Religious Harmony

মিলল না ভিসা, শেষ দেখা হল না বাবার সঙ্গে, ওয়াজিদ আলির বংশধর ‘বন্দি’ পাকিস্তানে

কলকাতার পার্ক সার্কাসের ওরিয়েন্ট রোয়ের বাড়িটা, আব্বুর স্নেহচ্ছায়া পাগলের মতো টানছিল বড় মেয়েকে। আব্বুর শরীরটা ভাল নেই! আগে আব্বুর সঙ্গে দেখা করা, তার পর বাকি সব!

Advertisement

ঋজু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৬:০২
Share:

বাবা ও মেয়ে। কলকাতায় সদ্যপ্রয়াত সাহাবজাদে মির্জা এবং করাচিতে কন্যা ওয়েকার আরা বেগম।

তাঁর কাছে এটাও নির্বাসন দণ্ড! করাচি থেকে ফোনে কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন কলকাতা কন্যা। সাক্ষাৎ রাজকন্যাও বটে! অওয়ধের শেষ স্বাধীন রাজা ওয়াজিদ আলি শাহের আপন নাতির নাতনি তিনি। কলকাতায় বাবা সাহাবজাদে ওয়াসিফ মির্জা তখন মৃত্যুশয্যায়। করাচির শ্বশুরবাড়ি থেকে জন্মভূমিতে ফিরতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন ওয়েকার আরা বেগম!

Advertisement

দুই ছেলে এবং মেয়ে কানাডায়। করাচিতে ওয়েকার এবং তাঁর স্বামীকে তাঁরা বার বার ডাকছিলেন, এসো কানাডা ঘুরে যাও! কিন্তু কলকাতার পার্ক সার্কাসের ওরিয়েন্ট রোয়ের বাড়িটা, আব্বুর স্নেহচ্ছায়া পাগলের মতো টানছিল বড় মেয়েকে। আব্বুর শরীরটা ভাল নেই! আগে আব্বুর সঙ্গে দেখা করা, তার পর বাকি সব!

কিন্তু নিয়মমাফিক ভিসার আবেদন করাই সার! গত এপ্রিলে আর্জি জানানোর পাঁচ-পাঁচটা মাস পরে পাসপোর্টটুকু ফেরত দেয় ভারতীয় হাই কমিশন। তাতে ভিসার ছাপ নেই। কান্না ভেজা স্বরে ওয়েকার আরা বেগম বলছিলেন, “সেপ্টেম্বর, অক্টোবরে কোভিডের প্রকোপ কম ছিল। তখন ভিসা দিলেও আব্বুকে শেষ দেখা দেখতে পেতাম! আমার এমনই কপাল নিজের বাবাকে.....!”

Advertisement

গত ২৫ জানুয়ারি প্রয়াত হয়েছেন ৮৭ বছর বয়সি সাহাবজাদে ওয়াসিফ মির্জা। ওয়াজিদ আলি শাহ এবং তাঁর অন্যতম স্ত্রী আখলিল আরা মুমতাজ মহলের পুত্র মির্জা মহম্মদ বাবর সাবেক কলকাতার দরদি ডাক্তারবাবু। তাঁর পুত্র গাজানফর মির্জার বড় ছেলে সাহাবজাদে। লখনউ থেকে কলকাতায় নির্বাসিত অওয়ধের রাজা ওয়াজিদ আলি শাহ পরে লখনউয়ে ফেরার সুযোগ পেয়েও ফিরতে চাননি। গজল, ঠুমরি, কত্থক কিংবা হোলির গান, নাটকের মহিমায় মেটিয়াবুরুজেই গড়ে তুলেছিলেন নতুন লখনউ। তাঁর বিভিন্ন স্ত্রীর সন্তানসন্ততির বংশধরেরা এখন সারা দুনিয়ায় ডালপালা মেলেছেন।

দেশভাগ বা ১৯৬৪-র গোষ্ঠী অশান্তির আবহে সাহাবজাদের বাবাও স্রোতের উল্টো পথে কলকাতায় থেকে যান। আত্মীয়স্বজনেরা অনেকেই অন্যত্র চলে যাচ্ছিলেন। মহমেডান স্পোর্টিং ক্লাব এবং ভারতীয় ক্রিকেট দলের অন্ধ ভক্ত সাহাবজাদে তা ভাবতে পারেননি।

তাঁর কন্যা ওয়েকারের শ্বশুরবাড়িও আদতে কলকাতার। ১৯৬৪-র গোলমালের দিনে ওঁরা প্রথমে পুব পাকিস্তান, পরে ১৯৭১-এ করাচিতে চলে যান। ১৯৮৩-তে বিয়ে হয় ওয়েকারের। এর পরেও কয়েক বার কলকাতায় এসেছেন তিনি। শেষ আসা ২০১৬-য়! কিন্তু ভিসা নিয়ে ভারতে ঢুকতে এমন অসম্ভবের দেওয়াল আগে কখনওই দেখেননি। “কাগজে-কলমে পাকিস্তানি হলেও আমি কিন্তু মনেপ্রাণে ভারতীয়। এখন মনে হয়, করাচিতে খাঁচায় বন্দি আছি। কলকাতায় জন্ম, ইস্কুল, ছোটবেলা…! মনে মনে আমি রোজই কলকাতায় ঘুরে আসি”, ফোনে আনন্দবাজারকে বলছিলেন প্র্যাট মেমোরিয়ালের স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রী ওয়েকার।

ঠিক এখনই কলকাতার সিন্ধি পঞ্চায়েত হলে সাহাবজাদে মির্জার স্মরণসভায় প্রার্থনা করছেন রামকৃষ্ণ মিশনের আলমবাজার মঠের সন্ন্যাসী থেকে পাদ্রী, মৌলানা বা শিখ, পার্সি, বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিনিধি সুহৃদবর্গ। দিদি আসতে না-পারার কষ্টে তাঁর সহোদর ভাই শেহেনশাহ মির্জাও মুখর। তাঁর কথায়, “আজকের ভারতে ওয়াজিদ আলি শাহের সব ধর্মকে গ্রহণের আদর্শ রোজই প্রাসঙ্গিক। আমার বাবার কাছেও ইদ, দুর্গোৎসবে ফারাক ছিল না। অন্য ধর্মের নিন্দা সহ্য করতে পারতেন না। তাঁর মৃত্যুও দ্বিজাতি তত্ত্বের আঁচ থেকে রেহাই পেল না।” রবিবার, মৃত পিতার স্মরণে কলকাতার প্রাচীন বিবি আনারো ইমামবাড়ার ধর্মীয় মজলিসেও ওয়েকার আসতে পারবেন না। তিনি বলছিলেন, “এখন মনে হয়, দেশভাগের নামে আমরা আসলে মানুষ এবং সম্পর্কগুলোই ভাগ করেছি। আরও কত পরিবার একই কষ্ট পাচ্ছে।” ওয়াজিদ আলি শাহের সর্ব ধর্ম সহিষ্ণুতার আদর্শই যেন দ্বিখণ্ডিত এই উপমহাদেশে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement