যক্ষ্মা-আক্রান্ত ছাত্রকে নিয়ে দুই হাসপাতালে ঠেলাঠেলি

রোগটা যক্ষ্মা। তার জীবাণু অতি-সক্রিয় এবং সংক্রামক। যথাসময়ে চিকিৎসা শুরু না-হলে রোগীর দেহে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত। আক্রান্ত হতে পারেন আশপাশের লোকজনও।তা সত্ত্বেও যক্ষ্মায় আক্রান্ত প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের দায়িত্ব এড়ানোর খেলা চলল কলকাতার নীলরতন সরকার হাসপাতাল আর মগরাহাট হাসপাতালের মধ্যে।

Advertisement

তানিয়া বন্দ্যোপাধ্যায় ও দিলীপ নস্কর

কলকাতা ও মগরাহাট শেষ আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০৩:০৭
Share:

মীর আব্দুস সোবুর।নিজস্ব চিত্র।

রোগটা যক্ষ্মা। তার জীবাণু অতি-সক্রিয় এবং সংক্রামক। যথাসময়ে চিকিৎসা শুরু না-হলে রোগীর দেহে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত। আক্রান্ত হতে পারেন আশপাশের লোকজনও।

Advertisement

তা সত্ত্বেও যক্ষ্মায় আক্রান্ত প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের দায়িত্ব এড়ানোর খেলা চলল কলকাতার নীলরতন সরকার হাসপাতাল আর মগরাহাট হাসপাতালের মধ্যে।

যে-কোনও সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে যক্ষ্মার চিকিৎসা হয় এবং রোগীদের পরামর্শ দেওয়া হয় বলে প্রচার করে থাকে রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর। সেই প্রচারে ভরসা রেখেই নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন মীর আব্দুস সোবুর নামে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ছাত্র। কিন্তু এনআরএস কোনও চিকিৎসা না-করেই তাঁকে মগরাহাট হাসপাতালে যেতে বলে।

Advertisement

কারণ?

মীরের বাড়ি মগরাহাটে। তাঁর অভিযোগ, পড়াশোনার সূত্রে তিনি যে এখন কলকাতাতেই থাকেন, সেই যুক্তিটাকে আমলই দিতেই চাননি নীলরতনের সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকেরা। দ্রুত রোগ সারানোর আশা নিয়ে শুক্রবার মীর গিয়েছিলেন মগরাহাট হাসপাতালে। কিন্তু জেলার ওই হাসপাতাল তাঁকে আবার পাঠিয়ে দিয়েছে নীলরতনে। সেখান থেকে তাঁকে যে আবার কোথায় ‘রেফার’ করা হবে, সেই দুশ্চিন্তায় রয়েছেন গরিব পরিবারের মেধাবী ছাত্রটি।

মগরাহাটের বাঁকিপুরের ছেলে মীর কলকাতার তালতলায় একটি মেসে থাকেন। কয়েক সপ্তাহ ধরে জ্বর ও কাশিতে ভুগছিলেন। গত সপ্তাহে কাশির সঙ্গে মুখ দিয়ে রক্ত বেরোয়। বুকের ডান দিকে ব্যথাও আছে। ১৫ ফেব্রুয়ারি নীলরতনের বহির্বিভাগে ডাক্তার দেখান তিনি। চিকিৎসক রক্তের নমুনা-সহ কয়েকটি পরীক্ষা করতে বলেন। সে-দিনই হাসপাতালে সেই পরীক্ষায় যক্ষ্মারোগের জীবাণু ধরা পড়ে। মীর বলেন, ‘‘ফলাও সরকারি প্রচারে যেমন দেখি, তাতে মনে হয়েছিল, রোগ যখন ধরা পড়েছে, চিকিৎসকেরা পত্রপাঠ আমার চিকিৎসা শুরু দেবেন। কিন্তু বাড়ি মগরাহাট শোনা মাত্রই ওঁরা আমাকে রিপোর্ট নিয়ে মগরাহাট হাসপাতালে যেতে বললেন। আমি যে এখন কলকাতায় থাকি, সে-কথায় কানই দেওয়া হল না।’’

এনআরএসের রিপোর্ট নিয়ে এ দিন মগরাহাটের হাসপাতালে যান মীর। কিন্তু সেখানে গিয়েও চিকিৎসা পাননি তিনি। কেন?

প্রেসিডেন্সির ছাত্রটি বললেন, ‘‘মগরাহাট হাসপাতালের পাল্টা প্রশ্ন, আমি তো থাকি কলকাতার তালতলায়। তা হলে মগরাহাট হাসপাতাল আমাকে ওষুধ দেবে কেন? এর জবাব চায় ওরা।’’

রোগীর, বিশেষত যক্ষ্মারোগীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে বাসস্থানের বিষয়টি কি এ ভাবে গুরুত্ব পেতে পারে?

‘‘মীর কলকাতায় থাকেন। তাই মগরাহাট হাসপাতালের পক্ষে তাঁর চিকিৎসা করা সম্ভব নয়,’’ সরাসরি বলে দেন মগরাহাট হাসপাতালের যক্ষ্মা বিভাগের এক কর্তা।

বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, ঠিক সময়ে যক্ষ্মার চিকিৎসা শুরু না-হলে জীবাণু দ্রুত বংশ বিস্তার করে আক্রান্তের শরীরে। তাতে সেই রোগীর সমস্যা তো বাড়েই। ব্যাপারটা সমাজের পক্ষেও বিপজ্জনক। যক্ষ্মার জীবাণু এক জনের থেকে অন্যের শরীরে ছড়িয়ে পড়ে নিমেষেই। এ-সব জানা সত্ত্বেও মগরাহাট হাসপাতাল বা এনআরএস কালবিলম্ব না-করে মীরের চিকিৎসা শুরু করল না কেন?

আরও পড়ুন:

‘দত্তক ছেলের’ কী দরকার! মোদীকে বিঁধলেন প্রিয়ঙ্কা

মগরাহাট হাসপাতালের যক্ষ্মা বিভাগ জানায়, শুক্রবার সেখানে আর কোনও কাজ করার সুযোগ ছিল না। আর শনি-রবিবারে এ-সব কাজ হয় না। সোমবারের আগে কিছুই হওয়ার নয়। তা ছাড়া ছাত্রটি এখন কলকাতায় থাকেন। তাই তাঁকে ‘রেফার’ করে দেওয়া হয়েছে নীলরতনে।

মীর জানেন, চিকিৎসায় একটা দিন দেরি হওয়া মানে ঝুঁকি অনেকটাই বেড়ে যাওয়া। তাঁর আর্থিক অবস্থা বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর মতো নয়। বছর তিনেক আগে বাবা মারা গিয়েছেন। তাঁরা ছয় ভাইবোন। মা সব একা হাতে সামলাচ্ছেন। তার উপরে চিকিৎসার খরচ সামলানো মুশকিল। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘ভরসার জায়গা বলতে সরকারি হাসপাতাল। সেখানে এমন ঠেলাঠেলি হলে

কোথায় যাব? অসুস্থ শরীরে জেলা থেকে শহর ঘুরে বেড়াচ্ছি। বুঝতে পারছি, আমার থেকে রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও থাকছে।’’

কলকাতার এনআরএস এবং জেলার মগরাহাট, দুই হাসপাতালের লোকজনই তাঁর সঙ্গে অমানবিক আচরণ করেছেন বলে অভিযোগ মীরের। তিনি বলেন, ‘‘মগরাহাটের যক্ষ্মারোগ বিভাগের কর্তা সুপ্রিয় সরকার আমাকে ধাক্কা দিয়ে বার করে দিয়েছেন।’’

এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সুপ্রিয়বাবু। তিনি বলেন, ‘‘যা হয়েছে, পদ্ধতি মেনেই হয়েছে। উনি কলকাতার তালতলায় থাকেন। তাই আমরা ওঁকে এনআরএসে যেতে বলেছি। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী বাড়ির পাশের স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসপাতাল থেকে টিবির ওষুধ নিতে হয়। কারণ, রোগী ওষুধে কেমন সাড়া দিচ্ছেন, সেটা দেখা জরুরি।’’

মীর বেশি অবাক হয়েছেন নীলরতনের চিকিৎসকদের আচরণে। কেন এমন মারাত্মক একটি সংক্রামক রোগে আক্রান্তকে ওষুধ না-দিয়েই ছেড়ে দিল কলকাতার হাসপাতাল?

নীলরতনের সুপার হাসি দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘সরকারি নিয়ম অনুযায়ী আমরা ওকে ওর বাড়ির কাছের হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছি।’’

কিন্তু মীর তো এখন কলকাতাতেই থাকেন। ওষুধ দেওয়ার পরে নিয়মিত পর্যবেক্ষণের জন্য ওঁর পক্ষে তো নীলরতনেই দেখাতে হবে। সেটাই সুবিধেজনক। তা হলে?

‘‘বিষয়টি দেখছি। হাসপাতালে আসুক ও। তার পরে পুরো বিষয়টি দেখা হবে,’’ বলেন হাসিদেবী।

সরকারের নির্দেশ, হাসপাতাল শুধু বিনামূল্যে যক্ষ্মারোগীর চিকিৎসা করাবে না। ওষুধও দেবে। প্রয়োজনে হাসপাতালের কর্মীরা ওষুধ বাড়িতে পৌঁছে দেবেন।

এই সুস্পষ্ট নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও দুই হাসপাতালের দায় এড়ানোর প্রতিযোগিতা দেখে শহরের বক্ষঃরোগ বিশেষজ্ঞেরা হতবাক। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের অবসরপ্রাপ্ত বক্ষঃরোগ বিশেষজ্ঞ সুবীরকুমার দে বলেন, ‘‘হাসপাতাল যক্ষ্মর ওষুধ দেবে না, এটা হতে পারে না। কেন

এমন করছে, বুঝতে পারছি না। কিন্তু রোগীর দ্রুত চিকিৎসা শুরু না-করলেই নয়।’’

অবিলম্বে চিকিৎসা না-হলে কী ঘটতে পারে, তার ইঙ্গিত দিয়েছেন বক্ষঃরোগ বিশেষজ্ঞ পার্থসারথি ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ‘‘দ্রুত চিকিৎসা শুরু না-হলে ঝুঁকি বাড়বে দু’দিক থেকে। রোগীর দেহে সংক্রমণ ছড়াবে। বিপদ বাড়বে তাঁর আশেপাশের লোকজনেরও।’’

কেন দায় এড়াচ্ছে হাসপাতাল?

‘‘মীরের সঙ্গে শনিবার যোগাযোগ করব। ও যাতে দ্রুত চিকিৎসা পায়, সেই ব্যবস্থা করছি,’’ আশ্বাস দিয়েছেন মগরাহাটের ব্লক মেডিক্যাল অফিসার মহম্মদ গউস-উল-আলম।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement