গাড়ির ধোঁয়া, কংক্রিটের গুঁড়োর পাশাপাশি যে ভিন্ রাজ্য থেকে ভেসে আসা কণা বাড়াচ্ছে দূষণ।
হরিয়ানা, পঞ্জাব থেকে ভেসে আসা ছাইয়ের গুঁড়োয় দিল্লির দূষণ বৃদ্ধির কথা অনেকেরই জানা। এ বার কলকাতার দূষণের পিছনেও সেই ভিন্ রাজ্যের ‘হানাদার’-দের কথা জানাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা!
সম্প্রতি বোস ইনস্টিটিউটের পরিবেশ বিজ্ঞানী অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায় এবং দুই গবেষক অভিনন্দন ঘোষ ও অরিন্দম রায় তাঁদের গবেষণাপত্রে দেখিয়েছেন, গরমকালে দখিনা বাতাসের সঙ্গে পূর্বঘাট পর্বতমালা থেকে দূষিত কণা ভেসে আসছে মহানগরে। তা-ই বাড়িয়ে তুলছে বায়ুদূষণের মাত্রা। দূষণের নিরিখে কলকাতা দেশের মধ্যে প্রথম সারিতে রয়েছে। গাড়ির ধোঁয়া, কংক্রিটের গুঁড়োর পাশাপাশি যে ভিন্ রাজ্য থেকে ভেসে আসা কণাও দূষণের জন্য দায়ী, তা অবশ্য এর আগে সামনে আসেনি। এই গবেষণার সঙ্গে জুড়ে রয়েছেন শিবাজী রাহা, সঞ্জয় ঘোষ, সনৎ দাসের মতো বিজ্ঞানীরাও।
দূষিত এই কণার প্রভাবে ফুসফুসের ক্যানসার, শ্বাসনালির রোগ-সহ নানা দুরারোগ্য ব্যাধির আশঙ্কা তো বাড়ছেই। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই দূষণের প্রভাবে কলকাতার উপরে তৈরি হওয়া মেঘের চরিত্র বদলে যাচ্ছে, বাড়তি কার্বনের প্রভাবে বাতাসে বাড়ছে গরম। প্রভাব পড়ছে জলবায়ুতেও। বস্তুত, এর আগে দার্জিলিঙে উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে ভেসে আসা দূষিত কণার কথা জানিয়েছিলেন বোস ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা।
অভিজিৎবাবু বলছেন, পূর্বঘাট পর্বত সংলগ্ন ওডিশা, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং তামিলনাড়ুর একটি অংশে কিছু চাষি গরমে ঝুম চাষের জন্য খেতের শুকনো জঞ্জাল পোড়ান। ফলে সালফার যৌগ, নাইট্রোজেন যৌগ, হাইড্রোকার্বন-সহ বিভিন্ন দূষিত উপাদান বাতাসে মেশে। ঋতুচক্রের নিয়ম মেনেই এ সময়ে বঙ্গোপসাগর থেকে হাওয়া কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গের দিকে বয়ে আসে। ‘‘প্রাকৃতিক নিয়মেই সাগরের হাওয়া বিশুদ্ধ থাকে। কিন্তু, পূর্বঘাট পর্বতমালার উপর দিয়ে আসার সময়ে তা দূষিত হয়। সেই দূষণই ঢুকছে বাঙালির ফুসফুসে,’’ বলছেন অভিজিৎবাবু।
সম্প্রতি নাসার উপগ্রহ-চিত্রেও ধরা প়়ড়েছে, গ্রীষ্মে দক্ষিণ, মধ্য এবং উত্তর ভারতের বিভিন্ন জায়গায় আগুন জ্বলছে। তাদের বিজ্ঞানীদেরও বক্তব্য, এগুলি মূলত চাষের খেতে আগুন এবং এর ফলে বায়ুদূষণ ও বাতাসের তাপমাত্রা বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে।
যদিও এই গবেষণাপত্র নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে নারাজ রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। তাদের এক শীর্ষ বিজ্ঞানীর মতে, ‘‘গবেষণাপত্র বিশদে খতিয়ে না দেখে কিছু বলা উচিত নয়। তবে এমনটা ঘটা খুব বিরল।’’ তিনি এ-ও জানান, কলকাতার বাতাসে ভাসমান দূষিত কণার পরিমাণ বেশি হলেও সালফার ও নাইট্রোজেন যৌগ কিন্তু কখনও মাত্রা ছাড়ায় না। যদিও অভিজিৎবাবুর দাবি, বাতাসে গ্যাসীয় পদার্থ হিসেবে সালফার ও নাইট্রোজেন যৌগের পরিমাণ বাড়ে না এটা ঠিক। কিন্তু তাঁদের গবেষণায় ধরা পড়েছে, পূর্বঘাট থেকে ভেসে আসা সূক্ষ্ম কঠিন কণার মধ্যে সালফার ও নাইট্রোজেন যৌগের পরিমাণ বা়ড়ছে।
পর্ষদের একাংশ এ-ও প্রশ্ন তুলছে, এই ধরনের গবেষণার জন্য বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে নজরদারি কেন্দ্র থাকা প্রয়োজন। তা কি ওই প্রতিষ্ঠানের রয়েছে? বোস ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের বক্তব্য, কলকাতা দূষণের উৎস হলে বিভিন্ন এলাকায় নজরদারি করার প্রয়োজন হত। কিন্তু এ ক্ষেত্রে দূষিত কণাগুলি অনেক দূর থেকে ভেসে আসায় শহরের নানা প্রান্তে নজরদারির দরকার হয়নি। তাঁরা জানিয়েছেন, মূলত কলকাতার উপরে গবেষণা হওয়ায় শহরে তাঁদের নজরদারি কেন্দ্র থেকে তথ্য নেওয়া হয়েছে। এর বাইরে কৃত্রিম উপগ্রহে ধরা পড়া তথ্যও তাঁরা নিয়েছেন।
এ-ও প্রশ্ন উঠেছে, এই ভিন্ রাজ্যের হানাদারি ঠেকানোর উপায় কী?
অভিজিৎবাবুর বক্তব্য, এ ক্ষেত্রে ওই রাজ্যগুলিতে ঝুম চাষের ক্ষেত্রে বর্জ্য পো়ড়ানোর বদলে বিকল্প রাস্তা বার করা প্রয়োজন। তা না হলে ভবিষ্যতে এই বিপদ আরও বাড়বে।