এসএসকেএমের কুকুর-কাণ্ডে ইতি টানতে মরিয়া হয়ে উঠেছে স্বাস্থ্য দফতর।
তাই তদন্ত তো হলই না, উল্টে স্বাস্থ্য ভবন শাসানি দিল, ব্যাপারটা নিয়ে কেউ মুখ খুললে পরিণতি হবে প্রদীপ মিত্রের মতো, যাঁকে কিনা সদ্য এসএসকেএমের অধিকর্তার পদ থেকে বদলি করে দেওয়া হয়েছে। এবং সেই সিদ্ধান্ত মানতে না-চাওয়ায় যিনি আপাতত কম্পালসরি ওয়েটিংয়ে।
হাসপাতাল-সূত্রের খবর: এসএসকেএমের বিভিন্ন বিভাগের কিছু চিকিৎসককে ফোন করে এ হেন হুমকি দিয়েছেন স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তা। কুকুর-কাণ্ডের জেরে রাজ্যের ‘সুপার স্পেশ্যালিটি’ হাসপাতালটির ভাবমূর্তিতে যে ভাবে কালির দাগ লাগছে, ওই চিকিৎসকেরা তার প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, বিতর্ক নিরসনের স্বার্থে তদন্ত করে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন করা হোক।
কিন্তু রাজ্যের স্বাস্থ্য প্রশাসনের হর্তা-কর্তারা সে পথে হাঁটতে রাজি নন। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, তদন্ত হবে না। ‘‘বার্তা দেওয়া হয়েছে, পোষালে থাকুন, না-পোষালে চলে যান।’’— জানাচ্ছেন এক সূত্র। এসএসকেএমের এক ডাক্তারের কথায়, ‘‘তদন্ত হলে কুকুরের মালিকের পরিচয় প্রকাশ হয়ে প়ড়বে। তাই যেন তেন প্রকারে পুরো বিষয়টি চাপা দেওয়ার নির্দেশ গিয়েছে কালীঘাট থেকে!’’
বস্তুত ‘ভিভিআইপি’ কুকুরের ‘ভিভিআইপি’ মালিকের পরিচয় গোপন রাখার তাগিদে বদলি থেকে শোকজ, সাসপেনশন— যাবতীয় অস্ত্রই স্বাস্থ্য ভবন তৈরি রেখেছে। এমতাবস্থায় হাসপাতালের চিকিৎসক মহলে রীতিমতো সন্ত্রাসের আবহ সৃষ্টি হয়েছে বলে অভিযোগ। নেফ্রোলজি’র এক ডাক্তারের আক্ষেপ, ‘‘এখানে কাজের পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সব সময়ে অবিশ্বাস, হুমকি!’’ মেডিসিনের এক জন বলছেন, ‘‘আমাদের পরিষ্কার জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, মুখ খুললেই প্রত্যন্ত জায়গায় বদলি করা হবে।’’ স্বাস্থ্য-কর্তাদের কী বক্তব্য?
কুকুর-কাণ্ড ঘিরে এসএসকেএমে এই যে তোলপাড়, সে সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের অতি সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া, ‘‘কোনও কথা বলব না।’’ তা হলে কে বলবেন?
বিষয়টি নিয়ে মাঝে-মধ্যে সংবাদমাধ্যমে মুখ খুলেছেন তৃণমূলের চিকিৎসক-নেতা নির্মল মাজি, কুকুর-কাণ্ডে মূল অভিযোগের তির যাঁর দিকে। অভিযোগ, তাঁরই সুপারিশে এসএসকেএমে কুকুরের ডায়ালিসিস করাতে প্রদীপ মিত্র ও হাসপাতালের নেফ্রোলজি’র বিভাগীয় প্রধান রাজেন পাণ্ডে সচেষ্ট হয়েছিলেন। প্রদীপবাবু চেয়ার খোয়ালেও নির্মলবাবুর ডানা কিন্তু অক্ষত। তিনি এখনও রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের প্রধান, পাশাপাশি স্বাস্থ্য দফতরের একাধিক কমিটির মাথাও বটে!
অন্য দিকে রাজেনবাবুর গায়েও আঁচ পড়েনি। বরং তৃণমূলপন্থী চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণ, ঘটনার পরে রাজেন পাণ্ডে আরও ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছেন। এসএসকেএমের এক সূত্রের দাবি: ‘‘রাজেন স্যার রীতিমতো হুমকির সুরে বলেছেন, প্রদীপ মিত্রের জমানা শেষ। এখন আমার জমানা। আমার কথা শুনতে হবে।’’
রাজেন স্যার বা নির্মল মাজি, কারও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। কিন্তু যাকে ঘিরে এত কাণ্ড, সেই ‘ভিভিআইপি’ কুকুরের মালিকটি কে?
এসএসকেএমের নথিপত্র থেকে অন্তত তাঁর পরিচয় জানার যো নেই। যদিও অন্য সূত্রে কুকুরটি সম্পর্কে কিছু তথ্য হাতে এসেছে। কী রকম?
তার চিকিৎসা হয়েছিল যেখানে, সেই বেলগাছিয়া পশু-হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান সমর সরকারের বিবরণ অনুযায়ী, কুকুরটি গোল্ডেন রিট্রিভার প্রজাতির। বয়স, বছর ছয়েক। ওজন ২৮-৩০ কেজি। জরায়ুতে পুঁজ জমেছিল। খাওয়া-দাওয়া করছিল না। রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে যায়, শরীরে তরলের পরিমাণও নামছিল। সোডিয়াম-পটাশিয়ামের মাত্রা ওঠা-নামা করছিল। ক্রমে কিডনি বিকল হয়ে যায়। সে ‘সেপটিক শক’-এর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল।
এই পরিস্থিতিতে তার জরায়ুর অস্ত্রোপচার হয় বলে পশু-হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে। যার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সমরবাবু। ওই পশু-চিকিৎসকের দাবি: কুকুরটির যে রকম অবস্থা ছিল, তাতে অস্ত্রোপচার করার কথা নয়। ‘‘ভিআইপিদের তুষ্ট করতে অবিবেচকের মতো সেটাই করা হয়েছে। যে কোনও অপারেশনের আগে মেডিসিন বিভাগের সঙ্গে আলোচনা জরুরি। তা-ও হয়নি।’’— অভিযোগ সমরবাবুর। ওঁর মন্তব্য, ‘‘নির্দ্বিধায় বলতে পারি, কম যোগ্যতার প্রশাসকদের তরফে এমন তোষামোদের নজির প্রতিষ্ঠানকে হাসির খোরাক করে তুলছে।’’
পশু-হাসপাতালের অন্দরের খবর: সেখানকার ডাক্তারেরা বলে দিয়েছিলেন, মাসে অন্তত এক বার ডায়ালিসিস না-হলে কুকুরটিকে বাঁচানো যাবে না। পশ্চিমবঙ্গে কুকুরের ডায়ালিসিসের ব্যবস্থা নেই। তাই তাকে বার তিনেক চেন্নাই নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু যাতায়াতের বিপুল খরচ আর সময়ের অভাবের কারণে কলকাতাতেই ডায়ালিসিস করাতে মালিক উঠে-পড়ে লাগেন। এরই পরিণামে মানুষের হাসপাতালে কুকুরের ডায়ালিসিস করানোর উদ্যোগ দানা বাঁধে। তা, এমন ‘ভিভিআইপি’ কুকুরের মালিকটি কে?
এ প্রসঙ্গে সমরবাবুও মুখ খুলতে নারাজ। ‘‘দয়া করে জিজ্ঞাসা করবেন না। আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়।’’— জবাব দিয়েছেন তিনি।