বিজেপির নির্বাচনী এজেন্ট অভিলাষ শাহকে মারধর। শনিবার বিধাননগর পুরসভায় বিদ্যাধরী প্রাথমিক স্কুলের সামনে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
সাত বছর আগের পুনরাবৃত্তি হল না বিধাননগরের পুর নির্বাচনে। শনিবার ভোট মোটের উপরে শান্তিপূর্ণই হয়েছে। কিন্তু পুরোপুরি স্বচ্ছ নির্বাচন কি হয়েছে? এ দিন দিনভর বিরোধী দল এবং সল্টলেকের নাগরিকদের একাংশ যে অভিযোগ করেছেন, তার জেরেই কিছু প্রশ্ন উঠেছে। ফিরে এসেছে ভুয়ো ভোট এবং ‘বহিরাগত’ অভিযোগও। প্রয়াত সঙ্গীতশিল্পী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের ভোট এ দিন পড়েছে বলে খবর। অন্য একটি জায়গায় প্রাক্তন পুলিশকর্তার নামে ভোট দিতে গিয়ে আটকে যান এক যুবক। তবে পুলিশের নাগাল ‘এড়িয়ে’ সেই যুবক চম্পট দেন।
এ দিন পুলিশ এবং রাজ্য নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। নাগরিকদের একাংশের অভিযোগ, পথেঘাটে কিংবা বুথে পুলিশ ছিল বটে। কিন্তু ‘সক্রিয়তা’ সে ভাবে চোখে পড়েনি। কমিশনের প্রতিনিধিদেরও দেখা যায়নি বলে অভিযোগ।
২০১৫ সালে বিধাননগরের পুরভোটে লাগামছাড়া হিংসা হয়েছিল। বহিরাগত এবং দুষ্কৃতীদের হাতে নিগৃহীত হয়েছিলেন বিরোধী দলের নেতা, নাগরিক এবং সাংবাদিকেরা। সে বারও পুলিশকে কার্যত নিষ্ক্রিয় থাকতে দেখা গিয়েছিল। এ বার ভোটের আগে সেই প্রসঙ্গ উত্থাপন করেই কেন্দ্রীয় বাহিনীর দাবিতে হাই কোর্টে মামলা করেছিল বিজেপি। কোর্ট কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে সরাসরি নির্দেশ না দিলেও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করার ব্যাপারে দায়বদ্ধ করে রাজ্য নির্বাচন কমিশনারকে।
এ দিন ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে ‘ভুয়ো’ ভোটারদের সঙ্গে যেন লুকোচুরি খেলেছেন বিজেপি প্রার্থী দেবাশিস জানা। একটি ভোট কেন্দ্রে শৌচাগারে লুকিয়ে ছিলেন দুই যুবক। তাঁরা ওই এলাকার ভোটার নন। ধরা পড়তেই দৌড় পালিয়ে যান তাঁরা। বিজেপি প্রার্থীর অভিযোগ, পুলিশ বহিরাগতদের ধরার কোনও চেষ্টাই করেনি। এ ই ব্লকে আবার ভিড় করেছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের দত্তাবাদের কয়েক জন পরিচিত মুখ। ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে বহিরাগত-অভিযোগ তুলেছেন স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ। বৈশাখী আবাসনের বাসিন্দাদের অনেকের অভিযোগ, বহিরাগতেরা আবাসনে ঢুকে হুমকি দিলেও পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করেনি। তৃণমূল প্রার্থী অনিতা মণ্ডল অবশ্য সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। সিএফ, বিএফ ব্লক থেকেও এই রকম অভিযোগ এসেছে।
৩৭ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূল প্রার্থী মিনু চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে মারধরের অভিযোগ করেছে বিজেপি প্রার্থী প্রমিতা সাহা। তাঁর অভিযোগ, ভুয়ো ভোটার ধরা এবং ভোট লুটের অভিযোগ করায় মিনু তাঁর উপরে চড়াও হন। মিনুও পাল্টা হামলার অভিযোগ করেছেন। ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডে বিদ্যাধরী প্রাথমিক স্কুলে বিজেপি প্রার্থী এবং এজেন্টকে মারধর করে বুথ থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। সেখানে পুলিশ হাজির হওয়ার পরেও ভিড় কমেনি। ৩২ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূল এবং সিপিএমের বচসা হয়েছে।
বাগুইআটি, জ্যাংড়া, হাতিয়াড়ার মতো একাধিক জায়গাতেও বহিরাগতেরা দাপিয়ে বেরিয়েছে বলে অভিযোগ। রাজারহাট-গোপালপুর ও রাজারহাট-নিউ টাউনের মধ্যে বিভিন্ন এলাকায় সকাল থেকেই মোটরবাইক বাহিনী ঘুরে বেড়িয়েছে। তবে পুলিশের সক্রিয়তা সে ভাবে ছিল না। দশদ্রোণের কাছে ৫ নম্বর ওয়ার্ডের একটি বুথে এক যুবক অভিযোগ করেন, তাঁর ভোট পড়ে গিয়েছে। ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাগুইপাড়ায় বুথের বাইরেই ভিড়। পুলিশ সেখানে কার্যত দর্শকের ভূমিকায় ছিল। সেখানে তর্কে জড়ান কংগ্রেস এবং তৃণমূলের প্রার্থী। ১০ নম্বর ওয়ার্ডের ৭১ এবং ৭২ নম্বর বুথে সচিত্র পরিচয়পত্র ছাড়াই ভোট দিতে দেওয়ার অভিযোগ করেছেন সিপিএম প্রার্থী অমরনাথ গুহ। ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ১২ নম্বর বুথের সামনে ভিড় জমেছিল। গোপালপুর অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভিতরে লাইন সামলাচ্ছিলেন কয়েক জন।
সংবাদমাধ্যমকে দেখে তাঁরা ভোটারের লাইনে দাঁড়িয়ে পড়েন।
এ দিন ভোটের পরে বিধাননগরে মহকুমা শাসকের দফতরের বাইরে বিক্ষোভ দেখায় বিজেপি। করুণাময়ীতে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন বামেরা। দুপুরে কমিশনের অফিসের বাইরে কংগ্রেসের বিক্ষোভ হয়েছে। কংগ্রেস নেতা আশুতোষ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বিধাননগরে ভোট লুঠ করেছে শাসক দল। পুলিশ কোনও সহযোগিতা করেনি এবং কমিশন ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে থেকেছে!’’ সিপিএম নেতা রবীন দেবের মন্তব্য, ‘‘ভোটের দিনে অনিয়ম এবং
জালিয়াতির দায় কমিশনকেই নিতে হবে।’’ বহিরাগতদের দিয়ে ভোট করানোর অভিযোগ
করেছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। তাঁদের প্রার্থীরা জাল ভোটার ধরেছেন বলে দাবি করে সুকান্ত বলেন, ‘‘আমরা বাঙালিরা দাবি করি, আমরা ভদ্র, রুচিশীল জাতি। কিন্তু ভোটটা শান্তিপূর্ণ ভাবে করতে পারি না। তা হলে কীসের সংস্কৃতিবান? এই কলঙ্ক রাখব কোথায়?’’ তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এমন নির্বিঘ্ন ভোটের পরেও প্রশ্ন তোলা অর্থহীন। ২০১৫ সালেও দু’একটি গোলমাল হয়েছিল। এ বার তা হয়নি। আসলে বিবোরধীরা প্রচারের আলোয় থাকতে চাইছে।’’