প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর।
কেনসাল গ্রিন সমাধিক্ষেত্রে যে বাঙালি চিরনিদ্রায় শায়িত, তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন হুগলির তীরে ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লব আনার। ব্রিটিশের দাসত্ব নয়, বরং তাঁদের সহযোগিতায় এ দেশের উন্নতি সম্ভব, এ ছিল তাঁর একান্ত উপলব্ধি। তাই সেকেলে ধর্মান্ধতাকে তুচ্ছ করে বিশ্ব দরবারে বাঙালির শিল্পোদ্যোগী উদ্যোগ প্রতিষ্ঠা করতে কালাপানি পেরিয়ে তিনি পাড়ি দিয়েছিলেন সুদূর বিলেতে। অথচ বাঙালি তাঁকে মনে রেখেছে শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথের ঠাকুর্দা হিসেবে!
তিনি প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। ব্যাঙ্কের সঙ্গে বাঙালির যোগসূত্র গড়ে তোলা থেকে শুরু করে সংবাদপত্রের উন্নতিসাধন বা ভারতে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করতে রেলপথ স্থাপনের স্বপ্ন দেখা— এ সবের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে তাঁর নাম। তাঁর হাত ধরেই জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের বৈভব ও প্রতিপত্তির সূচনা।
যশোহর থেকে ঠাকুর পরিবারের আদিপুরুষ পঞ্চানন কলকাতায় এসেছিলেন। তাঁর উত্তরপুরুষ জয়রামের দুই পুত্র, নীলমণি এবং দর্পনারায়ণ। এই নীলমণিই জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের আদিপুরুষ। নীলমণির পুত্র রামমণি ঠাকুরের সন্তান দ্বারকানাথ। দ্বারকানাথের জন্ম ১৭৯৪ সালে। পরে কাকা রামলোচন তাঁকে দত্তক নেন। তাঁর জীবনে দত্তক মা অলোকাসুন্দরীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। দ্বারকানাথের ছেলেবেলা থেকেই তিনি তার পড়াশোনার বিষয়ে তৎপর থাকতেন। ১৮০৪ নাগাদ তাকে চিৎপুর রোডের শেরবোর্ন সাহেবের স্কুলে ভর্তি করা হয়। দ্বারকানাথ ছিল সাহেবের অন্যতম প্রিয় ছাত্র।
রামলোচনের মৃত্যুর পরে ষোলো বছর বয়সে দ্বারকানাথ তাঁর সম্পত্তির মালিক হন। সম্পত্তি বলতে, কলকাতার জমি-বাড়ি এবং মফসসলের জমিদারি। সেই সময় জমিদারির বার্ষিক আয় ছিল তিরিশ হাজার টাকা। অন্য জমিদারদের থেকে দ্বারকানাথ ছিলেন স্বতন্ত্র। আইনকানুন সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। পরবর্তী কালে তিনি আরও কয়েকটি জমিদারি কিনেছিলেন। দ্বারকানাথের বয়স যখন সতেরো যশোহরের এক পীরালি পরিবারের মেয়ে দ্বিগম্বরীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়।
দ্বারকানাথ ঠাকুর এবং রামমোহন রায় সমসাময়িক এবং বন্ধু হলেও দু’জন দুই প্রান্তের মানুষ ছিলেন। চিন্তাধারায় এবং উদ্যোগে দ্বারকানাথ তাঁর সময়ের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। ব্রাহ্মধর্ম তথা রামমোহনের একেশ্বরবাদী দর্শনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলেও তিনি কখনও নিজের ধর্ম ছাড়েননি। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে তখন প্রতি বছর দুর্গা, কালী এবং জগদ্ধাত্রী পুজো হত। এমনকী, এক সময় দ্বারকানাথ নিজের হাতে কুলদেবতা লক্ষ্মী-জনার্দনের নিত্য সেবা করতেন।
তত্কালীন সাহেবদের কাছে ‘পারফেক্ট প্যারাডাইস’ ছিল এই বেলগাছিয়া ভিলা।
জমিদার হিসেবে দ্বারকানাথ ছিলেন দক্ষ। আজকের প্রেক্ষাপটে অনেকটাই কর্পোরেট মনস্ক। সাহাজাদপুর ও বিরাহিমপুরে জমিদারির দেখভালের জন্য তিনি সে যুগে ইউরোপীয় ম্যানেজার নিয়োগ করেছিলেন। শোনা যায়, প্রজাদের কাছে দ্বারকানাথ ছিলেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ জমিদার এবং কর্মচারীদের কাছে কড়া মনিব। তবে, তিনি ছিলেন উদার প্রকৃতির মানুষ। কেউ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে কিংবা সাহায্য চাইলে ভদ্রতার কোনও ত্রুটি রাখতেন না। দ্বারকানাথের ব্যবসার মধ্যে আফিম, কয়লা, নীল, রেশম, নুন, চিনি এবং জাহাজের ব্যবসা ছিল উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া তিনি ‘কার অ্যান্ড টেগোর কোম্পানি’র আট আনার অংশীদার ছিলেন।
কর্মজীবনের পাশাপাশি দ্বারকানাথ ছিলেন থিয়েটারের পৃষ্ঠপোষক এবং শিল্পরসিক। তাঁর নামের সঙ্গে একটা মিথ হয়ে রয়ে গিয়েছে বেলগাছিয়া ভিলা। তত্কালীন সাহেবদের কাছে এটি ছিল ‘পারফেক্ট প্যারাডাইস’। চার দিকে সবুজ ঘাস বিস্তৃত দ্বিতল বাড়িটির প্রতিটি ঘর ছিল ইউরোপীয় ধাঁচের আসবাবপত্রে সাজানো। এ ছাড়াও সে সময় জোড়াসাঁকোর বৈঠকখানা বাড়িটিও সাজানো ছিল দেওয়াল জোড়া আয়না, কাটগ্লাসের ঝাড়বাতি ও বিদেশি শিল্পীদের আঁকা তৈলচিত্রে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বাংলায় পাবলিক ব্যাঙ্ক ছিল না। আধা সরকারি ব্যাঙ্ক এক অর্থে ছিল সরকারি খাজাঞ্চিখানা। ১৮২৮-এ দ্বারকানাথ সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা করেন। কলকাতায় মেডিক্যাল কলেজ গড়ে তোলার নেপথ্যেও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এ সবের পাশাপাশি, এ দেশে সংবাদমাধ্যম স্থাপন এবং তার উন্নতির জন্য দ্বারকানাথের অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। ১৮২১-এ রামমোহন প্রতিষ্ঠিত সাপ্তাহিক ‘সংবাদ কৌমুদি’র তিনি সম্পাদক ছিলেন। ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘বেঙ্গল হেরল্ড’ এবং বাংলা ‘বঙ্গদূত’ কাগজের সূচনাও হয়েছিল তাঁর হাতে। এ ছাড়া তাঁর অর্থসাহায্যে চলত ‘বেঙ্গল হরকরা’, ‘ইন্ডিয়া গেজেট’, ‘ইংলিশম্যান’ প্রভৃতি সংবাদপত্র।
এই দ্বারকানাথকেই ১৮২৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ‘বোর্ড অব কাস্টমস, সল্ট অ্যান্ড ওপিয়াম’-এর দেওয়ান নিযুক্ত করেছিল। পরের বছর, ১৮২৯ সালে দ্বারকানাথ প্রতিষ্ঠা করলেন ‘ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক’। প্রথম বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক, যা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বা অন্য কোনও বাণিজ্যিক সংস্থার অধীন ছিল না। পরে এই ব্যাঙ্কের অন্যতম ডিরেক্টরও হয়েছিলেন। জাহাজের ব্যবসা-সহ বাংলায় নতুন গড়ে ওঠা ব্যবসায়িক প্রচেষ্টায় দ্বারকানাথের ব্যাঙ্ক ঋণ দিয়ে সাহায্য করত। ব্যবসা ছড়ালেন পত্রপত্রিকার জগতেও।
শোনা যায় তাঁর মা অলোকাসুন্দরীর মৃত্যুর পরে এবং ১৮৩৯ সালে স্ত্রী দ্বিগম্বরী দেবীর মৃত্যুর পরে পারিবারিক বিধিনিষেধের শেষ বন্ধনটুকুও ছিন্ন হয়েছিল। বাগবাজারের রূপচাঁদ পক্ষী ছড়া কেটে লিখেছিলেন, “বেলগাছিয়ার বাগানে হয় ছুরি কাঁটার ঝনঝনি,...মদের কত গুণাগুণ আমরা তার কি জানি? জানেন ঠাকুর কোম্পানী।”
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি।
১৮৪২-এ দ্বারকানাথ তাঁর নিজস্ব জাহাজ ‘ইন্ডিয়া’য় চেপে প্রথম বার বিলেত যান। লন্ডনে থাকাকালীন রানি ভিক্টোরিয়া এবং প্রিন্স অ্যালবার্ট-এর সঙ্গে একাধিক বার সাক্ষাৎ হয়। শোনা যায়, লম্বা, সুভদ্র, সুদর্শন ব্রাহ্মণকে দেখে রানি বেশ অবাক হয়েছিলেন। এই সাক্ষাতের পরে, রানি তাঁর জার্নালে দ্বারকানাথের একটা স্কেচও এঁকেছিলেন। অনেকেই মনে করেন রানির সঙ্গে সাক্ষাতের পরেই লন্ডনের ‘হাই সোসাইটি’তে মেশার প্রবেশাধিকার পেয়েছিলেন দ্বারকানাথ। বিদেশে থাকাকালীন দেশ সম্পর্কে দ্বারকানাথ সচেতন ছিলেন। সংসদে ভারতীয়দের প্রবেশাধিকার নিয়ে প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম এডয়ার্ট গ্ল্যাডস্টোনের সঙ্গে তিনি আলোচনা করেন। লন্ডনেই চার্লস ডিকেন্সের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়।
১৮৪৫-এ শেষ বারের মতো দ্বারকানাথ বিলেতে যান। সে বার সঙ্গে ছিলেন ছোট ছেলে নগেন্দ্রনাথ, ভাগ্নে নবীনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ব্যক্তিগত চিকিৎসক, সেক্রেটারি, সেফ এবং তিন জন সেবক। আর ছিলেন ডাক্তার গুডিভের তত্ত্বাবধানে মেডিক্যাল কলেজের চার বাঙালি শিক্ষানবিশ চিকিৎসক। শল্য চিকিৎসার উন্নতির জন্য সমস্ত খরচাপাতি করে দ্বারকানাথ তাঁদের বিলেতে নিয়ে গিয়েছিলেন।
দ্বারকানাথও বিদেশে থাকাকালীন মাঝেমধ্যেই গণ্যমান্যদের নিমন্ত্রণ করতেন, বহুমূল্য উপহারও দিতেন। তার মধ্যে ভারতীয় শাল ছিল বিশেষ উল্লেখ্য। সে সময় ভারতীয় শাল ছিল চূড়ান্ত বিলাসিতার জিনিস। মজলিস শেষে তাঁরা যখন বিদায় নিচ্ছেন, দ্বারকানাথ তাঁদের প্রত্যেকের কাঁধে একটি করে শাল জড়িয়ে দিয়েছিলেন। রঙিন এই দিনগুলির মাঝে ক্রমেই দ্বারকানাথের শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। কিন্তু কর্মব্যস্ততায় সে দিকে নজর দেওয়ার অবকাশটুকুও হয়তো তিনি পাননি।
এরই মধ্যে ১৮৪৬-এর ১৮ মার্চ দ্বারকানাথ লন্ডন পৌঁছন। ৩০ জুন ডাচেস অফ ইনভেরনেস-এর প্রাসাদে নৈশভোজে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার পর ধীরে ধীরে শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। ১ অগস্ট দ্বারকানাথের মৃত্যু হয় মাত্র ৫১ বছর বয়সে। তাঁর দেহ লন্ডনের ‘কেনসল গ্রিন’ সামাধিক্ষেত্রে রাজকীয় মর্যাদায় সমাধিস্থ করা হয়। কেননা, সে সময় মৃতদেহ দাহ করার প্রচলন লন্ডনে ছিল না। তাঁর মৃত্যুসংবাদ কলকাতা পৌঁছেছিল প্রায় দেড় মাস পরে এক বর্ষণমুখরিত দিনে।
আজ তাঁর ১৭১তম মৃত্যুদিনে কেনসাল গ্রিনে তাঁর সমাধির সামনে এসে কেউ হয়তো দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে একটা গোলাপও রাখেনি। পুষ্পবিহীন সমাধি বেদীটির উপরে ঝরে পড়ে কয়েকটা শুকনো পাতা আর কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি আজ উজাড় করে দিয়েছে অন্তহীন সমবেদনা!
ছবি রবীন্দ্রভারতী প্রদর্শশালার সৌজন্যে ও ফাইল চিত্র।