শেষযাত্রায় ব্রাত্য রইল সিপিএমের পতাকা। —নিজস্ব চিত্র।
পরিবার রাজি হল না। অতএব সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের দেহ আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে নিয়ে যাওয়ার কোনও চেষ্টাই হল না কোনও তরফ থেকে। মরদেহে সিপিএমের পতাকা রাখার প্রস্তাব অবশ্য এসেছিল। কিন্তু সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের পরিজনরা মুখের উপরে ‘না’ বলে দিয়েছেন তাতেও। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা চত্বরে সোমবার গান স্যালুটে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে শেষ বিদায় জানানোর কর্মসূচির ফাঁকে তাঁর মেয়ে অনুশীলা বসু নিজেই জানালেন এই প্রত্যাখ্যানের কথা।
২০০৮ সালের ২৩ জুলাই সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে বহিষ্কার করে সিপিএম। লোকসভার স্পিকার পদে থাকাকালীন প্রকাশ কারাতের অঙ্গুলি নির্দেশ না মেনে সাংবিধানিক দায়বদ্ধতায় অটল থাকার সিদ্ধান্ত নেন সোমনাথ। তার জেরেই বহিষ্কার। সিপিএমের সেই সিদ্ধান্তকে যে চূড়ান্ত অপমান হিসেবেই দেখেছিল সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের গোটা পরিবার এবং সে অপমান যে পরিবার এখনও ভোলেনি, তা স্পষ্ট হয়ে গেল প্রয়াত নেতার মেয়ের মন্তব্যে।
কোনও রাখঢাক করলেন না সোমনাথের মেয়ে অনুশীলা। বললেন, ‘‘বাবা কষ্ট পেয়েছিলেন সিপিএমের ওই সিদ্ধান্তে।’’ স্মৃতিতে ফিরে গিয়ে তিনি জানালেন, মনমোহন সরকারের উপর থেকে বামেদের সমর্থন প্রত্যাহারের পরে যে টানাপড়েন তৈরি হয়েছিল, সে সময়ে তিনি নিজেও দিল্লিতেই ছিলেন। অনুশীলা বললেন, ‘‘আমরা খুব টেনশনে ছিলাম। আমার স্বামী আমাকে বলেছিলেন, তোমরা টেনশন কেন করছ? উনি (সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়) সংবিধানটা গুলে খেয়েছেন। উনি একজন সৎ মানুষ। উনি এমন কোনও সিদ্ধান্ত নেবেন না, যা ঠিক নয়।’’
দেখুন ভিডিয়ো
সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় সে দিন যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তাতে জ্যোতি বসুর পূর্ণ সমর্থন ছিল বলেও অনুশীলা বসু সোমবার জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘আমি জোর দিয়েই বলছি, বাবার সিদ্ধান্তে জ্যোতি বসুর সমর্থন ছিল। জ্যোতি বসুকে দেখেই তো বাবা দলে এসেছিলেন। জ্যোতি বসু, প্রমোদ দাশগুপ্ত, স্নেহাংশু আচার্য— এঁরাই তো বাবাকে এই দিকে (সিপিএমে) নিয়ে এসেছিলেন। জ্যোতি বসুর স্থানটা বাবার কাছে সব সময় অন্য রকমই ছিল।’’
সোমনাথ-কন্যার এই বয়ানের সঙ্গে হুবহু মিলে গিয়েছে এককালের দাপুটে সিপিএম নেতা তথা রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়ের কথাও। ইংরেজি সংবাদমাধ্যমে কান্তি গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘আমি এখনও সেই দিনটা মনে করতে পারছি, যে দিন তাঁকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। আমি দিল্লিতে তাঁর বাড়িতেই ছিলাম এবং তিনি আমাকে বলেছিলেন— কান্তি, আজকের দিনটা আমার জীবনে সবচেয়ে দুঃখের দিন।’’ কান্তি গঙ্গোপাধ্যায় জানিয়েছেন, সিপিএম থেকে বহিষ্কৃত হয়ে পিতৃবিয়োগের চেয়েও বেশি যন্ত্রণা পেয়েছিলেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। ‘‘আমি স্পিকার হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করেছি। চেয়ারে থেকে আমি পক্ষপাতিত্ব করতে পারি না, কিন্তু আমার দল আমাকে বার করে দিল।’’
আরও পড়ুন: দ্বিধাথরথর সিপিএম, পলিটব্যুরোর শোকবার্তা এল ৫ ঘণ্টা পর
সোমনাথের সিদ্ধান্তে জ্যোতি বসুর সমর্থন প্রসঙ্গে যা বলেছেন অনুশীলা, সেই একই কথা শোনা গিয়েছে কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছ থেকেও। তিনি জানিয়েছেন যে, বহিষ্কৃত হওয়ার পরে জ্যোতি বসুর সঙ্গে দেখা করেছিলেন সোমনাথ। সে দিন সোমনাথকে একটি চিঠি দেখিয়েছিলেন জ্যোতি বসু, যে চিঠি সিপিএম পলিটব্যুরোর বৈঠকে পেশ হওয়ার কথা ছিল। কান্তি জানিয়েছেন, দুর্ভাগ্যজনক ভাবে জ্যোতি বসুর সে চিঠি আর পেশ হয়নি। কান্তি আরও বলেছেন, ‘‘পরবর্তী কালে চিঠির বিষয়বস্তু আমি জানতে পেরেছিলাম। স্পিকার পদ থেকে ইস্তফা না দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় নিয়েছিলেন, তাকে সমর্থন করেই জ্যোতি বসু সে দিন ওই চিঠি লিখেছিলেন।’’
সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের দেহ আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে সিপিএমের রাজ্য দফতরে নিয়ে যাওয়ার কোনও প্রস্তাব কি এসেছিল? অনুশীলা বললেন, ‘‘দেহ পার্টি অফিসে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব আসেনি। তবে দেহে দলীয় পতাকা দেওয়ার কথা হচ্ছিল। আমরা রাজি হইনি।’’ শুধু মেয়েই নন, ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন ছেলে প্রতাপ চট্টোপাধ্যায়। বিমান বসু সোমনাথবাবুকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এলে তাঁকে চলেও যেতে বলেন প্রতাপ চট্টোপাধ্যায়। যদিও এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে বিষয়টি নিয়ে তেমন কিছু বলতে চাননি বিমান বসু।
সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের পরিবারের তরফ থেকে এই রকম মন্তব্য যে সিপিএমের তরফে যথেষ্ট অস্বস্তিকর, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। রাজ্য বিধানসভায় বামফ্রন্ট পরিষদীয় দলের নেতা সুজন চক্রবর্তী সে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে এ দিন অস্বস্তি ঢাকারই চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘সব ক্ষেত্রেই আমরা পরিবারের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিই যে, দেহ দলীয় কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হবে কি না। এ ক্ষেত্রেও পরিবারের সঙ্গে কথা বলেই যা হওয়ার হয়েছে।’’ তবে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের প্রতি দলের শ্রদ্ধা কতটা, তা বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন সুজন। বলেছেন, ‘‘ওঁর মৃত্যুতে শোক জানাতেই আজ সিপিএমের রাজ্য কমিটির সভা স্থগিত করা হয়েছে। তাঁর প্রতি আমাদের পূর্ণ শ্রদ্ধা রয়েছে বলেই এটা করা হয়েছে।’’
আরও পড়ুন: দলের নির্দেশ অমান্য করেছিলেন সংসদীয় দায়িত্ববোধ থেকেই
সুজনবাবু এ কথা বললেও নিজেদের অবস্থানেই অনড় থেকেছেন অনুশীলা। দলের প্রতি সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের টান ঠিক কতটা ছিল, এ দিন কথায় কথায় তা-ও ব্যাখ্যা করেছেন সোমনাথ-কন্যা। তিনি জানিয়েছেন, বহিষ্কৃত হওয়ার খবর পাওয়ার পরে কী ভাবে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের চোখ থেকে জল পড়তে দেখেছিলেন তিনি। সিপিএম সোমনাথকে বহিষ্কার করার পরে বেশ কয়েক দিন ধরে অন্যান্য দল থেকে কত রকমের বিরাট বিরাট প্রস্তাব এসেছিল এবং সোমনাথ কী ভাবে সমস্ত প্রস্তাবে ‘না’ বলেছিলেন, তা-ও অনুশীলা জানিয়েছেন। তবে মেয়ের ব্যাখ্যা: ‘‘এখন মনে হচ্ছে, যা হয়েছিল, ভালই হয়েছিল। পার্টিতে থেকে বাবা পার্টির এই করুণ অবস্থা সহ্য করতে পারতেন না।’’