State News

ঐতিহ্যের রঙে রঙিন শান্তিপুরের দোল উৎসব

রং লেগেছে! বসন্ত কবেই এসে গিয়েছে। তবে দোল না এলে বসন্তের সেই পূর্ণতা যেন অধরাই থেকে যায়। মথুরা-বৃন্দাবনে অনেক আগেই শুরু হয়েছে হোলি উৎসব। শ্রীকৃষ্ণের স্মৃতি বিজড়িত মথুরা-বৃন্দাবন কিংবা নন্দগাঁও-র মতোই বাংলার হোলি উৎসব বর্ণময়।

Advertisement

বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য

কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ মার্চ ২০১৭ ০০:০০
Share:

শান্তিপুরের গোকুলচাঁদের মন্দিরের বিগ্রহ।

রং লেগেছে! বসন্ত কবেই এসে গিয়েছে। তবে দোল না এলে বসন্তের সেই পূর্ণতা যেন অধরাই থেকে যায়। মথুরা-বৃন্দাবনে অনেক আগেই শুরু হয়েছে হোলি উৎসব। শ্রীকৃষ্ণের স্মৃতি বিজড়িত মথুরা-বৃন্দাবন কিংবা নন্দগাঁও-র মতোই বাংলার হোলি উৎসব বর্ণময়। শুধু একে অপরকে রং দেওয়া নয়, বাংলার এক এক প্রান্তে দেখা যায় নানা ধরনের হোলির আচার-অনুষ্ঠান এবং পুজো পদ্ধতি।

Advertisement

নদিয়া জেলার শান্তিপুরের দোল উৎসব রাসযাত্রার পর দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ উৎসব বলে পরিচিত। এখানকার দোল এক দিনের উৎসব নয়, বরং পূর্ণিমায় দোল ছাড়াও প্রতিপদ, পঞ্চমদোল, সপ্তমদোল এবং রামনবমীতেও এখানে দোল উৎসব পালিত হয়। এর সঙ্গে মিশে আছে কত কাহিনি, কত কিংবদন্তি আর আবালবৃদ্ধবনিতার সরল বিশ্বাস আর ভক্তি।

শান্তিপুরের দোল উৎসব মূলত তিনটি ভাগে বিভক্ত। বিগ্রহবাড়ির দোল, মন্দিরের দোল এবং বারোয়ারির দোল।

Advertisement

আরও পড়ুন

দোল খেলুন আপনারা, ওরা থাকুক নিরাপদে

শান্তিপুরের প্রাচীন মন্দিরের দোলের মধ্যে অন্যতম শ্যামচাঁদ ও গোকুলচাঁদের মন্দিরের দোল। শ্যামচাঁদের দোল হয় পূর্ণিমার পরের দিন প্রতিপদে। দোলের সন্ধ্যায় হয় চাঁচর অনুষ্ঠান। পরের দিন বিশেষ পুজো, ভোগ, নামসংকীর্তন শেষে সন্ধ্যায় শ্যামচাঁদ আলোকসজ্জা-সহ শোভাযাত্রায় বের হয়ে নগর পরিক্রমা করেন। এই দৃশ্য দেখতে রাস্তার দু’ধারে ভিড় করেন অসংখ্য ভক্ত। এই শোভাযাত্রা যায় ওড়িয়া গোস্বামীবাড়িতে, সেখানে হয় ডালিধরা উৎসব। সমস্ত বারোয়ারি পুজোও এখানে গিয়ে ডালি নিবেদন করেন। ডালিতে থাকে পাঁচ রকমের ফল, পৈতে ইত্যাদি। শুধু তাই নয়। এ দিন সমস্ত বারোয়ারি পুজোর বিগ্রহগুলিকে শোভাযাত্রা করে ওড়িয়া গোস্বামীবাড়ির সামনে নিয়ে আসা হয়। এটা একটা প্রচলিত রীতি। গোকুলচাঁদের দোল হয় পূর্ণিমায়। উঁচু দোলমঞ্চে গোকুলচাঁদের দারুবিগ্রহ স্থাপন করে বিশেষ পূজার্চনা করা হয়। এ দিন দোলমঞ্চে গিয়ে দেবতাকে আবির দেওয়ার সুযোগ পান ভক্তেরা।

রাধারমণ জিউ বড়গোস্বামীবাড়ির বিগ্রহ।

শান্তিপুরের দোল মানে কিন্তু এক দিনের উৎসব নয়। উৎসবের রেশ চলে সেই রামনবমী পর্যন্ত। প্রাচীন বিগ্রহবাড়িগুলির মধ্যে অন্যতম বড়গোস্বামীবাড়ির দোল। পূর্ণিমায় হয় রাধারমণ ও শ্রীমতীর দোল। এই পরিবারের সত্যনারায়ণ গোস্বামী বললেন, ‘‘সে দিন সকালে রাধারমণ-শ্রীমতীর বিগ্রহ দোলমঞ্চে বসিয়ে বিশেষ পুজো হয়। এই উপলক্ষে বিশেষ সাজ পরানো হয়। দুপুরে থাকে বিশেষ ভোগ। বিকেল থেকে শুরু হয় নামসংকীর্তন। সন্ধ্যায় পরিবারের একটি বিশেষ পালাদারের বাড়িতে আবারও পূজার্চনা হয়ে রাতে রাধারমন-শ্রীমতী বাড়ি ফেরেন।’’

এর পাঁচ দিন পরে পঞ্চমদোলে বড় গোস্বামী বাড়িতে এ দিন মদনমোহন-শ্রীমতি দোল হয় একই নিয়ম মেনে। তবে পঞ্চম দোলের প্রধান্য বেশি গোপালপুর অঞ্চলে। এখানে সাহা বাড়িতে রাধাকান্ত জিউর দোল, নতুনপাড়ায় সাহিত্যিক দামোদর মুখোপাধ্যায়ের বাড়ির জেঠা-গোপীনাথের পঞ্চমদোল উপলক্ষে বসে মেলা। এ ছাড়াও পুঁটো-পুঁটি জিউর দোল এবং তার সামনে দু’টি বিশাল আকৃতির গোপাল পুজো হয়। পাশাপাশি গোপালপুর অঞ্চলে বেশ কিছু ক্লাবের উদ্যোগে হয় গোপাল পুজো।

শান্তিপুরের প্রাচীন দোলগুলির মধ্যে অন্যতম শ্যামচাঁদ মন্দিরের দোল।

এর পর সপ্তম দোল। তবে এটি কোনও রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহের দোল নয়। এটি শ্রীঅদ্বৈতাচার্যের দোল বলেও পরিচিত। বড়গোস্বামী বাড়িতেও শ্রীঅদ্বৈতাচার্যের বিশেষ পূজার্চনা হয় এ দিন। বাবলায় বসে বিরাট মেলা। এই উপলক্ষে হয় সীতানাথের দোল। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে মেলা। দূরদূরান্ত থেকে হয় ভক্ত সমাগম। তবে সবচেয়ে ব্যতিক্রমী রাম নবমীতে বড়গোস্বামী বাড়ির রামচন্দ্রের দোল ও মেলা।

চৌগাচা পাড়ায় বড় গোপালের বিগ্রহ।

প্রাচীন মন্দির আর বিগ্রহবাড়ির পাশাপাশি, শান্তিপুরের বারোয়ারি দোলের আকর্ষণও কম নয়। যেমন চৌগাচা পাড়ায় বড় গোপাল এর মধ্যে অন্যতম। মূর্তির গঠনও সাবেক বাংলারীতির। পরানো হয় সোনা ও রুপোর গয়না। তেমনই পটেশ্বরীতলায় মেজগোপাল, শ্রীরাম গাঙ্গুলি লেনে ছোটগোপাল উল্লেখ্য। এ ছাড়াও চাঁদুনিপাড়া, ফটকপাড়া এবং অনামিকা ক্লাব, কুহেলির গোপাল পুজো দর্শকদের টানে। দোল উপলক্ষে ঘুরপেকে পাড়ায় হয় রাধাকৃষ্ণর পুজো। এ ছাড়াও হাওদার মধ্যে ননীচোরা গোপাল মূর্তি উল্লেখযোগ্য। তবে এ সবের পাশাপাশি দোল উপলক্ষে কয়েক হাজার গোপাল পুজো হয় শান্তিপুরের ঘরে ঘরে। উৎসবের রঙে যেন ভক্তের ভগবান দেখা দেন ঘরে ঘরে। এটাই চলে আসছে বহু কাল ধরে।

—নিজস্ব চিত্র।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement