মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
প্রশ্ন উঠেছিল একাধিক মহল থেকে। এমনকি, প্রশ্ন তুলেছিল সুপ্রিম কোর্টও। এই পরিস্থিতিতেই স্বাস্থ্যক্ষেত্রে রাতে মহিলাদের কাজে যে ‘নিয়ন্ত্রণ’ আরোপ করে হয়েছিল, তা প্রত্যাহার করে নিল রাজ্য। অভিজ্ঞ আধিকারিকদের একাংশের মতে, এ বারও চাপে পড়েই পিছু হঠতে হল সরকারকে।
শুক্রবার লিখিত ভাবে রাজ্য জানিয়েছে, ‘রাত্তিরের সাথী’ সহযোগিতা কর্মসূচির আওতায় বলা ছিল, মহিলা চিকিৎসক-সহ মহিলা কর্মীদের কাজের সময় ১২ ঘণ্টা অতিক্রম যেন না করে এবং যেখানে যত দূর সম্ভব মহিলাদের রাত্রের ডিউটি দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। এই দু’টি নির্দেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, আর জি কর-কাণ্ডের পরে হাসপাতাল সুরক্ষা নিয়ে বড়সড় প্রশ্ন উঠে গিয়েছিল। নিরাপদ শহরের মর্যাদা কলকাতা কতটা ধরে রাখতে পারছে, প্রশ্ন উঠেছিল তা নিয়েও। এই দুই নির্দেশের পরে বিভিন্ন মহল বলতে শুরু করেছিল, মহিলাদের কাজের সময়ে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার মাধ্যমে কি এই অভিযোগগুলিকেই মেনে নেওয়া হচ্ছে!
প্রসঙ্গত, গত শুনানিতে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় রাজ্য সরকারের এই নির্দেশিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছেন, রাজ্য প্রশাসন মহিলাদের বলতে পারে না যে তাঁরা রাতে কাজ করবেন না। মহিলারা কোনও ছাড় চাইছেন না। তাঁরা কাজের জায়গায় নিরাপত্তা চাইছেন। তাঁরা সমান সুযোগ চাইছেন। তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘‘কী ভাবে এমন নির্দেশিকা জারি হতে পারে? মহিলা ডাক্তাররা সমস্ত পরিস্থিতিতে কাজ করতে চাইছেন। রাজ্য সরকারকে এই নির্দেশিকা শোধরাতে হবে।’’
পাশাপাশি, বৃহস্পতিবারই নির্দেশিকা দিয়ে সরকার জানিয়েছে, কলকাতার পুলিশ কমিশনারের সুপারিশক্রমে হাসপাতালের নিরাপত্তা আধিকারিক হিসেবে ছ’জন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশকর্তাকে নিয়োগ করা হয়েছে। তাঁরা চারটি সরকারি হাসপাতাল, একটি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল এবং কলকাতা পুলিশের অধীনে থাকা একটি জেলা হাসপাতালে তাঁদের দায়িত্ব দেওয়া হবে। সে দিনই মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন ডিজি সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ সব সরকারি হাসপাতালের নিরাপত্তা অডিট করবেন। সে জন্যও তৈরি হবে বিশেষ অ্যাপ।
বৃহস্পতিবার সব সরকারি মেডিক্যাল কলেজ, হাসপাতালের অধ্যক্ষ, সুপার, জেলা-ব্লক স্বাস্থ্যকর্তা, জেলাশাসক এবং পুলিশ সুপারদের সঙ্গে বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী। বৈঠকে ‘রাত্তিরের সাথী’ সম্পর্কে সবিস্তার কথা হয়েছিল। ঘটনাচক্রে, তার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই এই আদেশনামা কার্যকর করা হয়েছে। প্রশাসনিক বিশ্লেষকদের একাংশের যুক্তি, বর্তমান সময়ে ‘নাইট-ডিউটি’-এর নিরিখে মহিলা-পুরুষে বিভাজন করা অযৌক্তিক। নিরাপত্তা দেওয়া এবং তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং প্রশাসনের। ফলে মহিলাদের কাজের সময়ে এ ধরনের নিয়ন্ত্রণের অর্থ হয়— প্রশাসন সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছে। সম্ভবত সেই কারণেই এত দ্রুত সে গুলি প্রত্যাহার করতে হল নবান্নকে।
অভিজ্ঞ এবং প্রবীণ আধিকারিকদের অনেকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন, আর জি কর-কাণ্ডের পরে আন্দোলনের তীব্রতা ক্রমশ বাড়তে থাকে। জুনিয়র চিকিৎসকদের আন্দোলনও ভাবিত করেছিল সরকারকে। সেই আন্দোলনের শুরুতে কিছু চিকিৎসককে আচমকা বদলি করা হলেও পরে সেই আদেশনামা প্রত্যাহার করতে হয় সরকারকে। আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে বদল করতে হয় অধ্যক্ষকেও। আন্দোলনকারীদের চাপের সামনে স্বাস্থ্য অধিকর্তা, স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা এমনকি কলকাতা পুলিশ কমিশনারকেও অপসারণ করতে হয় সরকারকে। সেই দিক থেকে এ দিনের সরকারি অবস্থানকেও তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
এই দু’টি নির্দেশ প্রত্যাহার ছাড়া বাকিগুলি অবশ্য একই রেখেছে সরকার। যেমন মহিলাদের জন্য পৃথক বিশ্রামকক্ষ, মহিলা ভলান্টিয়ার, ক্লোজ়ড সার্কিট ক্যামেরার নজরদারিতে সেফ জোন তৈরি, স্থানীয় থানার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে মহিলাদের জন্য বিশেষ মোবাইল অ্যাপ, ১০০/১১২ হেল্পলাইনের প্রয়োগ ইত্যাদি।