—ফাইল চিত্র
রজ্জুতে সর্পভ্রম। রাস্তায় এক খণ্ড দড়ি পড়ে থাকতে দেখলেও মনে হচ্ছে বিষধর সাপ। বুক কেঁপে উঠছে। কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ, বলরামপুর থেকে বনগাঁ— সর্বত্র একই ছবি। সর্বত্র বিডিও অফিস চত্বরে লম্বা লাইন সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত।
ডিজিটাল রেশন কার্ড তৈরি তথা সংশোধনের জন্য সময়সীমা ধার্য করেছিল খাদ্য ও সরবরাহ দফতর। কিন্তু বিভ্রান্তি এমন ভাবে আকাশ ছুঁয়েছে যে, সে কর্মসূচি কার্যত পরিণত হয়েছে জাতীয় নাগরিকপঞ্জীতে (এনআরসি) নাম তোলানোর শিবিরে। অসমে এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশিত হওয়ার পরে দেখা গিয়েছে যে, বাদ পড়েছে ১৯ লক্ষ নাম। সেই আতঙ্ক চারিয়ে গিয়েছে বাংলাতেও। এনআরসি যদি এ রাজ্যেও হয়, তা হলে নাম যেন বাদ না পড়ে, নিশ্চিত হতে চাইছেন অনেকেই। ডিজিটাল রেশন কার্ড তৈরি করানোকে এনআরসির সঙ্গে জুড়ে দেখতে শুরু করেছেন এই বঙ্গেরই লক্ষ লক্ষ নাগরিক। নাওয়া-খাওয়া ভুলে লাইনে দাঁড়াচ্ছেন তাঁরা। ব্লকে ব্লকে লাইন এতই দীর্ঘ যে, কার্ড তৈরি তথা সংশোধনের সময়সীমা এক মাস বাড়িয়ে দেওয়ার কথা ঘোষণা করতে হল রাজ্য সরকারকে।
খাদ্যসাথী প্রকল্পের জন্য নতুন ডিজিটাল রেশন কার্ড তৈরির ব্যবস্থা করেছে খাদ্য ও সরবরাহ দফতর। ওই প্রকল্পে অত্যন্ত কম দামে রেশন দোকান থেকে যে সব সামগ্রী মেলে, তা পেতে হলে এ বার থেকে ডিজিটাল রেশন কার্ড লাগবে। প্রকল্পের সুবিধা যাঁদের পাওয়ার কথা, শুধুমাত্র তাঁরাই যাতে পান, তা নিশ্চিত করতেই এই ব্যবস্থা।
খাদ্যসাথী প্রকল্পের জন্য ডিজিটাল রেশন কার্ডের আবেদন করতে পারবেন কারা? দেখে নিন:
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
নতুন ডিজিটাল কার্ডের জন্য আবেদন জমা নেওয়া হচ্ছে। যে সব ডিজিটাল রেশন কার্ডে কোনও ভুল রয়ে গিয়েছে, সেগুলির সংশোধনের আবেদনপত্রও একই সঙ্গে নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বাংলার নানা প্রান্তে গুজব রটে গিয়েছে যে, এই ডিজিটাল রেশন কার্ড করানোর মাধ্যমে আসলে এনআরসি তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেল। তড়িঘড়ি কার্ড করিয়ে রাখতে না পারলে পরে এনআরসি-তে নাম উঠবে না— জেলা শহর থেকে মহকুমা, ব্লক সদর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত এই বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। ফলে আর সব কাজ ভুলে দলে দলে কার্ডের লাইনে দাঁড়াতে শুরু করেছেন লোকজন।
ব্লকে ব্লকে খাদ্য ও সরবরাহ দফতরের অফিস সাধারণত বিডিও অফিসের সঙ্গেই থাকে। তাই বিডিও অফিসগুলিতেই কার্ড করানোর লাইন পড়েছে। পুর এলাকাগুলিতে পুরসভার দফতরেও আবেদনপত্র জমা নেওয়া হচ্ছে। ছুটির দিন বাদে অন্য সব দিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কাজ চলছে। ৯ সেপ্টেম্বর থেকে এই কাজ শুরু হয়েছিল। চলার কথা ছিল ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। কিন্তু ডিজিটাল রেশন কার্ডের জন্য আবেদনপত্র জমা দেওয়ার লাইন রোজ দীর্ঘ হচ্ছে এবং রোজই সময় শেষ হয়ে যাওয়ায় অনেকেই, বাড়ি ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন আবেদন জমা না দিয়েই। ২৭ সেপ্টেম্বরের মধ্যে যে সবার আবেদন জমা নেওয়া সম্ভব নয়, তা বুঝে গিয়েছিল প্রশাসন। অতএব সময়সীমা বাড়ানোর কথাও ঘোষণা করা হল।
খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক গতকালই জানিয়েছিলেন যে ডিজিটাল রেশন কার্ডের জন্য আবেদনপত্র জমা নেওয়ার সময়সীমা বাড়ানো হবে। কত দিন বাড়ানো হবে, তা তিনি বলেননি। সেই ঘোষণা বুধবার করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জানালেন, আরও একমাস বাড়ছে সময়সীমা।
চলতি মাসের ২৭ তারিখ পর্যন্ত আবেদন জমা নেওয়া হবে। ২৮ তারিখ মহালয়া। তার পরের দিন রবিবার। তার পর থেকেই শুরু হয়ে যাচ্ছে পুজোর সপ্তাহ। তাই ৪ নভেম্বর পর্যন্ত কাজ বন্ধ থাকবে। ৫ নভেম্বর থেকে আবার আবেদনপত্র জমা নেওয়া শুরু হবে।
সময়সীমা বাড়িয়ে সবার আবেদনপত্র জমা নেওয়ার ব্যবস্থা করা খুব একটা কঠিন নয়। বলছেন খাদ্য ও সরবরাহ দফতরের কর্তারা। ডিজিটাল রেশন কার্ড করানোর প্রক্রিয়া আসলে এনআরসি-র অঙ্গ বলে যে গুজব রটেছে, প্রশাসন আসলে চিন্তিত তা নিয়েই। প্রশাসনিক কর্তারা বার বার এলাকায় এলাকায় এই বিভ্রান্তি কাটানোর চেষ্টা করেছেন। মুখ্যমন্ত্রী নিজেও স্পষ্ট ভাবেই জানিয়েছেন যে, ডিজিটাল রেশন কার্ড তৈরির সঙ্গে এনআরসি-র কোনও সম্পর্ক নেই। এমনকী এ রাজ্যে এনআরসি হতে দেবেন না, এমন কথাও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জোর দিয়ে বলেছেন একাধিক মঞ্চ থেকে। কিন্তু গুজবের আগুন যে নেভেনি, তা এখনও স্পষ্ট। সময়সীমা বাড়িয়ে সকলের জন্য ডিজিটাল রেশন কার্ড তৈরির ব্যবস্থা যে হেতু হচ্ছে, সে হেতু আতঙ্ক কিছুটা কমতে পারে বলে প্রশাসনিক কর্তারা আশা করছেন।