মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি পিটিআই।
কৃষি ক্ষেত্রে সংস্কারের লক্ষ্যে মোদী সরকারের করা তিনটি আইনের বিরুদ্ধে সরব বিরোধীরা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও একে কৃষক স্বার্থের পরিপন্থী বলে রাজ্যসভায় বিল পাসের দিনটিকে ‘ব্ল্যাক সানডে’ আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু ঘটনা হল, মাঠে ফসল থাকাকালীনই বেসরকারি সংস্থা যাতে চাষিদের কাছ থেকে তা কিনে নিতে পারে, সে জন্য ২০১৪ সালে আইন পাশ করেছে তৃণমূল সরকার। খুলে দিয়েছে কৃষিপণ্যের বাজারে বৃহৎ পুঁজি প্রবেশের পথ। ২০১৭ সালে একটি সংশোধনী এনে কৃষিপণ্যের ই-ট্রেডিং বা অনলাইন বাণিজ্য এবং বিপণনও বৈধ করা হয়।
১৯৭২ সালের কৃষি বিপণন আইন সংশোধন করে কৃষিপণ্যের বাজার ও বিপণনকে আর পুরোপুরি সরকারি নিয়ন্ত্রণে না-রাখাকে কৃষি সংস্কারে ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবেই দেখা হত। ফলে এখন তৃণমূল সরকারের নীতিগত অবস্থান বদলে কিঞ্চিৎ বিস্মিত রাজ্যের কৃষি ও কৃষি বিপণন দফতরের কর্তারা।
দফতরের এক শীর্ষকর্তার কথায়, ‘‘কৃষিপণ্যের অবাধ ক্রয়, মজুতদারি, বিপণনের জন্য রাজ্যের আইন আগেই বদল হয়েছে। আমরা শুধু চুক্তি চাষের কোনও আইন করিনি। ২০১৭ সালে মডেল আইন পাঠিয়ে কেন্দ্র তা করতে বলেছিল। তার বদলে সরকারি আদেশনামা জারি করে রাজ্য ঘুরপথে চুক্তি চাষের অনুমোদন দিয়েছে। তবে আমাদের রাজ্যে লাইসেন্স নিয়ে সেই ব্যবসা করতে হয়। কেন্দ্রীয় আইনে নোটিফায়েড মার্কেট এরিয়ার বাইরে লাইসেন্স প্রথাও তুলে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এটুকুই শুধু পার্থক্য।’’
আরও পড়ুন: মমতার কথা তুলে কৈলাসের খোঁচা ‘ছোট পাপ্পু’কে
কৃষিমন্ত্রী আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, ”আমাদের রাজ্যে কৃষিপণ্য বিপণনে বেসরকারি পুঁজি আনার ব্যবস্থা হলেও নিয়ন্ত্রণ সরকারি হাতেই রয়েছে। কেন্দ্রীয় আইনে কর্পোরেটরা কোনও রকম লাইসেন্স ছাড়াই কৃষিপণ্য চাষিদের থেকে কিনে নিতে পারবে। আমাদের আইনে বেসরকারি সংস্থা সরকারি লাইসেন্স ছাড়া চাষির পণ্য কিনতে পারবে না।”
কেন্দ্রীয় আইনে চুক্তিচাষ বৈধ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, রাজ্যের নির্দিষ্ট করা বাজার বা মান্ডির বাইরে কৃষিপণ্যের কেনাবেচায় কোনও লাইসেন্স লাগবে না। সে জন্য চাষি বা ব্যবসায়ীকে কাউকে কোনও বাজার-ফিও দিতে হবে না। রাজ্যের মধ্যে বা একাধিক রাজ্যের মধ্যেও অবাধে কারবার চালানো যাবে। আলু, পেঁয়াজ, ডালশস্যকে অত্যাবশ্যক পণ্য আইনের বাইরে রাখা হয়েছে। তবে এক বছরের মধ্যে কোনও রাজ্যে কোনও পণ্যের দাম যদি দ্বিগুণ হয় বা ছ’মাসের মধ্যে ৫০% বেড়ে যায়, তা হলে সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকার ফের সেই সব পণ্যকে অত্যাবশ্যক বলে ঘোষণার সুযোগ পাবে।
বিরোধীদের অভিযোগ, এই তিনটি আইনের ফলে কৃষকেরা বৃহৎ পুঁজির হাতের পুতুল হয়ে যাবেন। চাষবাসও কয়েকটি সংস্থার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। যদিও রাজ্যের কৃষিকর্তারা জানাচ্ছেন, এ রাজ্যে কেন্দ্রীয় কৃষি আইনের বিরাট কোনও প্রভাব পড়ার কথা নয়। কারণ, ১৯৭২ সালের কৃষি বিপণন আইনে নিয়ন্ত্রিত বাজার সমিতি তৈরি হলেও চাষিরা সেখানে পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য ছিলেন না। কিন্তু পঞ্জাব, হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র বা দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে চাষিরা
নির্দিষ্ট মান্ডিতেই ফসল বিক্রি করতে বাধ্য। সে সব রাজ্যে ডাল, ধান, আনাজের আলাদা আলাদা মান্ডি রয়েছে। যা কমিশন এজেন্টরা নিয়ন্ত্রণ করেন। মূলত রাজনৈতিক দলগুলির হাতেই এই নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। অথচ এ রাজ্যে ৪ হাজারের বেশি বেসরকারি মালিকের বাজার আছে। লাইসেন্স প্রথায় বা কমিশন এজেন্ট হিসেবেই তাঁরা বাজারগুলি চালান। সেখানে সব ধরনের পণ্যের বেচাকেনা হয়। আনাজ বা ফলের জন্য তো কোনও লেভিও চাষিকে দিতে হয় না।
তবে রাজ্যে ২০১৪ সালের আগে কোনও ফার্ম, কোম্পানি বেসরকারি বাজার তৈরি করে একক নিয়ন্ত্রণে কৃষিপণ্য কেনাবেচা, আমদানি-রফতানি, মজুত, সংরক্ষণ করতে পারত না। আইন সংশোধন করে সেই ব্যবস্থা চালু হয়েছে। এখন পেপসি তাদের আলুভাজার জন্য বর্ধমানের চাষিদের সঙ্গে চুক্তি করে আলু কিনতে পারে। রিলায়্যান্স ফ্রেশ, মেট্রো ক্যাশ অ্যান্ড ক্যারি চাষিদের বীজ দিয়ে নির্দিষ্ট গুণমানের ফসল ফলিয়ে তা কিনে নিতে পারে। সে জন্য অবশ্য রাজ্য সরকারের কাছ থেকে লাইসেন্স নিতে হয়।
রাজ্যের কৃষিকর্তারা জানাচ্ছেন, নতুন কেন্দ্রীয় আইনে মার্কেট এরিয়া বা ট্রেড এরিয়ার বাইরে যে কোনও সংস্থা কৃষিপণ্য কেনাবেচা করতে পারবে। তার জন্য কোনও লাইসেন্সও নিতে হবে না, লেভিও দিতেও হবে না। এক কৃষিবিপণন কর্তার কথায়, ‘‘এখন কোলে মার্কেটকে সরকারি ট্রেড এরিয়া ধরা হলে সেখানে লাইসেন্স নিয়ে কৃষিপণ্য কেনাবেচা হবে। কিন্তু কোলে মার্কেটের বাইরে ফুটপাতে কৃষিপণ্যের অবাধ কেনাবেচা হবে। সেখান থেকে ওড়িশার ব্যবসায়ী আলু-পটল কিনে নিয়ে গেলেও রাজ্যের কিছু বলার থাকবে না। ফলে বাজারে সরকারি নিয়ন্ত্রণ কার্যত থাকবে না।’’