ভারতীকে বদলির যুক্তি সাজাতে হিমশিম নবান্ন

বিরোধীদের পাশাপাশি পুলিশ-প্রশাসনেরও অনেকের ‘মনের কথা’ কেড়ে নির্বাচন কমিশন জানতে চেয়েছে— ভোটের মুখে ভারতী ঘোষকে কেন ওএসডি, এলডব্লিউই (অপারেশন) পদে বদলি করল নবান্ন। রাজ্য সরকার এর জবাব দেবে। কিন্তু সেই জবাব চিঠির বয়ান কী হবে, ব্যাখ্যা-ই বা কী হবে— মঙ্গলবার পর্যন্ত তা চূড়ান্ত করতে পারেনি প্রশাসনের শীর্ষ মহল।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৩:৪০
Share:

বিরোধীদের পাশাপাশি পুলিশ-প্রশাসনেরও অনেকের ‘মনের কথা’ কেড়ে নির্বাচন কমিশন জানতে চেয়েছে— ভোটের মুখে ভারতী ঘোষকে কেন ওএসডি, এলডব্লিউই (অপারেশন) পদে বদলি করল নবান্ন। রাজ্য সরকার এর জবাব দেবে। কিন্তু সেই জবাব চিঠির বয়ান কী হবে, ব্যাখ্যা-ই বা কী হবে— মঙ্গলবার পর্যন্ত তা চূড়ান্ত করতে পারেনি প্রশাসনের শীর্ষ মহল।

Advertisement

শুধু ভারতী ঘোষ নয়, মেদিনীপুরের জেলাশাসক জগদীশপ্রসাদ মিনা সম্পর্কেও খুঁটিনাটি জানতে চেয়েছে নির্বাচন কমিশন। এ ছাড়াও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি যে সব ডিএম এবং এসপি-র বিরুদ্ধে ফুল বেঞ্চের কাছে অভিযোগ জানিয়েছিল, তাঁদের সম্পর্কেও নিজস্ব সূত্রে খবর নেওয়া শুরু করেছে কমিশন।

গত ২৯ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র দফতর যে বিজ্ঞপ্তি (১৩৪-পিএস সেল/এইচআর/ও/৩পি-০৭) জারি করে, তাতে ভারতীদেবীকে ওই পদে বদলির কথাই শুধু বলা রয়েছে। তাঁর অফিস কোথায় হবে, কার অধীনে থাকবেন তিনি— সে সব কিছুই নেই। এক পুলিশ কর্তা বলেন, ‘‘সাধারণ ভাবে বদলির বিজ্ঞপ্তিতেই এ সবের উল্লেখ থাকে। সেই মতো অর্থ দফতর সংশ্লিষ্ট অফিসারের বেতন বা অন্য আর্থিক সুবিধা কোথা থেকে দেওয়া হবে, তা ঠিক করে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সব-ই পৃথক।’’

Advertisement

নবান্নের খবর, সব কিছু ঠিক থাকলে বাঁকুড়ার এসপি অফিস থেকে ভারতীদেবীর বেতন হবে। এ দিন পর্যন্ত সেই নথি রাজ্য পুলিশের সদর দফতরে পৌঁছয়নি। এখন তিনি রানিবাঁধে একটি সরকারি গেস্ট হাউসে ক্যাম্প অফিস করেছেন। সেখান থেকেই জঙ্গলমহলের খবর রাখছেন।

কমিশনের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে যেমন প্রশাসনকে মাথা চুলকোতে হচ্ছে, তেমনই ভারতীদেবীকে কোথায় বদলি করা হবে, তা চূড়ান্ত করতেও কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি নবান্নের একাংশকে। সূত্র জানাচ্ছে, যে হেতু তিন বছরের বেশি জঙ্গলমহলের দু’টি জেলায় এসপি ছিলেন ভারতীদেবী, তাই বিধানসভা ভোটের আগেই তাঁকে সরিয়ে দেবে নির্বাচন কমিশন, এমন আশঙ্কা ছিল। তাই ঘুরপথে তাঁর হাতেই যাতে ওই এলাকার দায়িত্ব থাকে, এমনই বিকল্প খোঁজার নির্দেশ ছিল। সেই মতো ভারতীদেবীকে পুলিশের নিত্য দিনের কাজের বাইরে রেখে নতুন পদ তৈরি করে কেবল মাওবাদী কার্যকলাপ দেখার দায়িত্ব ন্যস্ত করে স্বরাষ্ট্র দফতর।

নবান্নে একটি সূত্র বলছে, একেবারে গোড়ায় ঠিক হয়েছিল, রাজ্য গোয়েন্দা পুলিশ (আইবি)-র অধীনে রেখে ভারতীদেবীকে জঙ্গলমহলের দায়িত্ব দেওয়া হবে। কিন্তু তাতে বাধ সাধেন এক দল অফিসার। তাঁরা বলেন, মাওবাদী কাজকর্মে নজরদারির জন্য আইবি-তে পুলিশ সুপার পদমর্যাদার এক জন অফিসার আছেন। ভারতীদেবীও একই পদমর্যাদার। ফলে কী ভাবে একই কাজ দু’জনে পৃথক ভাবে দেখবেন, সেই প্রশ্ন ওঠে। নবান্নের এক কর্তা বলেন, ‘‘ভারতীদেবী যাতে স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পারেন, তা গুরুত্ব দিয়ে দেখতে বলা হয়েছিল। আইবি-র অধীনে থাকলে তাঁর জন্য জঙ্গলমহলে পৃথক অফিস করা যাবে না বলে মত দেন অনেকে। ফলে ওই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।’’

কিন্তু কেন এত পরিকল্পনা?

নবান্নের এক দল অফিসারের যুক্তি, প্রথমে ঝাড়গ্রাম পুলিশ জেলা, তার পরে পশ্চিম মেদিনীপুরের এসপি থাকার সুবাদে একদা মাওবাদী প্রভাবিত জঙ্গলমহলের নাড়ি বোঝেন ভারতীদেবী। বিগত ক’মাস যাবৎ ওই এলাকায় মাওবাদীদের আনাগোনা সংক্রান্ত একাধিক সতর্কতা পাঠিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। বিধানসভা ভোটের সময় মাওবাদীরা যাতে রাজ্য প্রশাসনের মাথাব্যথার কারণ না হয়, তার জন্যই ভারতীদেবীর বদলি যুক্তিযুক্ত। এই ব্যাখ্যা উড়িয়ে দিয়ে প্রশাসনের অন্য একটি অংশ বলছেন, যেখানে জঙ্গলমহলে চার-চার জন এসপি এবং দু’জন রেঞ্জ ডিআইজি আছে, সেখানে কেন আরও এক জন এসপি পদমর্যাদার অফিসারকে পোস্টিং দেওয়া হবে? সুতরাং প্রশ্ন তো উঠবেই।

ওই অফিসারদের মত, নবান্নের এই নির্দেশ যত না প্রশাসনিক, তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক। কেন? ওই অফিসারদের বক্তব্য, ২০১৪-য় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘জঙ্গলমহলের মা’ বলে সম্বোধন করেছিলেন ভারতীদেবী। গত বছরে পিংলার ব্রাহ্মণবাড়ে বিস্ফোরণে ১৩ জনের মৃত্যু হলে মুখ্যমন্ত্রী নিদান হেঁকেছিলেন, বিয়ে বাড়ির জন্য বাজি তৈরি হচ্ছিল। পশ্চিম মেদিনীপুরের তৎকালীন এসপি ভারতীদেবীও একই দাবি করেছিলেন। পরে গোয়েন্দা রিপোর্টে জানা যায়, পটকার পাশাপাশি দেশি বোমাও তৈরি হত ওই বেআইনি বাজি কারখানায়।

এর পাশাপাশি সবং কলেজ চত্বরে ছাত্র পরিষদ কর্মী কৃষ্ণপ্রসাদ জানা খুনের ঘটনায় তৃণমূল ছাত্র পরিষদের (টিএমসিপি) অভিযুক্তদের আড়াল করার অভিযোগ ওঠে ভারতীদেবীর বিরুদ্ধে। মুখ্যমন্ত্রীর সুরে সুর মিলিয়ে ভারতীদেবী জানিয়ে দিয়েছিলেন, ছাত্র পরিষদের নিজেদের অশান্তির জেরেই কৃষ্ণপ্রসাদ খুন হন। চার্জশিটেও লঘু ধারা দেওয়া হয় শাসক দলের ছাত্রনেতাদের বিরুদ্ধে। একই ভাবে খড়্গপুর পুর-নির্বাচনে শাসক দলের পক্ষ নিয়ে বিরোধীদের ভাঙিয়ে বোর্ড নেওয়ার অভিযোগ তোলে বাম-কংগ্রেস-বিজেপি। প্রশ্ন ওঠে এ বছরের গোড়ায় বেলপাহাড়িতে পুলিশের জনসংযোগ কর্মসূচিতে জেলা তৃণমূলের নেতা-নেত্রীদের উপস্থিতি নিয়েও। সরকারি সূত্রের খবর, কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়া কমিশনের কাছে যে অভিযোগপত্র দিয়েছেন, তাতে ওই অনুষ্ঠানেরও উল্লেখ রয়েছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement