রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিংহ এবং রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। —ফাইল চিত্র।
পঞ্চায়েত নির্বাচনে হিংসার ঘটনা রুখতে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিংহ ‘ব্যর্থ’। হিংসার যে ‘রক্ত’ কমিশনারের ‘হাতে লেগে আছে’ পবিত্র গঙ্গার জলেও তা ‘ধোয়া যাবে না’। ভোটের দু’দিন আগে, বৃহস্পতিবার রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের উদ্দেশে এমন হুঁশিয়ারিই দিলেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। কমিশনারকে সঠিক পদক্ষেপ করার পাশাপাশি, রাজধর্ম পালন করার নির্দেশও দিয়েছেন তিনি। বৃহস্পতিবার রাজভবনে সাংবাদিকদের ডেকেছিলেন রাজ্যপাল। সেখানেই রাজীবের উদ্দেশে রাজ্যপাল বলেন, ‘‘আপনাকে আমি নিয়োগ করেছিলাম। কিন্তু আপনি রাজ্যবাসীকে হতাশ করেছেন। দায়িত্ব পালনে আপনি ব্যর্থ। এখনও সময় আছে, সঠিক পদক্ষেপ করুন। রাজধর্ম পালন করুন।’’ পাল্টা রাজ্যপালকে বিঁধেছে বাংলার শাসকদল।
শনিবার রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোট। মনোনয়ন পর্ব শুরু হওয়ার পর থেকেই রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় প্রাণহানি, রক্তপাত, বোমাবাজি, সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সেই আবহেই ভোটের ঠিক দু’দিন আগে কমিশনারকে হুঁশিয়ারি দিলেন রাজ্যপাল। তিনি বলেন, ‘‘আগুন নিয়ে খেলা হচ্ছে। রক্ত নিয়ে খেলা হচ্ছে। মানুষের জীবন নিয়ে খেলা হচ্ছে। মানুষের অসহায়তা দেখেছি। চোখের জল দেখেছি। পিতৃহারা শিশুর কান্না দেখেছি। এই রাজনৈতিক হিংসা বন্ধ হওয়া উচিত।’’ এর পরেই শেক্সপিয়রের ‘ম্যাকবেথের’ প্রসঙ্গ তুলে ধরেন রাজ্যপাল। রাজীবের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘‘সঠিক পদক্ষেপ করতে যদি ব্যর্থ হন, তা হলে আরবের সমস্ত সুগন্ধী আপনার ছোট হাতকে মিষ্ট করবে না। পবিত্র গঙ্গার জলে আপনার হাতের রক্ত ধোয়া যাবে না।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘বাসন্তী, পুরুলিয়া, কোচবিহারে হিংসার দায় কার? কে ঘাতক? রাজ্য নির্বাচন কমিশনের জানা উচিত। এত মৃত্যুর দায় কার? কমিশনকে জবাব দিতে হবে।’’ সুষ্ঠু এবং অবাধ নির্বাচন যাতে করা হয়, সে বিষয়টি সুনিশ্চিত করতে রাজ্য নির্বাচন কমিশনারকে বার্তা দিয়েছেন রাজ্যপাল। তিনি বলেন, ‘‘গ্রাউন্ড জিরো রাজ্য নির্বাচন কমিশনার হন। মানুষের হৃদয় ভেঙে গিয়েছে। মানুষ বলছে, তাঁদের প্রিয়জনের জীবন ফেরাতে।’’ এ কথা বলতে গিয়ে চশমা খুলে ফেলেন রাজ্যপাল। তাঁর চোখে জলও দেখা যায়।
রাজভবনে রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। —নিজস্ব চিত্র।
বস্তুত, নিজেকে ‘গ্রাউন্ড জিরো রাজ্যপাল’ হিসাবে তুলে ধরেছিলেন বোস। সেই মতো হিংসাদীর্ণ এলাকা ঘুরে দেখেন তিনি। দু’দিন বাদেই পঞ্চায়েত ভোট। শান্তিপূর্ণ ভাবে নির্বাচন যাতে করা হয়, তা সুনিশ্চিত করতে রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের উদ্দেশে রাজ্যপাল বলেছেন, ‘‘এখনও সময় রয়েছে। সঠিক পদক্ষেপ করুন। স্পর্শকাতর এলাকায় সিসিটিভি ক্যামেরা লাগান। কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করুন। স্ট্রংরুমে নিরাপত্তা বাড়ান। সাধারণ মানুষের কথা শুনুন। তাঁদের মতামত নিন। মানুষ বলছে, নকল ব্যালট পেপার ছাপানো হচ্ছে, খতিয়ে দেখুন।’’
রাজ্য নির্বাচন কমিশনার হিসাবে রাজীবের ভূমিকা নিয়ে গোড়া থেকেই ‘আপত্তি’ তুলে আসছে বিরোধীরা। রাজীবের কাজে যে রাজ্যপাল বোস ‘সন্তুষ্ট’ নন, তা আগেই স্পষ্ট হয়েছিল। রাজীবের যোগদান রিপোর্ট (জয়েনিং রিপোর্ট) নবান্নে ফেরতও পাঠিয়েছিলেন তিনি। তার পরেই রাজভবনে গিয়ে রাজ্যপালের সঙ্গে প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে বৈঠক করেছিলেন রাজীব। রাজভবন সূত্রে খবর, সেই বৈঠকে রাজীবকে ‘নিরপেক্ষ ভাবে’ কাজ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন রাজ্যপাল। কিন্তু তার পরও রাজ্যে একাধিক অশান্তির ঘটনা ঘটেছে। রাজ্যপাল নিজেই হিংসাদীর্ণ এলাকা ঘুরে দেখেন। রাজভবনে খোলেন ‘শান্তিকক্ষ’। পাশপাশি, রাজভবনের উদ্যোগে তৈরি হয়েছে ‘শান্তি ও সামাজিক সংহতি কমিটি’। রাজ্যপালের এই সব পদক্ষেপে ‘খুশি নয়’ নবান্ন। এ নিয়ে রাজ্য বনাম রাজভবন সংঘাত চরমে পৌঁছেছে। রাজ্যপালের বিরুদ্ধে রাজ্য নির্বাচন কমিশনে অভিযোগও জানিয়েছে তৃণমূল। সেই দ্বন্দ্ব বৃহস্পতিবার আরও নতুন মাত্রা যোগ করল।
অন্য দিকে, কমিশনারকে রাজ্যপালের এই হুঁশিয়ারি নিয়ে পাল্টা দিয়েছে তৃণমূল। তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেন, ‘‘রাজ্যপালের নামে সিভি আনন্দ বোস যে কাজটি করলেন, তা বিজেপির এজেন্টের কাজ। আজ পঞ্চায়েত ভোটপ্রচারের শেষ দিনে বিজেপির দালালি করে বিরোধীদের হয়ে প্রচার করে তিনি প্রমাণ করে দিলেন যে, তিনি রাজনীতি করছেন।’’ কুণাল আরও বলেন, ‘‘রাজ্যপালের অন্য কাজ রয়েছে। রাজ্যপাল কাজ তো সাংবিধানিক বৈঠক করে রাজনীতি করা নয়। রাজ্যপাল যদি মনেই করেন, কমিশনার ভুল করেছেন, তা হলে রাষ্ট্রপতিকে রিপোর্ট দেবেন। লিখিত নালিশ করবেন। অথচ সাংবিধানিক পদে বসে রাজনীতি করবেন। এটা হতে পারে না। তাঁর বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত কমিশনের।’’ রাজ্যপালকে কটাক্ষ করে কুণাল আরও বলেন, ‘‘ব্যাগ গুছিয়ে রাখুন। ১১ জুলাইয়ের পর বাংলার মাটিতে আর আপনার কোনও জায়গা নেই। মানুষ যে রায় দেবে, তার পর আর আপনার মুখ থাকবে না।’’ যদিও বৃহস্পতিবার রাজ্যপাল তাঁর সাংবাদিক বৈঠকে জানিয়েছেন, ‘‘আমি মানুষের সঙ্গে দেখা করেছি। আমি রাজনীতির ঊর্ধ্বে। হিংসার বিরুদ্ধে লড়াই করছি। আমি সকলের রাজ্যপাল। রাজনীতি করছি না।’’
রাজ্যপালের ভূমিকা নিয়ে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছে বিজেপি। বিজেপির মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘‘রাজ্যপাল চেষ্টা করছেন মানুষের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষা করতে। মানবিক মুখ নিয়ে নেমেছেন। কথায় কাজ হবে না।’’