দ্বারকেশ্বর নদের বাঁধ উপচে হুগলির গোঘাটের দিঘড়া এলাকায় কালীপুর-বালিদেওয়ানগঞ্জ রোডে জলস্রোত। শনিবার। ছবি: সঞ্জীব ঘোষ
ঘর জলে টইটম্বুর। খাটে শিশুসন্তানকে নিয়ে বসে মা। নীচে সাপ! শুক্রবার রাতে এমনই অভিজ্ঞতার সামনে পড়েছেন পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুর ব্লকের রাজনগর গ্রামের মাম্পি দাস। তাঁর কথায়, ‘‘ঘরে সাপ ঘোরাঘুরি করছে। নামার জো নেই। ওই ভাবেই আতঙ্কে কাটিয়েছি সারা রাত।’’
মাম্পির মতো অভিজ্ঞতা সকলের না হলেও অতিবৃষ্টিতে চরম দুর্ভোগে রাজ্যবাসীর বড় অংশ। শনিবার পরিস্থিতি খতিয়ে দেখেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পরে তাঁর নির্দেশে রাজ্যের মুখ্যসচিব ন’জন জেলাশাসকের সঙ্গে বৈঠক করেন। কারণ, ঝাড়খণ্ডের তেনুঘাট থেকে যে জল ছাড়া হচ্ছে, তাতে চিন্তা বাড়ছে প্রশাসনের। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, পশ্চিম মেদিনীপুর, দুই বর্ধমান, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হাওড়া এবং হুগলিতে এ পর্যন্ত প্রায় ৩৫ হাজার মানুষকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রায় ৩২ হাজার শিবির খোলা হয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। জেলাশাসকদের মুখ্যসচিব জানিয়েছেন, পরিস্থিতির উপর নিয়মিত খেয়াল রাখতে হবে। ত্রাণের ঘাটতি যাতে না থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে।
প্রশাসনের এক কর্তার কথায়, “ঝাড়খণ্ডেও প্রবল বৃষ্টি হয়েছে। ফলে তেনুঘাটের জল ছাড়ায় হাওড়া, হুগলির অনেকটা এলাকা নিয়েচিন্তা রয়েছে। চারটি এনডিআরএফ এবং পাঁচটি এসডিআরএফ দল বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হয়েছে। তেনুঘাটের জল আসতে ৩৬ ঘণ্টা লাগে। এখন প্রায় সব নদীর জলস্তর বিপজ্জনক জায়গায় আছে। ফলে বাড়তি সতর্ক থাকতে হচ্ছে। ঝাড়খণ্ড সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করছে রাজ্য।”
বিভিন্ন জেলায় বিস্তীর্ণ তল্লাট জলবন্দি, বিঘের পর বিঘে চাষজমি জলের তলায়। অসংখ্য কজওয়ে তলিয়ে যাওয়ায় যাতায়াত বন্ধ। আশঙ্কা আরও বাড়াচ্ছে বিভিন্ন ব্যারাজ থেকে ছাড়া জলের পরিমাণ। দুর্গাপুর ব্যারাজ থেকে শনিবার সকাল ৮টা নাগাদ জল ছাড়ার পরিমাণ ছিল, ১ লক্ষ ২৮ হাজার ৭৬৫ কিউসেক। বিকেল ৫টা নাগাদ তা দাঁড়ায় ১ লক্ষ ৩ হাজার কিউসেক। ডিভিসি-র জনসংযোগ আধিকারিক অপূর্ব সাহা জানান, এ দিন সকাল পর্যন্ত মাইথন ও পাঞ্চেত জলাধারে জল এসেছে যথাক্রমে প্রায় ৭৬ হাজার ও ১ লক্ষ ৯৫ হাজার কিউসেক।
দুর্গাপুর ব্যারাজের জলে প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে বাঁকুড়ার বড়জোড়া, সোনামুখী, পাত্রসায়র ও ইন্দাস ব্লকের কিছু এলাকায়। জল ছাড়া হয়েছে কংসাবতী জলাধার থেকেও। ডিভিসি-র ছাড়া জলে আতঙ্কে হাওড়ার উদয়নারায়ণপুরও। সেখানে ওই জল পৌঁছনোর কথা আজ, রবিবার ভোরে। এতে দামোদরের বাঁধ উপচে পাঁচটি পঞ্চায়েত প্লাবিত হতে পারে বলে আশঙ্কা। শনিবারই ১৯টি ত্রাণ শিবির খুলে মানুষজনকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
অবস্থা ভাল নয় হুগলির আরামবাগ মহকুমারও। দ্বারকেশ্বর নদ চরম বিপদসীমা এবং দামোদর নদ এবং মুণ্ডেশ্বরী নদীর জল বিপদসীমা ছাড়িয়েছে। খানাকুলের দুই পঞ্চায়েতে দ্বারকেশ্বরের বাঁধ ভেঙে প্রায় ১২টি গ্রামের মানুষ জলবন্দি। গোঘাটের ৪টি, আরামবাগের ৩টি এবং খানাকুলের দু’টি ব্লকের ৭টি পঞ্চায়েত এলাকা এবং আরামবাগ পুরসভার ৩টি ওয়ার্ড জলমগ্ন হয়েছে।
ঘাটাল, কেশপুর-সহ পশ্চিম মেদিনীপুরের একাংশের এখন জলভাসি দশা। ঘাটালে প্রায় বন্যা পরিস্থিতি। শিলাবতী, কংসাবতী, ঝুমি-সহ সব নদীর জল চরম বিপদসীমার উপরে বইছে। শুক্রবার দাসপুরের নাড়াজোল ও রাজনগরে শিলাবতীর তিনটি বাঁধ ভেঙে জলবন্দি হয়ে পড়েন কয়েক হাজার বাসিন্দা। কয়েক হাজার বাসিন্দাকে শতাধিক ত্রাণ শিবিরে আনা হয়েছে। কংসাবতী জলাধার থেকে ছাড়া জলে পূর্ব মেদিনীপুরের ময়না, পাঁশকুড়া, নন্দকুমার ও কোলাঘাট ব্লকের উপরে বয়ে যাওয়া কাঁসাইয়ের জলস্তর ক্রমশ বাড়ছে।
কুঁয়ে নদীর বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে বীরভূমের লাভপুর ব্লকের হরিপুর, জয়চন্দ্রপুর, চতুর্ভুজপুর, খাঁপুর-সহ প্রায় ১০টি গ্রাম জলমগ্ন। দুর্গত মানুষদের ফ্লাড শেল্টার এবং ত্রাণ শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বাঁকা নদী উপচে বর্ধমান শহরের বিভিন্ন জায়গায় জল জমেছে। নদিয়ায় এ দিন ভাগীরথীর জলস্তর ছিল ৭.৬১ মিটার। বিপদসীমা ৮.৪৪ মিটার।