—ফাইল চিত্র।
ভোটের আগে জাতীয়তাবাদের ঢেউকে ঘুর্ণিতে পরিণত করার কৌশল নিয়েছে বিজেপি। সেই কাজে এ বার প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা কংগ্রেস নেতা বল্লভভাই পটেলকে হাতিয়ার করছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের এই কর্মসূচিতে রাজনীতির কূটচাল দেখছে রাজ্য। আর এই কর্মসূচি পালনে তাদের অনীহার কথাটি দিল্লিকে সাফ সাফ বুঝিয়ে দিতে চাইছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার।
সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের নামে পাকিস্তানকে ‘মুখের মতো জবাব’ দেওয়া নিয়ে ধারাবাহিক প্রচারে দেশজুড়ে জাতীয়তাবাদের হাওয়া তুলেছে অমিত শাহের দল। উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচনের পাশাপাশি সামনের লোকসভা ভোটেও এই হাওয়াকে পালে ধরে উত্তরণেরে কৌশল নিয়েছে বিজেপি। তারই অঙ্গ হিসেবে এ বার ৩১ অক্টোবর থেকে ৬ নভেম্বর দেশজুড়ে ‘সর্দার বল্লভভাই পটেল সপ্তাহ’ পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার। উদ্দেশ্য— দেশের প্রতিটি স্কুলে পটেলের জাতীয়তাবাদ এবং কাশ্মীরের ভারতভুক্তি নিয়ে তাঁর অবদানের কথা পড়ুয়াদের সামনে তুলে ধরা।
কেন্দ্রের এই প্রস্তাবে ঘোরতর আপত্তি রয়েছে রাজ্য সরকারের। নবান্নের অভিমত, এই ধরনের কর্মসূচির পিছনে আসলে রাজনৈতিক স্বার্থ নিহিত রয়েছে। এ ভাবে নিজেদের মতাদর্শ পড়ুয়াদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চায় বিজেপি। পটেল সপ্তাহ পালনে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্কুল শিক্ষা দফতর তাই একেবারেই আগ্রহ দেখাচ্ছে না।
তাই শুধু এই সিদ্ধান্ত নেওয়াই নয়, তাঁদের এই মনোভাব আজ, মঙ্গলবারই কেন্দ্রকে বুঝিয়ে দিতে চান নবান্নের কর্তারা। পটেল সপ্তাহ উদযাপন সফল করতে কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর মঙ্গলবার দেশের সমস্ত রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী এবং সচিবদের সঙ্গে ভিডিও সম্মেলন করবেন। নবান্নের খবর, নিজেদের অনীহার কথা বোঝাতে তাতে সামিল হবেন না রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় অথবা সচিব দুষ্মন্ত নারিয়াল। তবে নিয়ম রক্ষায় শিক্ষা দফতরের এক অফিসার থাকবেন। ঠিক হয়েছে, বৈঠকে তিনি শুধুই শুনবেন, বলবেন না কিছুই।
কেন্দ্রের কর্মসূচি নিয়ে তাঁর দফতরের অফিসারদের বাড়তি উৎসাহ দেখাতে বারণ করে দিয়েছেন পার্থবাবুও। তাঁর কথায়, ‘‘যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় এ ভাবে রাজ্যের উপর কোনও অনুষ্ঠান চাপিয়ে দেওয়া যায় না। রাজ্যের নিজস্ব অগ্রাধিকার থাকে। পটেল সপ্তাহ পালন এখনই প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করছি না।’’ শিক্ষামন্ত্রীর অভিযোগ, এর আগেও মোদীর ভাষণ শোনানো, সরস্বতী বন্দনা গাওয়া ইত্যাদির কথা বলে কেন্দ্র হিন্দুত্ববাদী ভাবনা পড়ুয়াদের মাথায় ঢোকাতে চেয়েছে। তখনও রাজ্য তাতে সামিল হয়নি।
কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী অবশ্য সর্দার পটেলকেই ‘বিবিধ ভারত’-কে একীকরণ করার মহানায়ক বলে মনে করেন। সেই কারণেই তাঁর নামে সপ্তাহের নাম দেওয়া হয়েছে ‘রাষ্ট্রীয় একতা সপ্তাহ’। মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের আর্থিক উপদেষ্টা ভিএলভিএসএস সুব্বা রাও রাজ্যের শিক্ষাসচিবদের পাঠানো এক বিশেষ নোটে জানিয়েছেন, সর্দার পটেল ছিলেন ভারতবর্ষের ঐক্য রক্ষার সব চেয়ে বড় নায়ক। ব্রিটিশরাজ শেষ হওয়ার পর তাঁর হাত ধরেই এ দেশের রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক এবং প্রশাসনিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেই কারণেই কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিটি স্কুলে পটেলের নীতি নিয়ে বিতর্ক-সভা, তাঁর জীবনী নিয়ে নাটক, প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা, তথ্যচিত্র প্রদর্শন, চিত্র প্রদর্শনী এবং একতা দৌড়ের আয়োজন করতে চায়। একটি ই-গ্রুপ তৈরি করে সেখানে স্কুলগুলিকে অনুষ্ঠানের ছবি পাঠাতেও বলেছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রক।
কেন্দ্রের এই ফরমানে ক্ষোভ ছড়িয়েছে নবান্নের শীর্ষ মহলে। শিক্ষামন্ত্রীর মতে, ‘‘দেশ গঠনে সর্দার পটেলের ভূমিকা নিয়ে কোনও প্রশ্ন উঠতে পারে না। তা বলে এক সপ্তাহ ধরে স্কুলে স্কুলে পটেল কেন্দ্রিক অনুষ্ঠান করলে গাঁধী, নেহরু, সুভাষচন্দ্র, বিবেকানন্দকে নিয়েও তো করতে হয়।’’
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই নিয়ে সরাসরি কিছু না বললেও কেন্দ্রের এই ধরনের ‘রাজনৈতিক-কর্মসূচি’-তে যে তাঁর সায় নেই, তা জানাচ্ছেন শিক্ষা দফতরের একাংশ। দফতরের এক কর্তা জানান, স্বচ্ছ ভারত অভিযান নিয়ে স্কুলে স্কুলে প্রজেক্টরের মাধ্যমে নরেন্দ্র মোদীর ভাষণ শোনানোর ফরমান দিয়েছিল কেন্দ্র। রাজ্য তা মানেনি। দু’টি জেলা ভুল করে কিছু পদক্ষেপ করায় তাদের কর্তাদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। এ বার শিক্ষামন্ত্রী তাই আগে থেকেই দফতরের কর্তাদের সতর্ক করে জানিয়েছেন, এক সপ্তাহ ধরে পটেল মাহাত্ম্য প্রচারের কোনও প্রয়োজনই নেই।