২০০৯ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৮, প্রায় ন’বছর পর লালগড় আন্দোলনের পোস্টারবয় ছত্রধর মাহাতোকে জেল থেকে মুক্তি দিতে উদ্যোগী রাজ্য সরকার। স্বরাষ্ট্র দফতর সূত্রে খবর, মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে সবুজ সঙ্কেত পাওয়ার পরই যুদ্ধকালীন তৎপরতায় আইনি জটিলতা কাটানোর কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। লালগড় থানার একটি মামলায় সন্ত্রাসদমন আইনে বা ইউএপিএ-তে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ছত্রধর এই মুহূর্তে প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগারে বন্দি।
মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ পাওয়ার পরই জঙ্গলমহলের এই নেতার ‘মায়ের অসুস্থতার’ কারণে প্যারোলের আবেদন করা হয়। সেই আবেদন মঞ্জুরও হয়। এ মাসের ১২ তারিখ থেকে ২৬ তারিখ পর্যন্ত প্যারোলে মুক্ত থাকলেও, ঝাড়গ্রামে তিনি এক বারও যাননি। সেই সময় ঝাড়গ্রামের বাড়িতে ছিলেন না তাঁর স্ত্রী নিয়তিও। এই দু’সপ্তাহ তিনি কলকাতাতেই ছিলেন, এমন তথ্যই রয়েছে পুলিশের লগবুকে।
সূত্রের খবর, মুকুন্দপুর এলাকার একটি গেস্টহাউসে তিনি সরকারি আতিথ্যে ছিলেন। সেখানে রাজ্য সরকারের প্রতিনিধিরা তাঁর সঙ্গে একাধিক বার বৈঠক করেন।
তাঁর সঙ্গে একই মামলায় সাজাপ্রাপ্ত যে বাকি পাঁচ জন, তাঁদের ছাড়াই শুধু নিজের জন্য জামিনের আবেদন করতে অবশেষে রাজি হয়েছেন ছত্রধর। এ বিষয়ে প্রথম দিকে তাঁর কিছুটা আড়ষ্টতা ছিল। তবে তা তিনি কাটিয়ে উঠেছেন বলে খবর।
এই ছবি এখনও অমলিন জঙ্গলমহলের মানুষের কাছে। ফাইল চিত্র।
এই সেই ছত্রধর মাহাতো, যার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জঙ্গলমহলের আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন তখনকার বিরোধী দলনেত্রী, বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতা-ছত্রধর একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, সে ছবি এখনও অমলিন জঙ্গলমহলের মানুষের কাছে। বাম জমানার পতন ঘটিয়ে ২০১১ সালে ক্ষমতায় এসে মুখ্যমন্ত্রী যখন রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির জন্য কমিটি গঠন করেন এবং তালিকা তৈরি করার নির্দেশ দেন, তখন ছত্রধরের নাম প্রথম দিকে থাকবে এমনটাই আশা করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে ঘটে তার উল্টো।
মানবাধিকার কর্মী সুজাত ভদ্র বলেন, “আমরা আমাদের তালিকায় অন্যান্য রাজনৈতিক বন্দিদের সঙ্গে ছত্রধরের নামও দিয়েছিলাম। কিন্তু সরকারের তালিকায় তাঁর নাম বিবেচিত হয়নি।” তিনি ওই সময়ে রাজ্য সরকার নিযুক্ত বন্দি মুক্তি কমিটির সদস্য ছিলেন। অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে ছত্রধরের বিচার প্রক্রিয়া শেষ করা হয় এবং ২০১৫ সালে যাবজ্জীবন সাজা হয় ছত্রধর এবং তাঁর ৫ সঙ্গী সুখশান্তি বাস্কে, সগুন মুর্মু, শম্ভু সোরেন, রাজা সরখেল ও প্রসূন চট্টোপাধ্যায়ের।
আরও পড়ুন: সক্রিয় খোদ মমতা, পাল্টা চালেই কি জঙ্গলে অসীমানন্দকে চাইছে বিজেপি
আরও পড়ুন: ‘স্যারেন্ডার হবনি’, নাছোড় সীমা, সরস্বতীরা
সেই ছত্রধরকেই মুক্তি দিতে এখন হঠাৎ কেন তৎপর সরকার? স্বরাষ্ট্র দফতরের আধিকারিকদের একাংশের দাবি, দীর্ঘ দিন ধরেই বিভিন্ন মহল থেকে ছত্রধরের মুক্তির বিষয়টি বিবেচনা করার আবেদন আসছিল মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। সম্প্রতি ছত্রধরের স্ত্রী এবং ছেলের সঙ্গে প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ের আধিকারিকদের কথা হয়। তার পরই সবুজ সঙ্কেত দেন মুখ্যমন্ত্রী।
লালগড় থানার একটি মামলায় সন্ত্রাসদমন আইনে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ছত্রধর এখন প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগারে বন্দি। ফাইল চিত্র।
কিন্তু কোন রসায়নে হঠাৎ করেই ভাগ্য খুলে গেল ছত্রধরের?
বিজেপি নেতা মুকুল রায়ের দাবি, “পরিবর্তনের লড়াইয়ে ছত্রধরের হাত ধরেই জঙ্গলমহলে পা রেখেছিলেন মমতা। পরে তাঁকেই ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন। অমানবিক অত্যাচার চালানো হয়েছে তাঁর ওপর। এই সমস্ত অবহেলিত মানুষদের আমরা একত্র করছি। তাই মুখ্যমন্ত্রী শঙ্কিত।” সেই সঙ্গে তিনি বলেন, ছত্রধরের মুক্তির জন্য তাঁরা সব সময় সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।
মুকুল রায়ের এই দাবির পাশাপাশি পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রার্থী তালিকাও অশনি সঙ্কেত বহন করছে বলে মনে করছেন এই এলাকার রাজনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল মানুষজন। গোটা রাজ্যে যখন বিরোধীরা মনোনয়ন জমা দিতেই হিমশিম খাচ্ছে, তখন ঝাড়গ্রাম মহকুমায় গ্রাম পঞ্চয়েত ও পঞ্চায়েত সমিতিতে নির্দল প্রার্থীর সংখ্যা যথাক্রমে ৫৬ ও ১৫। অধিকাংশই বিনপুর-২ ব্লকে প্রার্থী হয়েছেন। এক সময় মাওবাদীদের খাস ডেরা হিসেবে পরিচিত বেলপাহাড়ি, বাঁশপাহাড়ি, ভুলাভেদা, শিমুলপাল গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায়, আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চের নামে এই রাজনৈতিক কার্যকলাপ শাসক দলের যে শান্তি কেড়েছে তা বলাই বাহুল্য।
অন্য দিকে, কাকতালীয় হলেও ঠিক একই সময়ে স্বামী অসীমানন্দকে এ রাজ্যে এনে আদিবাসী-মূলবাসীদের সংগঠিত করার যে পরিকল্পনা বিজেপি নিচ্ছে, তা চিন্তা বাড়াচ্ছে শাসকের। আর সেই কারণেই কি ফের ছত্রধরের হাত ধরে জঙ্গলমহলে জমি ধরে রাখতে মরিয়া মমতা? এই মাহাতো নেতার মুক্তির জন্য রাজ্য সরকারের উদ্যোগ, সেই জল্পনাকেই উস্কে দিচ্ছে।