ফাইল চিত্র।
দিল্লি, মুম্বই, চেন্নাইয়ের মতো মহানগরীতে অটোরিকশা চলে মিটারে। কলকাতায় নয় কেন? কলকাতা হাইকোর্ট ট্যাক্সির মতো অটোতেও মিটার চালু করার নির্দেশ দিয়েছিল দীর্ঘদিন আগে। সেই বন্দোবস্ত এখনও হয়নি কেন?
রাজ্য সরকারের প্রস্তাবিত অটো-নীতিতে এই সব প্রশ্নের উত্তর থাকছে না। সেখানে পরিষ্কার বলে দেওয়া হচ্ছে, অটো এখানে মিটারে চলবে না। রুট অনুযায়ী পৃথক পৃথক ভাড়ায় যেমন চলছে, তেমনই চলবে। এবং অটোর ভাড়াও নিয়ন্ত্রণ করবে না সরকার। ভাড়া চূড়ান্ত করার অধিকার থাকবে ইউনিয়নের হাতেই।
অটো-দৌরাত্ম্য নিয়ে তুমুল হইহল্লার পরে এমনই কিছু চমকহীন ঘোষণা দিয়ে পরিবহণমন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী আজ, সোমবার রাজ্যের নতুন অটো-নীতি চালু করতে চলেছেন বলে পরিবহণ দফতর সূত্রের খবর। নবান্ন-কর্তাদের একাংশের কথায়, ‘‘অটো চলাচলে যে-ছন্দ চালু রয়েছে, তা বজায় রেখেই এই বাহনটিকে শৃঙ্খলায় বাঁধতে চাইছে সরকার। তাই মিটারে চালানোর বা পরিবহণ দফতরের হাতে ভাড়া নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দেওয়ার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না।’’
ভুক্তভোগী যাত্রিসাধারণের প্রশ্ন, তা হলে শৃঙ্খলা বলতে আর রইল কী? অটোর বেপরোয়া দাদাগিরি কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে, সেটা তো যাত্রীরা রোজই দেখছেন। সম্প্রতি মন্ত্রী থেকে পুলিশকর্মীরাও দেখেছেন খাস কলকাতায়। খাদ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বচসায় জড়িয়ে পড়েছেন অটোচালকেরা। তাঁদের ধাক্কাধাক্কিতে নিগৃহীত হয়েছেন মন্ত্রীর রক্ষী। পুলিশকর্মীকে পেটানো হয়েছে রাস্তায় ফেলে। এই প্রেক্ষিতেই অটোকে শৃঙ্খলায় বাঁধতে আজ অটো-নীতি ঘোষণা করা হবে বলে জানিয়েছেন পরিবহণমন্ত্রী।
২০১১ সালে প্রথম বার ক্ষমতায় এসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অটোকে শৃঙ্খলায় বাঁধতে আশিস ঠাকুরের নেতৃত্বে একটি কমিটি তৈরি করেন। কিন্তু সেই কমিটির নানান সুপারিশের কোনওটিই বাস্তবায়িত করেনি সরকার। এমনকী সেই রিপোর্ট প্রকাশও করা হয়নি। পরিবহণ দফতরের খবর, নতুন অটো-নীতি তৈরির ক্ষেত্রে পরিবহণ-কর্তারা প্রধানত ঠাকুর কমিটির রিপোর্ট অবলম্বন করেই এগিয়েছেন। সেই রিপোর্টে দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই নতুন নীতির খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। কিন্তু ঠাকুর কমিটির রিপোর্টে কলকাতাকে কয়েকটি অঞ্চলে ভাগ করে মিটারে অটো চালানোর প্রস্তাব থাকলেও নতুন অটো-নীতিতে তা গ্রহণ করা হয়নি।
মিটারের সঙ্গে সঙ্গে সরকারি ভাবে অটোর ভাড়া বেঁধে দেওয়ার মতো জরুরি বিষয়টিকেও শিকেয় তুলে রাখছে নবান্ন। উৎসবে ‘বোনাস’-এর নামে ইচ্ছেমতো বাড়তি ভাড়া নিচ্ছে বিভিন্ন রুটের অটো। বেশি ভাড়া নেওয়া চলবে না বলে পরিবহণমন্ত্রী হুঙ্কার দিলেও তার তোয়াক্কা করছেন অটোচালকেরা। এই অবস্থায় অটো-শাসনের জন্য সরকার ভাড়ার বিষয়টি হাতে নিলে কিছুটা সুরাহা হতে পারত বলে মনে করছেন যাত্রীরা। কিন্তু নয়া নীতিতে ভাড়ার দায়িত্ব ইউনিয়নের হাতেই ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে।
অটো-নীতি তৈরির আগে কলকাতা, বিধাননগর ও হাওড়া পুলিশ কমিশনারেটের সঙ্গে কয়েক বার আলোচনা করেছেন দফতরের শীর্ষ কর্তারা। সেই সব বৈঠকে পুলিশ কিছু প্রস্তাব দিয়েছিল। তার মধ্যে ছিল: l অটোয় হাই-সিকিওরিটি নম্বর প্লেট বাধ্যতামূলক করা। l অটোচালকদের তথ্যভাণ্ডার তৈরি করে তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া। যাতে যাত্রীদের সঙ্গে তাঁরা ভাল ব্যবহার করেন। নতুন নীতিতে শুধু এটুকু বলা হচ্ছে যে, অটোচালকদের সবিস্তার তথ্যভাণ্ডার তৈরির চেষ্টা হবে।
অটো নিয়ে হাজারো সমস্যার মধ্যে একটি হচ্ছে অবৈধ অটোর আধিক্য। ঠিকঠাক হিসেব দিতে না-পারলেও নবান্নের কর্তাদের বক্তব্য, রাজ্যে যত বৈধ অটো আছে, বেআইনি অটো তার থেকে কিছু কম নয়। বৈধ-অবৈধ অটোর সমস্যা দূর করতে সব অটোকেই বৈধ করে দেওয়ার কথা ভাবছে সরকার।
সেটা কী করে সম্ভব? যে-অটো বেআইনি, তার গায়ে বেমালুম একটা ‘বৈধ’ ছাপ্পা দিয়ে দিলেই কি তা আইনসঙ্গত বাহন হয়ে যাবে?
এর জবাবে পরিবহণ দফতরের এক কর্তা বলছেন, ‘‘অনেক অবৈধ অটো যে রাস্তায় চলছে, তার পিছনে সরকারের কিছু ত্রুটি রয়েছে। সেগুলো কাটিয়ে এককালীন সব অটোকে পারমিট এবং হাই-সিকিওরিটি নম্বর প্লেট দিয়ে দিলে অবৈধ অটোর সমস্যা থাকবে না বলেই মনে করা হচ্ছে।’’
পরিবেশ দূষণ আটকাতে হাইকোর্ট ২০০৮ সালে নির্দেশ দিয়েছিল, কলকাতা মেট্রোপলিটন এলাকা (কেএমএ) বা বৃহত্তর কলকাতায় সব টু-স্ট্রোক অটো বাতিল করে এলপিজি-তে চলা ফোর-স্ট্রোক অটো নামাতে হবে। কলকাতা, বিধাননগর, হাওড়া ও চন্দননগর কর্পোরেশন বা পুর নিগম এবং দুই ২৪ পরগনা, হাওড়া, হুগলি, নদিয়ার ৩৭টি পুরসভা নিয়ে এই কেএমএ এলাকা গঠিত। এই পুরো এলাকাতেই পেট্রোলের অটোরিকশাকে গ্যাসে চালানোর উপযোগী করে তোলার নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট।
কিন্তু উচ্চ আদালতের সেই নির্দেশ বলবৎ হয়েছে শুধু কলকাতা, বিধাননগর ও হাওড়া কমিশনারেট এলাকায়। কেএমএ-র বাকি এলাকার প্রায় সর্বত্রই রমরমিয়ে চলছে নিষিদ্ধ পেট্রোল-অটো। নতুন অটো-নীতিতে জানানো হচ্ছে, পুরো কেএমএ এলাকাতেই গ্যাস-অটো চালু করতে চায় সরকার। প্রয়োজন অনুযায়ী কেএমএ এলাকায় অটো রুটেরও পুনর্বিন্যাস ঘটাতে চাইছে পরিবহণ দফতর। এক পরিবহণকর্তা জানান, কোনও কোনও রুটের মধ্যে একাধিক রুট আছে। কোথাও অটো রয়েছে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি, কোথাও বা কম। সবই পুনর্বিন্যাস করা হবে। কেএমএ-র যে-সব গ্রামীণ এলাকায় অটো রুট নেই, সেখানেও অটো রুট চালু করার কথা ভাবা হচ্ছে।