শ্মশান-সিঙ্গুর/২

কারখানায় কাজ করুক ছেলে, চান সম্পন্ন চাষিও

পরিবর্তনের পাঁচ বছর পার। কেমন আছে শিল্প-শ্মশান সিঙ্গুর? যে সিঙ্গুর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিরোধী নেত্রী থেকে মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে পৌঁছে দিয়েছে, আর একটা বিধানসভা ভোটের আগে তার হাল-হকিকতের খোঁজ নিল আনন্দবাজার।দশ বছরে সিঙ্গুরের জুলকিয়া খাল দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। কিন্তু চাষ করে সেখানকার চাষিদের অবস্থা পাল্টাল কই! বহুমুখী হিমঘরের ঝাঁপ বন্ধ বহু দিন।

Advertisement

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়

সিঙ্গুর শেষ আপডেট: ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৪:০৬
Share:

কিসান-ভিশান প্রকল্পে বন্ধ দোকান। ছবি: দীপঙ্কর দে

চাষের স্বার্থে শিল্প বিদায়। কিন্তু চাষেরই বা কী হল?

Advertisement

দশ বছরে সিঙ্গুরের জুলকিয়া খাল দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। কিন্তু চাষ করে সেখানকার চাষিদের অবস্থা পাল্টাল কই!

বহুমুখী হিমঘরের ঝাঁপ বন্ধ বহু দিন।

Advertisement

‘কিসান-ভিশান’ প্রকল্পে কৃষিজাত পণ্য নয়, বিক্রি হয় চা-বিস্কুট, ফুলুরি, ঝুটো গয়না... আরও কত কী!

কিসান মান্ডি হয়েছে নাম-কা-ওয়াস্তে। মুখ ফিরিয়ে রয়েছেন চাষিরা।

আর চাষ? কোনও বার চাষিদের ধান ফলিয়ে ভুগতে হচ্ছে, তো কোনও বার আলু। কখনও পাটে দাম মিলছে না, কখনও আবার সব্জির উৎপাদন হচ্ছে কম। আধুনিক কৃষি-প্রযুক্তিতে চাষ কাকে বলে, এখনও জানেন না এখানকার বহু চাষিই। সাবেক পদ্ধতির চাষেই ঘুরপাক খাচ্ছেন তাঁরা।

এখানকার জমি বহুফসলি। বাসিন্দাদের বেশির ভাগই কৃষিজীবী। তাই দশ বছর আগে এখানকার প্রায় ১২ হাজার হেক্টর চাষজমির মধ্যে বামফ্রন্ট সরকার যখন টাটাদের মোটরগাড়ি কারখানার জন্য ৯৯৭ একর জমি অধিগ্রহণ করেছিল, তাঁদের একাংশ প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। কৃষিজমি বাঁচাতে আসরে নেমে পড়েছিলেন তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁকে ভরসা করেছিলেন চাষিরা। কারখানা না করেও শুধু কৃষিকাজের উপরে ভরসা করে যে এলাকার উন্নয়ন হতে পারে, তা চাষিদের বুঝিয়েছিলেন মমতার দলের নেতানেত্রীরা।

সিঙ্গুর-আন্দোলন মমতাকে মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে পৌঁছে দিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী হয়ে মমতা একাধিকবার দাবি করেছেন, ‘পাহাড় হাসছে, জঙ্গলমহল হাসছে’। কিন্তু ‘সিঙ্গুর হাসছে’, এমন দাবি করার মতো সাহস এখনও দেখাতে পারেননি মমতা। কারণ, প্রতিশ্রুতি মতো এখনও তিনি ‘অনিচ্ছুক’দের জমি ফিরিয়ে দিতে পারেননি। কিন্তু এর বাইরে সিঙ্গুরে আরও যে সব সাধারণ চাষি রয়ে গেলেন, তাঁদের অবস্থারই বা কতটা পরিবর্তন হল?

সিঙ্গুর-আন্দোলন যখন তুঙ্গে, মমতা তখন রেলমন্ত্রী। সব্জি এবং কৃষিজাত পণ্য সংরক্ষণের জন্য পাঁচ কোটি টাকা খরচ করে সিঙ্গুর স্টেশনের কাছে রেলের তরফে ২০১০ সালে গড়া হয় বহুমুখী হিমঘর। পরীক্ষামূলক ভাবে ক’দিন সেখানে সব্জি, ফলমূল রাখা হল। তার পরে অজানা
কারণে তালা পড়ে গেল। চাষিদের আক্ষেপ, হিমঘরটির সুবিধা থেকে তাঁরা বঞ্চিত হলেন।

এর সঙ্গেই আসে ‘কিসান-ভিশান’ প্রকল্পের কথাও। এটিও রেলের প্রকল্প। প্রাথমিক ভাবে পরিকল্পনা ছিল এখানকার ১৬টি দোকানঘর থেকে কৃষিজাত সব্জি ও পণ্য বিক্রি হবে। কিন্তু সেখানে অন্য জিনিসই বেশি বিক্রি হয়। সব দোকান চালুও হয়নি। তাপসী মালিকের বাবা মনোরঞ্জন মালিক ‘কিসান-ভিশানে’ দোকান পেয়ে এখন ঝুটো গয়না বিক্রি করেন। আর মুখ্যমন্ত্রীর স্বপ্নের প্রকল্প কিসান মান্ডি তৈরি হয়ে পড়ে রয়েছে। সাড়া নেই চাষিদের।

কৃষি দফতরের এক কর্তা জানান, ধান চাষের ক্ষেত্রে ‘শ্রী’ (সিস্টেম অব রাইস ইনটেন্সিফিকেশন), ‘ড্রাম-সিডার’ বা ‘জিরো টিলেজ’ পদ্ধতির কথা জানেনই না এখানকার বহু চাষি। কী ভাবে কম জলে এবং কম সময়ে চাষ (শ্রী পদ্ধতি) করা যায়, কী ভাবে বীজতলা তৈরি না করে সরাসরি যন্ত্রের সাহায্যে কাদাজমিতে ধানবীজ ফেলা যায় (ড্রাম-সিডার পদ্ধতি) বা কী ভাবে বীজতলা তৈরি না করেই সরাসরি কর্ষণহীন জমিতে যন্ত্রের সাহায্যে ধান বপন করা যায় (জিরো টিলেজ), সেই কৌশল চাষিদের কাছে অধরাই। অথচ, কৃষি দফতরেরই হিসেবে, সাবেক পদ্ধতিতে চাষে বিঘাপিছু যেখানে ২-৩ হাজার টাকা পর্যন্ত লাভ থাকে, সেখানে ওই তিন পদ্ধতিতে বিঘাপিছু লাভের অঙ্ক ৯-১০ হাজার টাকা। তা হলে কেন চাষিরা নতুন পদ্ধতির চাষে যাচ্ছেন না? কৃষি দফতরের পর্যবেক্ষণ, যে সব খেতমজুর কাজ করবেন, নতুন পদ্ধতি গ্রহণে তাঁদের অনীহা রয়েছে। চাষিদের আবার অভিযোগ, এ নিয়ে প্রচারেও ঘাটতি রয়েছে।

আলু চাষে রাজ্যের নানা প্রান্তে যন্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে। অথচ হুগলির অন্যতম আলু উৎপাদক ব্লকে সেই যন্ত্রের ব্যবহারই নেই। কৃষি দফতর দাবি করছে, তারা চেষ্টা করছে। কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টাচ্ছে না। চাষিরা অবশ্য বলছেন, তাঁদের কাছে এ সব কথা বলতে আসেন না কেউই। গত বছরই আলু ফলিয়ে সঙ্কটে পড়তে হয়েছিল সিঙ্গুরের চাষিদের। মাঠের পর মাঠ আলু পড়ে ছিল। বিজেপি নেতারা পরিস্থিতি দেখতে গেলে তাঁদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চাষিরা দাবি তুলেছিলেন, ‘‘টাটাকে ফিরিয়ে আনুন। আলু চাষ করে আমরা ঋণে জর্জরিত। শিল্প হলে পরিস্থিতির বদল হবে।’’

চাষ যে এখন আর সিঙ্গুরে লাভজনক নয়, তা দেরিতে হলেও বুঝছেন অনেক চাষি। তাঁরা মনে করছেন, শুধু চাষকে আঁকড়ে থাকতে পারবে না তাঁদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। যেমন, গোপালনগরের ঘোষপাড়ার গোপাল ঘোষ। বংশানুক্রমিক ভাবে তাঁরা সম্পন্ন চাষি। ছেলেকে চাষাবাদে যুক্তও করতে চান না গোপালবাবু। তাঁর কথায়, ‘‘জমি আছে তো কী! ছেলেকে তো প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। চাষ করে ও কী করবে! কোনও বার বেশি ফলন হচ্ছে, কোনও বার কম। এত অনিশ্চয়তার মধ্যে ওকে ফেলব কেন?’’ আর এক চাষি হেমন্ত ঘোষ বলেন, ‘‘আমার যা গিয়েছে, গিয়েছে। টাকাটা যদি কোনও ভাবে পেয়ে যাই বাঁচি। ছেলেকে কোনও দিনই চাষ করতে বলব না। ও কল-কারখানায় কাজ করুক। না হলে আমার মতো মাঝেমধ্যেই ওকে পেটে কিল মেরে থাকতে হবে। সেটা চাই না।’’

(শেষ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement