নিহত সাহিনার বাড়িতে সিপিএমের প্রতিনিধিরা। —নিজস্ব চিত্র।
তরুণীর গুলিবিদ্ধ দেহ মেলার পর থেকেই আতঙ্ক ছড়িয়েছিল গ্রামে। খুনের কারণ, কারা জড়িত সে সব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। বর্ধমান, কাটোয়ায় কেতুগ্রামের কাঁটারি গ্রামের সাহিনা খাতুনের খুনের প্রতিবাদে বিক্ষোভ, স্মারকলিপিও দিয়েছিল বেশ কিছু সংগঠন। অবশেষে সাত দিন পরে দু’জনকে গ্রেফতার করল পুলিশ। যদিও ধৃত উজ্জ্বল শেখ ও লোটাস শেখের সঙ্গে নিহত সাহিনা খাতুনের কী যোগ ছিল তা জানাতে চায়নি পুলিশ। পুলিশের দাবি, তদন্তের স্বার্থেই তদন্তের অগ্রগতি জানানো যাবে না। শুধু জানা গিয়েছে, উজ্জ্বল সম্পর্কে নিহত সাহিনার দিদির দেওর, আর লোটাসও ওই গ্রামেরই ছেলে।
তবে গ্রামের পরিবেশ এখনও থমথমে। মুখে কুপুল এঁটেছেন গ্রামবাসী, এমনকী মেয়েটির পরিবারের লোকেরাও। বুধবার সিপিএমের মহিলা সমিতির সদস্যেরা গ্রামে গেলে তাঁদেরও আতঙ্কের কথা জানান তাঁরা। রাজ্য মহিলা কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারপার্সন ভারতী মুৎসুদ্দি দাবি করেন, “পুলিশ এখনও তদন্তই শুরু করেনি। নিহত তরুণীর মায়ের গোপন জবানবন্দি দূরে থাক, সে ভাবে জিজ্ঞাসাবাদও করেনি।’’ পুলিশের অবশ্য দাবি, দ্রুত খুনের কিনারা করা হবে।
গত ৬ অগস্ট ভোরে কাঁটারি গ্রামের একটি পরিত্যক্ত বাড়ির সদর দরজার সামনে থেকে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা গুলিবিদ্ধ দেহ মিলেছিল সাহিনার। পিঠে একটি ও মাথায় দুটি গুলির ক্ষত ছিল। আরও তিনটি কাতুর্জ মিলেছিল ঘটনাস্থলে। কিন্তু কেনই বা ওই তরুণী বাড়ির কাউকে না জানিয়ে ওখানে গেলেন, কে বা কারা ডেকেছিল— সে সব প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। কুড়ির মেয়েটি বাড়ি থেকে চটি না পড়ে রাস্তায় বেরিয়ে গেল কেন? কার ফোন পেয়ে সে অন্ধকারে পরিত্যক্ত বাড়ির দিকে ছুটে গিয়েছিল, ধোঁয়াশা কাটেনি কোনটারই। বর্ধমান জেলা পুলিশের যদিও দাবি, ওই তরুণীর সঙ্গে ফোনে কারও প্রণয়ের সম্পর্ক ছিল। সম্প্রতি সম্পর্কটি থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছিলেন ওই তরুণী। বিয়ে করার জন্য বাড়িতে মতও দিয়েছিলেন। তার জেরেই এ ভাবে খুন করা হয় বলে পুলিশের অনুমান। যদিও ওই তরুণীর কাছের কেউ জড়িত কি না তা নিয়ে কিছু বলতে রাজি নয় পুলিশ।
বুধবার দুপুর ১২টা নাগাদ রাজ্য মহিলা কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারপার্সন ভারতী মুৎসুদ্দি, সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অঞ্জু কর, জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সাধনা মল্লিকেরাও কাঁটারি গ্রামে যান। সঙ্গে ছিলেন সিপিএমের কেতুগ্রাম জোনাল কমিটির নেতারা। এই ঘটনায় প্রায় ৬ বছর পরে কেতুগ্রামের এই এলাকায় এলেন সিপিএমের নেতারা। দেখা যায়, ভরদুপুরেও কয়েকজন স্কুল পড়ুয়া ছাড়া গোটা গ্রাম কার্যত ফাঁকা। গ্রামের বটগাছ তলায় গাড়ি দাঁড়াতে দেখে দরজার ফাঁক দিয়ে, কিংবা গাছের আড়াল দিয়ে মুখ বের করতে দেখা যায় কয়েকজনকে। এক বৃদ্ধা নিচু গলায় বলেন, “বাড়ি থেকে বের হওয়া বারণ রয়েছে। কথা বলাও বারণ। দেখছেন না, গোটা গ্রাম কেমন ভয়ে চুপসে রয়েছে। সকাল-বিকেল নেতারা গ্রামে আসছেন।” কারা বারণ করছে জিজ্ঞাসা করতেই অবশ্য পুকুর পাড় ধরে হাঁটা লাগান সাদা শাড়ি পড়া ওই বৃদ্ধা। এই পুকুর পাড় থেকেই কয়েক ফুট দূরে নিহত তরুণীর বাড়ি।
সেখানে সিপিএম ও গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির সদস্যদের সামনে এক বৃদ্ধা বলে ফেলেন, “আমরা ভয়ে কুঁকড়ে আছি। খুনিরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। কখন, কার উপর হামলে পড়বে কে জানে! ” নিহতের পরিজনেরাও জানান, সন্ধ্যার পর বাড়ি থেকে ভয়ে কেউ বের হচ্ছেন না। এমনকী মেয়েদের স্কুলে পাঠাতেও ভয়ে পাচ্ছেন অভিভাবকরা। স্থানীয় বাসিন্দা কোহিনূর বিবি, শান্ত বিবিরা বলেন, “ভয়ের ছায়া নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। কী যে হবে কে জানে।” কয়েকদিন আগে গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি কেতুগ্রাম থানায় স্মারকলিপি দিতে গিয়েছিল, তাঁদের কাছে পুলিশ আধিকারিকরাও আক্ষেপ করেছিলেন, ‘গ্রামের লোক তো বটেই, বাড়ির লোকেরাও মুখ খুলছে না। আমাদের একটু সাহায্য না করলে তদন্ত এগোবে কী করে?” এ দিন মহিলা সমিতির নেত্রীরাও নিহতের পরিজনদের কাছে সেই অনুরোধও রাখেন।
রাজ্য মহিলা কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারপার্সন ভারতী মুৎসুদ্দির অভিযোগ, “পুলিশ তো এখনও তদন্তই শুরু করেনি। নিহত তরুণীর মায়ের গোপন জবানবন্দি দূরে থাক, সে ভাবে জিজ্ঞাসাবাদও করেনি। ওই তরুণীর সঙ্গে থাকা কাউকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। রাজনৈতিক প্রভাবে কী পুলিশ তদন্তকে নষ্ট করে দিতে চাইছে?” কেতুগ্রামের বিধায়ক শেখ শাহনেওয়াজ অবশ্য বলেন, ‘‘বীভৎস ভাবে খুন করা হয়েছে। পরিচিতজনেরা তো একটু ভয় পাবেই। আর বর্ধমান জেলা পুলিশের এক কর্তা বলেন, “আমরা এই খুনের কিনারা করবই। প্রমাণ খুব কম থাকার জন্য একটু সময় লাগছে।”