সুপ্রিয় ঠাকুর, সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ও আলপনা রায়
হয়তো এমনই হওয়ার কথা ছিল! হয়তো এ ভাবেই ধ্বংস হওয়ার কথা ছিল ‘আমাদের শান্তিনিকেতনে’র সংস্কৃতির! শুক্রবার বিশ্বভারতীর সমাবর্তন অনুষ্ঠান ঘিরে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তা দেখে এক কথায় এ ভাবেই নিজেদের অভিব্যক্তি জানিয়েছেন প্রাক্তনীদের একাংশ। তাঁদের অনেকেরই বক্তব্য, সমাবর্তন উৎকর্ষ হারাচ্ছে। কেউ আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, শুক্রবার সম্ভবত কফিনে শেষ পেরেকটি পোঁতা হল।
ঐতিহ্য মেনে অতিথিরা সভাস্থলে ঢোকার সময় শঙ্খধ্বনি প্রথা। কিন্তু এ দিন সেই শব্দ হারিয়ে যায় দর্শকদের চিৎকারে। অথচ শঙ্খধ্বনির সময় নীরব থাকাই রেওয়াজ। বিশিষ্টদের কেউ কেউ বলছেন, যে অনুষ্ঠানে ঐতিহ্যপূর্ণ ‘বেদগানে’র সময় সিটি বাজে, সেখানে শঙ্খধ্বনির সময় চিৎকারই স্বাভাবিক!
প্রাক্তনীদের একাংশের অভিযোগ, নরেন্দ্র মোদীর বক্তৃতাই রাজনৈতিক সমাবেশের আবহ তৈরি করেছিল। দর্শকও মজে গিয়েছিল সস্তা রাজনীতিতে। তাই জনসমাবেশের মতোই বক্তৃতার ফাঁকে ফাঁকে ‘মোদী, মোদী’ স্লোগান উঠল। আর সুযোগ বুঝে আচার্যও শুনিয়ে দিলেন সরকারি প্রকল্পের কথা।
বিশ্বভারতীর প্রাক্তনী সুপ্রিয় ঠাকুর বলেছেন, ‘‘বেদগানের সময় সিটি পড়েছে— ভাবতেও পারছি না। দুঃখজনক। আমাদের সময় সমাবর্তন অনুষ্ঠানে জনসংখ্যা অনেক কম হত। ছাতিম পাতা দেওয়া থেকে শুরু করে সবই শ্রদ্ধার সঙ্গে পালিত হত। সেই পরিসরটাই এখন অনুপস্থিত।’’
অভিযোগ, শ্রদ্ধা তো দূরের কথা, স্বাভাবিক সম্মানের পরিবেশটুকুও অনুপস্থিত ছিল এ দিন। স্বামী আত্মপ্রিয়ানন্দের দীক্ষান্ত-বক্তৃতার সময় দর্শক হাততালি দিয়ে তা থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। বিশ্বভারতীর ইতিহাসে যা বিরল। প্রাক্তনীদের কেউ কেউ অবশ্য বলছেন, সমাবর্তন যখন রাজনৈতিক অনুষ্ঠানের মঞ্চ হয়ে ওঠে, তখন এসব ঘটনা অনভিপ্রেত নয়।
শান্তিনিকেতনে ‘মোদী শো’ দেখে বিশ্বভারতীর বিশিষ্ট প্রাক্তনী সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করিয়ে দিয়েছেন পণ্ডিত নেহরুর কথা। ‘‘বিশ্ববিদ্যালয়ের এ রকম চেহারা আগে দেখিনি। সকলে শ্রদ্ধা এবং আগ্রহ নিয়ে আসতেন। চিনের সঙ্গে গন্ডগোলের সময়ও জওহরলাল এসেছিলেন। বলেছিলেন, এখানে এলে আমার দৃষ্টি স্বচ্ছ হয়। রবীন্দ্র অনুরাগের সেই স্পিরিটটাই নেই।’’
কোনও কোনও প্রাক্তনী সব দেখেশুনে পুরনো একটি প্রশ্ন ফিরিয়ে এনেছেন। কেন আচার্যের দায়িত্ব থাকবে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের হাতে? কেন শিক্ষাবিদ সে দায়িত্ব পাবেন না?
আর এক বিশিষ্ট প্রাক্তনী আলপনা রায় যেমন বলেছেন, ‘‘সমাবর্তন শুধু ডিগ্রিদানের অনুষ্ঠান নয়। তার শিল্প এবং রুচির দিক আছে। এখন বোধ হয় সেই জিনিসটাই আমরা পাই না।’’ প্রায় একই অনুরণন রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলায়। তিনি বলেছেন, ‘‘এমনটা কখনওই কাম্য নয়। প্রাক্তনীরা তো প্রতিবাদ করতে পারতেন! বিশ্বভারতীর সমাবর্তনের পরম্পরা মেনেই অনুষ্ঠান হওয়া উচিত ছিল। এটা রাজনৈতিক জনসভা নয়।’’
তবে বিশ্বভারতীর প্রাক্তনীদের বড় অংশেরই আক্ষেপ— কোনও সমালোচনাই শেষ পর্যন্ত রাজনীতিবিদদের কানে ঢুকবে না।