প্রতীকী ছবি।
ডালা হাতে সপারিষদ মন্দিরের পথে এগিয়ে চলেছেন প্রার্থী। পথের ধারে দোকানে বাজছে শ্যামাসঙ্গীত। চেলি, পেঁড়া, জবা ফুলের, মালা, শাঁখা, সিঁদুর, আলতা, ধূপকাঠি দিয়ে সাজানো
ডালা ধরে মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশ করার আগে প্রার্থীর সঙ্গী পাঁচ জন পারিষদ সমস্বরে ধ্বনি তুললেন, ‘‘জয় মা তারা!’’
সারা বছর লাখ লাখ পুণ্যার্থীর আনাগোনা থাকলেও ভোটের তারাপীঠ অন্য রকম। ভিআইপি থেকে ভিভিআইপি—পুজো দেওয়ার লাইনে তখন কত চেনা মুখ! নেতা থেকে অভিনেতা, মন্ত্রী থেকে বিধায়ক বা সাংসদ,—তারা মায়ের আশীর্বাদ নিতে চলে আসেন অনেকেই। সেবায়েতরা জানাচ্ছেন, বিশেষ করে প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পরেই পুজো দেওয়ার হিড়িক পড়ে। তারাপীঠে পুজো দিয়ে প্রচার শুরু করেন বহু প্রার্থী। তা ছাড়া, মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার দিন, মনোনয়নপত্র মায়ের পায়ে ঠেকানোর রেওয়াজও আছে। ভোটের দিন, ফল বেরোনোর দিন, জয়ী হওয়ার পরেও পুজো দেওয়ার রীতি রয়েছে।
এ বারও সেই রীতির ব্যতিক্রম হয়নি। বীরভূমের একাধিক কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থীরা ইতিমধ্যেই পুজো দিয়ে গিয়েছেন। তৃণমূলের রাজ্য নেতারাও আসতে শুরু করেছেন। শনিবার দুপুরে পুজো দেন বরানগরের তৃণমূল প্রার্থী তাপস রায়। মঙ্গলবার পুজো দেন দক্ষিণ হাওড়ার প্রার্থী, বিদায়ী মন্ত্রী অরূপ রায়। কী প্রার্থনা করলেন? অরূপবাবুর কথায়, ‘‘চাইলাম, শান্তি বজায় থাকুক। সকলের অধিকার বজায় থাকুক। বাংলার উন্নয়নের ধারা বজায় থাকুক। সেই সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তারা মা আরও বেশি শক্তি দিন, এটাই প্রার্থনা করেছি।’’
তারাপীঠ মন্দিরের এক সেবায়েত জানালেন, রাজনৈতিক নেতাদের অনেকেই মাহেন্দ্রক্ষণ যোগ খোঁজেন। কেউ বা গুরুদেবের নির্দেশে সময় মেনে পুজো দেন। কেউ আবার অমাবস্যা তিথিতে হোম যজ্ঞ করেন। অনেক ক্ষেত্রে নেতা অন্তপ্রাণ অনুগামী ও ভক্তদের ভিড়ও হয়। অনেকেই সপারিষদ পুজো দিয়ে ভোগ নিবেদন করে প্রসাদ খান।
তারাপীঠের এমন এক পুজো নিয়ে বাম আমলে রাজ্য জুড়ে তুমুল বিতর্ক বেধেছিল। সেই পুজো দিয়েছিলেন প্রাক্তন মন্ত্রী, প্রয়াত সিপিএম নেতা সুভাষ চক্রবর্তী। কমিউনিস্ট নেতার এমন ধর্মাচরণ করা উচিত কি না, তা নিয়ে শোরগোল পড়ে গিয়েছিল। সেবায়েতরা অবশ্য জানাচ্ছেন, সাধারণত ডানপন্থী রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রীদের আনাগোনা বেশি মন্দিরে।
কে নেই তাঁদের মধ্যে? মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বহুবার এসেছেন। বীরভূম জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল মাঝে মাঝেই পুজো দেন। ২০১৪-র পর দেশে বিজেপির উত্থানের পরে অমিত শাহ, জে পি নড্ডার মতো বিজেপি-র শীর্ষ নেতারাও এসেছেন তারাপীঠে। পড়শি রাজ্য থেকে এসেছেন লালুপ্রসাদ যাদবও। কয়েক মাস আগেই সপরিবার পুজো দিয়ে গিয়েছেন ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন।
তারাপীঠ মন্দির সেবায়েত সমিতির সভাপতি তারাময় মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘আমাদের কাছে সকলেই ভক্ত। ভক্তের ফারাক হয় না। মায়ের কাছে অনেকেই নাম গোত্র বলে কারও হয়ে আর্শীবাদ চান। তবে, মন্দির হচ্ছে রাজনীতির ঊর্ধ্বে। তাই এখানে রাজনৈতিক ধ্বনি দেওয়া নিষেধ।’’
তবে দিনবদলের সঙ্গে ধ্বনির বদলও শোনা যাচ্ছে। সেবায়েতরা জানালেন, হালে বিজেপি নেতারা এলে সঙ্গীসাথীরা মন্দির চত্বরে ‘জয় মা তারা’ ধ্বনির সঙ্গে ‘জয় শ্রীরাম’ও বলছেন। সম্প্রতি রামমন্দিরের ভিত পুজোর জন্য হোম যজ্ঞে বিজেপির পতাকা থাকায় তা খুলিয়েও দেন সেবায়েতরা। তারাময়বাবু বলেন, ‘‘কোনও দলীয় পতাকা বা কোনও নেতানেত্রীর ছবি টাঙানো বারণ। নেতানেত্রীদের ছবি নিয়ে ডালা অর্পণেরও অনুমতি নেই।’’ পুজো দিয়ে কার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়, তা ভোটের ফলেই বোঝা যাবে। তবে, করোনার প্রকোপে বিরাট ধাক্কা খাওয়া তারাপীঠের পর্যটন এখন ভোটের হাত ধরে অনেকটাই চাঙ্গা। খুশি মন্দির চত্বরের ব্যবসায়ীরা। এক ব্যবসায়ীর রসিক মন্তব্য, ‘‘মা যাঁর ইচ্ছেই পূরণ করুন, পুজো যত বেশি হবে, আমাদের ইচ্ছে ততই পূরণ হবে!’’