রোগ ধরেছে সর্বত্র। একশো ষাট বছরের প্রবীণই হোক বা বছর পাঁচেকের নবীন, রোগে কাবু সকলেই। রোগটার নাম লোকাভাব।
প্রয়োজনীয় শিক্ষক, কর্মী-সহ পরিকাঠামোর অভাবে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক নিয়োগ বন্ধ। এবং এই ‘নেই’ রোগটা মোটেই শুধু প্রেসিডেন্সির নয়। সেটা সংক্রমিত হয়েছে রাজ্যের সব বিশ্ববিদ্যালয়েই। প্রাচীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বারাসতের নবীন পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়— বাংলার উচ্চশিক্ষার সব প্রতিষ্ঠানই শিক্ষক ও কর্মীর চরম সঙ্কটে ভুগছে। শিক্ষক, অশিক্ষক কর্মী, গ্রন্থাগারিক, ল্যাবরেটরি অ্যাটেন্ড্যান্টের বহু পদ তো খালি বটেই। লোক নেই রেজিস্ট্রার, পরীক্ষা নিয়ামকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদেও।
এর ফলে স্বাভাবিক পঠনপাঠন যেমন ব্যাহত হচ্ছে, একই ভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে স্নাতকোত্তর শাখার স্পেশ্যাল পেপার বা বিশেষ পত্রে বিকল্পের সংখ্যা। যেমন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বিশেষ পত্র ছিল চারটি। তার মধ্যে একটি বেছে নিতে হতো পড়ুয়াদের। কিন্তু শিক্ষকের অভাবে একটি বিকল্প বেমালুম ছাঁটাই হয়ে গিয়েছে। যে-সব ছাত্রছাত্রী ওই বিশেষ পত্র নিতে আগ্রহী, তাঁরা পড়েছেন মুশকিলে। এই ধরনের পরিকাঠামোগত খামতির ফলে শুধু যে পড়ুয়ারাই সমস্যায় পড়ছেন, তা নয়। সামগ্রিক বিচারে ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিও।
ঘাটতির ছবিটা কেমন?
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে
এই মুহূর্তে ৩৬৬টি শিক্ষকপদ খালি। প্রেসিডেন্সিতে ১৫০টি, যাদবপুরে ২৭১টি, বারাসতের পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ১১২টি, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৭টি এবং কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০৭টি পদে শিক্ষক নেই। পর্যাপ্ত শিক্ষক না-থাকায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় পাঠ্যক্রম শেষ করতে পারছে না বলে অভিযোগ। বাড়ছে টিউশন-নির্ভরতা। হাজিরার যে-বাধ্যবাধকতা রয়েছে, যথাযথ ভাবে তা-ও মেনে চলা সম্ভব হচ্ছে না। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মীর বহু পদ ফাঁকা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অস্থায়ী কর্মীদের দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে।
কলকাতা
৩৬৬ জন শিক্ষক-ঘাটতির সঙ্গে সঙ্গে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা বাড়িয়েছে অশিক্ষক কর্মীর খালি পদ। শেষ বার নিয়োগ হয়েছিল ২০০৩ সালে। পরীক্ষা নিয়ামক, আন্ডার গ্র্যাজুয়েট কাউন্সিলের সম্পাদক ও সহ-সম্পাদকের পদে কেউ নেই। ডেপুটি রেজিস্ট্রারের দু’টি পদের মধ্যে একটি ফাঁকা। এক আধিকারিক জানান, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৩৬টি কলেজ আছে। আন্ডার গ্র্যাজুয়েট কাউন্সিলই কলেজ নিয়ন্ত্রণ করে। কলেজের পাঠ্যক্রম থেকে পঠনপাঠনের মান ঠিক করে। সেখানে দু’টি শীর্ষ পদ বেবাক ফাঁকা থাকায় কাজকর্ম বিঘ্নিত হচ্ছে ভীষণ ভাবে। কর্মী-সঙ্কট এমনই তীব্র হয়ে উঠেছে যে, সামান্য যে-ক’জন কর্মী আছেন, প্রতিদিনের কাজ সামাল দিতে গিয়ে তাঁদের নাস্তানাবুদ হতে হচ্ছে।
এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সুব্রত চক্রবর্তী বলেন, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্ধেকেরও বেশি পদে কর্মচারী নেই। বিষয়টি বহু বার কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। কিন্তু কোনও সুরাহা হয়নি।’’ লোকাভাবের কথা স্বীকার করে নিয়েছেন সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) স্বাগত সেন। তিনি বলেন, ‘‘দীর্ঘদিন কোনও নিয়োগ হয়নি। আমরা শীঘ্রই আবার নিয়োগ প্রক্রিয়া চালু করছি।’’
বারাসত
১৯২টি শিক্ষকপদ থাকলেও রয়েছেন মাত্র ৮০ জন। অনুমোদিত অফিসার-পদ ৩৫টি। সব ক’টিই শূন্য। স্থায়ী কর্মী নেই এক জনও। অস্থায়ী ভাবে প্রায় ৬৫ জনকে নেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর, শিক্ষক-সংখ্যায় শোচনীয় ঘাটতির জেরে পঠনপাঠনের মান বজায় রাখা বেশ কঠিন হয়ে পড়ছে বলে শিক্ষক ও পড়ুয়াদের অভিযোগ। এই হাল কেন? উপাচার্য বাসব চৌধুরী বলেন, ‘‘মামলা চলায় শিক্ষাকর্মী নিয়োগ করা যাচ্ছে না। আর শিক্ষক-সঙ্কট কাটানোর জন্য আমরা ইতিমধ্যেই নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করেছি।’’
প্রেসিডেন্সি
একের পর এক শিক্ষক-শিক্ষিকা প্রেসিডেন্সি ছেড়ে চলে গিয়েছেন। তাঁদের কারও কারও অভিযোগ, ওখানে কাজের পরিবেশই নেই। কারও অনুযোগ, যথাযথ বেতন দেওয়া হয় না। কেউ কেউ প্রতিষ্ঠান ছেড়েছেন স্রেফ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিবাদের জেরে। যাঁরা চলে গিয়েছেন, তাঁদের প্রায় সকলেরই অভিযোগ, পঠনপাঠন ও গবেষণার উপযুক্ত পরিকাঠামোর ব্যবস্থাই করা হয়নি। শিক্ষক-বিদায়ের কারণ যা-ই হোক, সেই শূন্যতার ফল সরাসরি ভুগতে হচ্ছে পড়ুয়াদেরই। কর্মীর অভাবের দরুন দু’বছর ধরে স্নাতকের প্রবেশিকা পরীক্ষার ভার জয়েন্ট এন্ট্রান্স বোর্ডের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন কর্তৃপক্ষ। তাতেও সুরাহা বিশেষ হয়নি। পরীক্ষার এক দিন আগেও অ্যাডমিট কার্ড পাওয়া যাচ্ছে না। ফর্ম পূরণেও জটিলতা রয়েছে। বছর ছয়েক আগে কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হওয়া প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মী-সঙ্কট ভয়াবহ। চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের।
রবীন্দ্রভারতী
কোনও স্থায়ী রেজিস্ট্রারই নেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। ফিনান্স অফিসারই রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। দীর্ঘদিন ধরে বহু গুরুত্বপূর্ণ পদ শূন্য। গ্রন্থাগারিকের পদটিও খালি। সহকারী গ্রন্থাগারিকের দু’টি পদের মধ্যে একটি শূন্য। মাত্র এক জন সহকারী গ্রন্থাগারিকের উপরে গ্রন্থাগারের দায়িত্ব ন্যস্ত। কর্তাদের একাংশের বক্তব্য, গ্রন্থাগার কর্মীর অভাব প্রভাব ফেলছে গ্রন্থাগারের রক্ষণাবেক্ষণে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিট ও অ্যাকাউন্টস অফিসার (টু) এবং জনসংযোগ আধিকারিকের পদেও কেউ নেই। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গিয়েছে, দীর্ঘদিন ধরেই কর্মী নিয়োগ স্থগিত আছে। ২০১২ সালে শেষ বার শিক্ষক নিয়োগ হয়েছিল। উপাচার্য সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘কর্মীর অভাব যে-কোনও প্রতিষ্ঠানেই বড় সমস্যা। তবে সমস্যা মেটাতে কর্তৃপক্ষ উদ্যোগী হয়েছেন। শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগের প্রক্রিয়া খুব শীঘ্রই শুরু হবে।’’
যাদবপুর
গবেষণায় নাম আছে যাদবপুরের। কিন্তু সেখানেও ২৭১টি শিক্ষকপদ খালি। ফলে পঠনপাঠনে ব্যাঘাত ঘটছে বলে পড়ুয়াদের অভিযোগ। অনুমোদিত পদে কেন নিয়োগ হচ্ছে না, সেই প্রশ্ন উঠছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্দরেই। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর, অনুমোদিত শিক্ষাকর্মীর ১৯৮টি পদে লোক নেই। রেজিস্ট্রার প্রদীপ ঘোষ বলেন, ‘‘শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে।’’
উচ্চশিক্ষার প্রায় সব প্রতিষ্ঠানেই শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর এই ঘাটতির ব্যাপারে কী বলছে রাজ্য সরকার?
রাজ্যের উচ্চশিক্ষা দফতরের এক কর্তা সাফ জানিয়ে দেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে কর্মী নিয়োগের ব্যাপারে তাঁদের কিছু করার নেই। কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েরই নিজস্ব নিয়ম আছে। সেই নিয়ম মেনে কেন তারা কর্মী নিয়োগ করছে না, শিক্ষা দফতরের কর্তাদের পক্ষে সেটা বলা সম্ভব নয়।