দু’টোই খারাপ। তার মধ্যে তুলনায় যেটা কম খারাপ, সেটাই আজ বেছে নিতে হল সুপ্রিম কোর্টকে। আর তাতেই বাঞ্ছা পূরণ হল রাজ্য সরকারের! সাত পুরসভা এলাকায় ভোট হচ্ছে না ডিসেম্বরের আগে। সুপ্রিম কোর্ট আজ নির্দেশ দিয়েছে, তিনটি পুর নিগমের সঙ্গে ওই পুরসভাগুলিকে জুড়ে দেওয়ার পরেই হবে ভোট। অর্থাৎ রাজ্য সরকার যা চেয়েছিল, সেটাই হল। রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায় জানিয়ে দিয়েছেন, পুরসভাগুলির পুনর্বিন্যাস সংক্রান্ত কাজকর্ম শেষ করে ৩০ নভেম্বরের আগে ভোট করানো সম্ভব নয়।
নিট ফল দাঁড়াল এই যে, আলাদা ভাবে বালি, কুলটি, রানিগঞ্জ, জামুড়িয়া, আসানসোল, বিধাননগর, রাজারহাট-গোপালপুর কিংবা বালি পুরসভার নির্বাচন হবে না আর। বালি পুরসভা ঢুকে যাচ্ছে হাওড়া পুর নিগমের ভিতরে। বিধাননগর ও রাজারহাট-গোপালপুর মিলে একটি পৃথক পুর নিগম হচ্ছে। আর কুলটি, রানিগঞ্জ, জামুড়িয়া মিশে যাচ্ছে আসানসোল পুর নিগমের সঙ্গে। এবং এই গোটা প্রক্রিয়ার শেষে পুর নিগমগুলির ভোট না হওয়া পর্যন্ত সাতটি পুরসভা এলাকার মানুষ নির্বাচিত পুর প্রতিনিধি পাবেন না। এটা অবশ্যই খারাপ। কারণ, রাজ্য সরকারের বসানো প্রশাসকই কাজ চালাবেন। তাতে পুর পরিষেবা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা থাকছেই।
হাইকোর্ট গত ১৬ এপ্রিল নির্দেশ দিয়েছিল, ১৬ জুনের মধ্যে বকেয়া ভোট সারতে হবে সাত পুরসভায়। কিন্তু হাইকোর্টের নির্দেশ মেনে এখনই যদি ওই সাত পুরসভায় ভোট করানো হয়, তবে পুর নিগমের সঙ্গে সংযুক্তির পর্ব মিটলে ক’দিন পরেই ফের ওই সব এলাকায় ভোট করাতে হবে। তাতে রাজস্বের অপচয়। এবং এটাকেই বেশি খারাপ বলে মনে করেছে সুপ্রিম কোর্ট। ফলে সাতটি পুরসভাকে তিনটি পুর নিগমে জুড়ে দেওয়ার পরেই ভোট হোক— রাজ্যের এই আর্জিতেই আজ সিলমোহর দিল শীর্ষ আদালত।
রাজ্য সরকার ও রাজ্য নির্বাচন কমিশনের তরফে সওয়াল শেষে সুপ্রিম কোর্ট আজ জানিয়ে দেয়, পুরসভাগুলির সংযুক্তিকরণের কাজ ৩০ জুনের মধ্যে শেষ করতে হবে। তার পরে রাজ্য নির্বাচন কমিশন সেখানে কী ভাবে দ্রুত নির্বাচন করা যায় তার ব্যবস্থা করবে।
তিন বছর আগে মীরা পাণ্ডের জমানায় পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে দৌড়ে মুখ পুড়েছিল রাজ্যের। পুরভোট নিয়ে মামলায় রাজ্য সরকারের বাঞ্ছাপূরণ হওয়ায় পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম আজ সুপ্রিম কোর্টের রায়কে স্বাগত জানিয়ে বলেন, ‘‘৩০ জুনের মধ্যে তিনটি নিগম গঠনের কাজ সেরে ফেলব। ১ জুলাই নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়ে তা জানাব। এর পরে যাবতীয় দায় কিন্তু রাজ্য নির্বাচন কমিশনের।’’
রাজ্য সরকারকে সংযুক্তিকরণ শেষ করার সময়সীমা বেঁধে দিলেও, কত দিনের মধ্যে ভোট করাতে হবে তার জন্য রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে কোনও সময় নির্দিষ্ট করে দেয়নি সুপ্রিম কোর্ট। কমিশনের আইনজীবী সুপ্রিম কোর্টে জানিয়েছেন, সংযুক্তিকরণের পরে কমিশনের যে সব কাজ করতে হবে তার জন্য ৫-৬ মাস লেগে যেতে পারে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ হাতে পাওয়ার পরে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন কলকাতায় জানিয়ে দেন, ৩০ জুনের মধ্যে সংযুক্তির কাজ শেষহওয়ার পরেও অন্তত ১৪০ দিন লাগবে পুরনিগমগুলিতে ভোট করাতে।
এত দিন সময় কেন লাগবে?
সুশান্তরঞ্জনবাবুর ব্যাখ্যা, পুর নিগমগুলি গঠিত হওয়ার পরে রাজ্য সরকার ঠিক করবে কোথায় ক’টি ওয়ার্ড হবে। সেই সিদ্ধান্ত জানার পরে কমিশন ওই সব নিগমের ওয়ার্ড-সীমানা পুর্নবিন্যাস করার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করবে। সীমানা পুনর্বিন্যাসের জন্য কমপক্ষে ৪৫ দিন সময় লাগবে। সীমানা পুনর্বিন্যাসের চুড়ান্ত বিজ্ঞপ্তি জারির পরে সংরক্ষণ সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি জারি করতে হবে। এই কাজ শেষ করতে কমপক্ষে ১০ সপ্তাহ সময় দিতে হবে। এই সব হিসেব ধরেই ৩০ নভেম্বরের আগে কোনও মতেই ভোট করা সম্ভব নয়।
প্রশ্নটা উঠেছিল আদালতেই। কমিশনের আইনজীবী অনিল দিওয়ানের কাছে বিচারপতি জানতে চান, সংযুক্তিকরণ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হওয়ার পরে কমিশন কবে ভোট করাতে চায়। কলকাতায় ফোনে কমিশনারের সঙ্গে কথা বলে নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ জানাতে বলেছিল আদালত। এ জন্য মামলার শুনানি কিছু ক্ষণ মুলতুবিও রাখা হয়। কিন্তু পরে আবার শুনানি শুরু হলে অনিল দিওয়ান জানান, কোনও নির্দেশ পাওয়া যায়নি। তাই তিনি নিজেই পুর নির্বাচন আইন মেনে কোন কাজে কত সময় লাগবে, তা জানিয়ে দিচ্ছেন। দিওয়ানের কথা শুনে বিচারপতি এ কে সিক্রি এবং উদয় উমেশ ললিত নির্দেশ দেন, রাজ্য সরকার ৩০ জুনের মধ্যে কাজ শেষ করার পর যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন করাবে কমিশন।
কেন সুশান্তরঞ্জন ফোনে আইনজীবীদের কোনও দিনক্ষণ জানিয়ে দিলেন না? তিনি সেই ব্যাখ্যা তাঁদের আইনজীবীকে দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন। তবে সূত্রের খবর, রাজ্য সময় চাইছে বলেই তিনি আর দিনক্ষণ জানাতে চাননি।
এই রায়কে কোনও পক্ষের হার বা জিত হিসেবে দেখছেন না রাজ্য নির্বাচন কমিশনের অন্যতম আইনজীবী পীযূষকান্তি রায়। তাঁর যুক্তি, ‘‘আমরা জানিয়েছি, কমিশন ভোটের জন্য তৈরি। ভোটের বিষয়ে কমিশনই যে শেষ কথা, তা সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট করে দিয়েছে। কমিশন মোটেই রাজ্য সরকারের কাছে মাথা নত করেনি।’’ আজ এজলাসে প্রবীণ আইনজীবী অনিল দিওয়ান জোরালো দাবি তোলেন যে, ভোটের দিনক্ষণ ঠিক করার বিষয়ে কমিশনের প্রাধান্য স্পষ্ট করে দিক সুপ্রিম কোর্ট। বিচারপতিরা সেই দাবি মেনে নেন। এজলাস থেকে বেরিয়ে পীযূষকান্তিকে দিওয়ান বলেন, ‘‘নির্বাচন কমিশনার আজ আদালতে হাজির থাকতে পারতেন। ওঁকে জানিয়ে দিন, ভোটের বিষয়ে তিনিই শেষ কথা।’ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন কেন্দ্রীয় বাহিনী চাইতে পারে বলেও আজ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিকায় বলা হয়েছে। পুরভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী চাওয়ার প্রসঙ্গে কলকাতায় রাজ্য নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘‘রায়ের কপি না দেখে কিছু বলা সম্ভব নয়। তবে যা শুনেছি তা ঠিক হলে বলতে পারি, কেন্দ্রীয় বাহিনী চাওয়ার ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ সাংবিধানিক বৈধতা দিল।’’
কুলটি ও রানিগঞ্জকে আসানসোল পুরসভার সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে এ দিন রানিগঞ্জ-কুলটির স্থানীয় বাসিন্দারা আবেদন করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টে। আবেদনকারীদের আইনজীবী দীপক ভট্টাচার্য দাবি করেন, ওই এলাকাগুলি মোটেই আসানসোলের লাগোয়া নয়। এগুলি আসানসোল পুর নিগমের আওতায় নিয়ে এলে পুর পরিষেবা ধাক্কা খাবে। সেই আর্জি খারিজ হয়েছে এ দিন।
আপাত ভাবে দেখলে এ দিন খারিজ হয়েছে হাইকোর্টের রায়ও। তবে হাইকোর্টের রায়ে ভুল ছিল, এমনও বলেনি সুপ্রিম কোর্ট। হাইকোর্ট ১৬ এপ্রিল বলেছিল, দু’মাসের মধ্যে নির্বাচন শেষ করতে হবে। প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুরের যুক্তি ছিল, রাজ্য কেন সাতটি পুরসভা পুনর্গঠনের কাজ আগে শেষ করেনি। আজ কমিশনের আইনজীবীও সেই একই অভিযোগ তোলেন, সেপ্টেম্বরে পুর নিগম তৈরির নির্দেশ হয়েছিল। সেই নির্দেশ রাজ্য পালন করেনি। ডিসেম্বরের বদলে এপ্রিলে কাজ শুরু করেছে। আসলে ভোট পিছিয়ে দিতে চেয়েছে রাজ্য। সিব্বল যুক্তি দেন, ৯২টি পুরসভায় ভোট হয়েছে।’’ দু’পক্ষের সওয়াল শুনে বিচারপতিরা তাঁদের নির্দেশে বলেন, হাইকোর্ট ঠিকই বলেছিল। রাজ্য সরকার শেষবেলায় পুরসভা পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেছে।
রাজ্য সরকারের আইনজীবী কপিল সিব্বল যুক্তি দেন, ‘‘এখন ভোট হলে নতুন পুর নিগম তৈরির পর ফের ভোট করতে হবে। তাই এক বারে ভোট হোক।’’ দিওয়ান জানতে চান, মাঝের ৬ থেকে ৯ মাস কী ভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধি ছাড়াই পুরসভাগুলি চলবে? সিব্বল জানান, রাজ্য সরকারই প্রশাসক নিয়োগ করবে। এর সঙ্গে কমিশনের কোর্টে বল ঠেলে দিয়ে সিব্বল বলেন, ‘‘দ্রুত কাজ শেষ করে ভোট করানো কমিশনের কাজ।
দু’পক্ষের যুক্তি শুনে বিচারপতি সিক্রি বলেন, ‘‘এমন একটা সমাধান দরকার যা দু’তরফের জন্যই সমান হয়।’’ বিচারপতি যুক্তি দেন, হাইকোর্টের নির্দেশ মেনে এখনই ভোট করালে কাউন্সিলরদের মেয়াদ হবে মাত্র কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস। তার পরে ফের ভোট করতে হবে। সরকারি কোষাগারের অর্থ নষ্ট হবে। অন্য দিকে, এখন ভোট না হলে নির্বাচিত প্রতিনিধি ছাড়াই পুর নিগমগুলি চলবে। সাতটির মধ্যে যে সব পুরসভার মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছে, সেখানেও প্রশাসক বসিয়েই কাজ চলছে। রায়ের ব্যাখ্যা দিয়ে বিচারপতি সিক্রি তাই এ দিন বলেন, ‘‘এই দু’টি খারাপ জিনিসের মধ্যে কোনটি কম খারাপ সে’টি বেছে নিতে হবে।’’ সাত পুরসভার জন্য ‘কম খারাপ’টাই বরাদ্দ হয়েছে তাই।