে যায় না, কিন্তু এই পরিমাণ জমি থাকা আর না থাকার মধ্যে একটা পার্থক্য হয়ে যায়। লোকের দর-কষাকষির ক্ষমতা বেড়ে যায়। এগুলোর স্থায়িত্ব পেতে সময় লাগে। ভারতীয় সমাজে জাতি ও শ্রেণির মিশ্রিত যে কাঠামো এটা এত পুরনো এবং শক্তিশালী যে একটা দু’টো ধাক্কায় এটা সরে যাবে, এরকম নয়। এই নতুন অবস্থাটা কিছু দূর যেতে না যেতে, যারা একদিকে উচ্চ বর্ণ বা মধ্য বর্ণ অন্যদিকে জমিরও মালিক ছিল তাদের ঘরের ছেলেপুলেরা নতুন একটা আমলাতান্ত্রিক কাঠামো তৈরি করে ফেলল, ঠিক আগের মতো নয়, নতুন পরিস্থিতিতে তারা এই কাঠামোকে আলাদাভাবে তৈরি করে নিল। রেশন দোকানের ডিলার, ঠিকাদার, অন্য ব্যবসার ভেতর দিয়ে তারা আর্থনীতিক কাঠামোটাকে দখল করল, আর পার্টির নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে সামাজিক কাঠামোটাকে। রাতারাতি হয়নি ঠিকই, কিন্তু আস্তে আস্তে পঞ্চায়েতের ওপর একটা আমলাতান্ত্রিক কাঠামো চেপে বসল। ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটে এটার বিরুদ্ধে মানুষ বিদ্রোহ করে। বামফ্রন্ট তখনও পুরোপুরি হেরে যায়নি, কিন্তু বিদ্রোহটা দেখা যাচ্ছিল, এবং বামফ্রন্ট ২০১১ সালে হেরে গেল। এই পরিবর্তনের সময় কিন্তু আগের পরিবর্তনের মানুষের শোষণমুক্তির উপাদানগুলো আর দেখা গেল না। ক্ষমতা কাঠামোর দিক থেকে, হয় ওই লোকগুলোই, বা ওই ধরনের লোকদের নিয়েই আরেকটা আমলাতান্ত্রিক কাঠামো চাপিয়ে দেওয়া হল। যারা বিদ্রোহ করেছিল তারা নতুন কিছু পেল না। তৃণমূল সরকার কিছু নতুন কর্মসূচি নিয়েছে। আমাদের গ্রাম, পিতানাউতে একটাই ঝরনা থেকে জল খেত সবাই আগেকার দিনে। তারপর কেউ কেউ পাতকুয়ো খুঁড়ল। দু’একটা কুয়ো সরকারি ভাবেও হয়েছিল। ২০১৩ সালে নতুন সরকার এসে জঙ্গলমহলের গ্রামগুলোয় জল দেবার প্রকল্প শুরু করে। আমার গ্রামেই প্রথম প্রকল্পটা হয়েছিল। তাছাড়া দু’টাকা কিলো চালের যে ব্যবস্থা করেছে তাতেও মানুষের উপকার হয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে যেটা ঘটল, সেটা হলো একজন পুলিশকে বসিয়ে দেওয়া হল সবার মাথায়। তার হাতে দেওয়া হল অপরিসীম ক্ষমতা। একে ধরে আনে, ওকে মারে, জোর করে টাকা আদায় করে, আলুর সঙ্কটের সময় কত টাকা কামালো তার কোনও হিসেব নেই। তার ওপরে দেখারও কেউ নেই। সেই পুলিশ, সেই ডিএম, সেই পঞ্চায়েত। এই ক্ষমতা তার হাতে অর্পণ করেছিলেন আমাদের মুখ্যমন্ত্রী। ১৯৭০ সালে যে মানুষেরা প্রতিবাদ করেছে, ২০০৮-০৯ এও যারা প্রতিবাদ করেছে, তারা দেখল যে সরকার বলছে মুখ সেলাই করে রাখো, কোনও কথা বলতে পারবে না, দু’টাকা কিলো চাল নিয়ে চুপ করে থাকো, তখন মানুষ বলল এ চলতে পারে না। ওই গোপীবল্লভপুরের সাতটা পঞ্চায়েতেই হেরেছে ক্ষমতাসীন দল। আজকেই এক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করছিলেন যে, মাহাতোদের আদিবাসী বলে ঘোষিত হওয়ার আশা পূরণ না হওয়ার জন্যই কি ভোটের এই ফলাফল? আমি বললাম খোঁজ নিয়ে দেখো, গোপীবল্লভপুর ১ নম্বর ব্লকে মাহাতো নেইই প্রায়। তাহলে সেখানে তৃণমূলের এত বড় পরাজয় হল কেন? সমস্যাটা বহুমাত্রিক, যার মূলে আছে মানুষের আত্মমর্যাদার প্রশ্ন। ১৯৭৭-এর পরিবর্তন যে আত্মমর্যাদার দরজা খুলে দিয়েছিল, ১৯৯০-এর দশক থেকে সেই দরজা বন্ধ হতে থাকে। ২০১১-তে মানুষের চাহিদা ছিল সেই ১৯৭৭-এর পরিবর্তনের প্রসার। হল ঠিক উল্টো। মাওবাদীরা বন্দুকের জোরে জনগণের অভিভাবক হয়ে উঠল। ফল, অনতিবিলম্বে তৃণমূল তাদের গিলে খেল। এখন তাদের অত্যাচারের সুযোগ নিয়ে বিজেপির পদধ্বনি।
প্রশ্ন: সাম্প্রতিক কালে ভারতের বহু জায়গায় দলিত নিপীড়নের নানা খবর পাওয়া যাছে। আপনার নানা লেখালেখিতে পরিচিতিভিত্তিক দলগুলো রাষ্ট্রের নয়া উদারনৈতিক কর্মসূচির সঙ্গে হাত মেলানোর পর যে শূন্যস্থান তৈরি হয়েছে সেটা বামপন্থী দলগুলোরই পূরণ করার কথা বলেছেন। আপনারা “পশ্চিমবঙ্গের দলিত ও আদিবাসী” বইতে তথ্য সহকারে দেখিয়েছিলেন যে দু’একটি ব্যতিক্রমী দলিত ও আদিবাসী গোষ্ঠী বাদ দিলে, এঁরা জাতিগতভাবে বংশানুক্রমে কায়িক শ্রমিকই রয়ে গেছেন। বামপন্থী দলগুলি পরিচিতিভিত্তিক রাজনৈতিক আন্দোলনের কতটা কাছাকাছি এসেছে মনে করেন?
উত্তর: দলিত ও আদিবাসীরা ভারতের সর্বত্রই মূলত কায়িক শ্রমিকই থেকে গিয়েছেন। বামপন্থী দলগুলো এটা দেখতে শুরু করেছে এখন। সিপিএম আগে কখনও দলিত সংগঠন তৈরিতে উদ্যোগী হয়নি। বছর দুই-তিন হল তারা অল ইন্ডিয়া দলিত সংগঠন, অল ইন্ডিয়া আদিবাসী সংগঠন তৈরি করেছে। পশ্চিমবাংলাতেও করেছে। সেগুলো সবই পার্টিতে যে সব দলিত ও আদিবাসী নেতা ছিলেন তাঁদের সামনে রেখে। সেগুলো এখনও পার্টিরই গণসংগঠন হিসেবে লোকের কাছে পরিচিত। তবে তারা যদি উদ্যোগী হয়, তবে রোহিত ভেমুলার তথাকথিত আত্মহত্যার পর থেকে গড়ে ওঠা আন্দোলন থেকে, উনা দলিত উত্থানের শিক্ষা থেকে নতুন কিছু করতে পারবে। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রেও কিছু ভাল উদ্যোগ হয়েছে, বেশ কিছু ভাল জমায়েত হয়েছে। গত ২ এপ্রিল ভারত বন্ধ হল, যেটা একটা ঐতিহাসিক ব্যাপার। পশ্চিমবাংলায় তার কোনও প্রভাব ছিল না। ছোট ছোট দলিত সংগঠনগুলো কিছু করেছিল। বামপন্থীরা যদি এটাতে নেতৃত্ব দিত, এখনও তাদের যা শক্তি আছে তারা কিছুটা ছাপ ফেলতে পারত। বাম দলিত আন্দোলন দানা বাঁধতে সময় লাগবে। এখানে সেই উদ্যোগ এখনও চোখে পড়েনি।
প্রশ্ন: ভারতের পঞ্চায়েত ব্যবস্থার বর্তমান অবস্থা নিয়ে আপনার কী মনে হয়? ৭৩তম সংবিধান সংশোধনের পর সিকি শতাব্দী কেটে গেল, অথচ কোনও রাজ্যেই এই প্রতিষ্ঠানগুলি এদের ওপর ন্যস্ত সাংবিধানিক দায়িত্ব, অর্থাৎ, একই সঙ্গে আর্থনীতিক উন্নতি আর সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করার কাজটা করে উঠতে পারল না। আপনার কি মনে হয় এই প্রতিষ্ঠানগুলির ওপর সংবিধান তাদের সাধ্যের বেশি দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছে, নাকি রাজনৈতিক ভাবে এই প্রতিষ্ঠানগুলি খুব সক্ষম হয়ে উঠুক এটা কেউ চাইছেন না?
উত্তর: আপনি তো এগুলো জানেন। এত দিন পঞ্চায়েত সামলেছেন। ৭৩তম সংশোধনীতে গ্রাম সংসদের কথা আছে। গ্রাম সংসদে সবার ভোটাধিকার এবং কথা বলার অধিকার আছে। অথচ, ১৯৯৮ সালে অধ্যাপক দ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য গ্রাম সংসদগুলো সমীক্ষা করে দেখিয়েছিলেন, অনেক জায়গাতেই সংসদ বসে না, বা খাতা একটা হয়, কিন্তু লোককে দিয়ে সই করিয়ে আনা হয়। এর ফলে লোকেদের আগ্রহ কমে যায়। লোকে যদি দেখে আমরা যতই যাই, যে কথাই বলি না কেন, ওপরে একজন সর্বশক্তিমান আছেন, তিনি যা ঠিক করবেন সেটাই হবে, তাহলে আমরা ওখানে গিয়ে আর কী করব? বামপন্থী দল যখন কোথাও ক্ষমতা অর্জন করে, সে ভোটের মাধ্যমেই হোক আর যুদ্ধ করেই হোক, আর যে ভাবেই হোক, তাদের একটা দায়িত্ব থাকে একটা মৌলিক পরিবর্তন আনার, যাতে মানুষ প্রকৃতই মনে করে ‘আমার’ কথাটার দাম আছে, এবং সেখানে কোনও পার্টির কোটারি তার মতটা চাপিয়ে দেবে না। তাহলেই মানুষের সক্রিয়তা থাকে। সেটা নষ্ট হয়েছে। নতুন করে এটা তৈরি করতে সময় লাগবে এবং আমার ধারণা এটাও একটা লম্বা প্রক্রিয়া। আমার ছোটবেলায় দেখেছি ধরমপুর গ্রামে পঞ্চায়েত হত। গ্রামের যারা ধনী, অবস্থাপন্ন লোক তারা সেগুলো পরিচালনা করত। জুটত সবাই, ষোলো আনা। সবাই আসতে বাধ্য ছিল। মজুররা, দলিতপাড়ার লোকেরাও আসত, দূরে মাটিতে বসত। কিন্তু তারা কোনও কথা বলতে পারত না। কেবল অবস্থাপন্ন লোকেরাই বলত। এই আধিপত্যের অবস্থানের মধ্যে, যতই তাত্ত্বিক ভাবে অধিকার দেওয়া হোক না কেন, সেটা অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। গত ষাট সত্তর বছরে, ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে করতে মানুষের অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। জরুরি অবস্থার মতো অত বড় ব্যাপারও পাল্টে দেওয়া গেল। সাতাত্তর সালে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের সরকারও পাল্টে দেওয়া গেল। ভারত একটা উৎক্রমণ, একটা ট্রানজিশনের মধ্যে আছে। পঞ্চায়েত প্রতিষ্ঠিত হতে সময় লাগবে। জাতিগত নিপীড়ন, মেয়েদের বন্দিদশা ইত্যাদি নানা আধিপত্যের বেড়া ভেঙে একদিন মানুষ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে, তার অভিজ্ঞতার কথা বলার একটা মূল্য পাবে। এর জন্য একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্যেই যেতে হবে।
প্রশ্ন: পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থার প্রভাব ক্রমশ বেড়ে চলেছে বলে মনে হচ্ছে। এটা নিয়ে কী বলবেন? এটাই কি ভবিষ্যৎ বলে মেনে নেবে এই রাজ্য?
উত্তর: এই প্রক্রিয়ায় একটা পরাজয়ের লক্ষণ ইদানীং দেখা যাচ্ছে। বিশেষত ২০১৪ পরবর্তী পশ্চিমবাংলায়। এটা যে একটা ভয়ানক বিপদ সেটা স্বীকার করাই ভাল, ভাবের ঘরে চুরি করে সে বিপদকে শুধু বাড়িয়েই তোলা হবে। এরকম সময়ে, যারা পশ্চাদগামী হতে চায়, মানুষের মধ্যে ধর্মভিত্তিক বিভেদ সৃষ্টি করতে চায়, তাদের পরাস্ত করার জন্যেই প্রধান পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। এটাকে বাড়তে দেওয়া যাবে না, ইট হ্যাজ টু বি ডিফিটেড। এই প্রতিক্রিয়াশীল ব্যবস্থা, মানুষের মধ্যে ধর্মভিত্তিক বিভেদ তৈরি করার অপচেষ্টা, এর ওপরে মানুষের আস্থা থাকবে না। আমি আশাবাদী, এগুলোকে হারানো যাবে। মানুষ সমতা ও গণতন্ত্রের দিকেই এগোতে থাকবে। বামপন্থীরা এক ঐতিহাসিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। তৃণমূলের অ-গণতন্ত্র এ রাজ্যে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদীদের জায়গা করে দিচ্ছে। এই দুই শক্তির বিরুদ্ধে একটা গণতান্ত্রিক জোট গড়া, নানা পক্ষকে তার সঙ্গে যুক্ত করা এবং লড়াইটা চালিয়ে যাওয়া– এই গুরুদায়িত্ব বামপন্থীদের কাঁধে। সংকীর্ণতা দূর করে, সততা ও নৈতিকতার ওপর প্রতিষ্ঠিত একটা অবস্থান তাঁরা যদি ফিরিয়ে আনতে পারেন, এ লড়াই জিততে না পারার কারণ নেই।
দিলীপ ঘোষ অবসরপ্রাপ্ত আইএএস। বর্তমানে প্রতীচী ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো।