এনজেপি থেকে দার্জিলিঙের পথে। শুক্রবার সুকনা স্টেশনে বিশ্বরূপ বসাকের ছবি।
জানলার পাশে শর্মিলা ঠাকুর। পাহাড়ের পাকদণ্ডী বেয়ে এগোচ্ছে ছোট্ট ট্রেনটি। লাইনের পাশে পাশেই হু়ড খোলা জিপে রাজেশ খন্না আর সুজিত কুমার। রাজেশের লিপে কিশোরকুমারের গান ‘মেরে সপনো কি রানি কব আয়েগি তু’। অ্যালিস্টেয়ার ম্যাকলিনের বই থেকে চোখ তুলে সে দিকে তাকাচ্ছেন শর্মিলা।
দার্জিলিং বলতেই এখনও বহু মানুষের মনে ‘আরাধনা’-র এই ছবিটাই ভেসে ওঠে। কিন্তু ওই ট্রেনটিই বন্ধ ছিল প্রায় বছর পাঁচেক। বৃষ্টিতে পাহাড়ে ধস নেমে লাইন উপড়ে যায়। সেই লাইন সারিয়ে, বারবার পরীক্ষামূলক ভাবে ট্রেন চালিয়ে শেষ পর্যন্ত শুক্রবার থেকে আবার শুরু হল এনজেপি থেকে টানা দার্জিলিং পর্যন্ত যাত্রিবাহী টয় ট্রেন। আগে একবার ঘোষণা করেও ট্রেন চালাতে না পেরে এ বার বিনা আড়ম্বরেই পরিষেবা শুরু করে দেয় রেল। তবে ওয়েবসাইটে ট্রেন চালানোর তারিখ জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
এনজেপি থেকে ট্রেনটি ছাড়বে রোজ সকাল সাড়ে আটটায়। প্রথম দিনে শিলিগুড়ি থেকে এক জন বিদেশি পর্যটক সহ ১২ জন যাত্রী নিয়ে আপ ট্রেনটি অবশ্য ছেড়েছে সকাল ৯টা নাগাদ। সওয়া দশটা নাগাদ দার্জিলিং ছাড়ে ডাউন ট্রেন। তাতে যাত্রী ছিলেন ৭০ জন। প্রথম শ্রেণির ভাড়া ২৯৫ টাকা। দ্বিতীয় শ্রেণির ৩৫ টাকা। তবে প্রথম দিন ট্রেনের টিকিট কোথা থেকে পাওয়া যাবে, তা নিয়ে গোড়ার দিকে সমস্যা তৈরি হয়। রেল কর্তৃপক্ষ টিকিট ছাড়াই আপ ট্রেনের পর্যটকদের এনজেপি থেকে ট্রেনে তুলে দেন। পরে সুকনা স্টেশনে সকলের টিকিটের ব্যবস্থা হয়।
সুকনায় যখন ট্রেনটি পৌঁছয় তখন বাইরে বৃষ্টি। চারপাশ সবুজে সবুজ দেখে স্টেশনে নেমে পড়েন অনেক যাত্রী। শুরু হয় সেলফি তোলা। তারপরে আস্তে আস্তে পাহাড়ে চড়া শুরু। আর ঠিক তখনই নামে তুমুল বৃষ্টি। ঝাপসা জানলার গায়ে তখন জলের অক্ষরে নিজের নাম লিখে রাখতে ব্যস্ত ছিল মনামি। বছর সাতেকের মনামির বাড়ি বিহারে। মা-বাবার সঙ্গে দার্জিলিং ঘুরতে এসেছে। আচমকাই এ দিন তাঁরা জানতে পারেন, টয় ট্রেনে চেপেই পৌঁছনো যাবে শৈলশহরে। তাই তাতেই চেপে বসেন তাঁরা।
ওয়েবসাইট দেখে গুয়াহাটি ভ্রমণ কাটছাঁট করে এ দিন ভোরে এনজেপি এসে পৌঁছেছেন আয়ার্ল্যান্ডের বাসিন্দা এডওয়ার্ডও। তাঁর কথায়, ‘‘এই ট্রেনের কথা অনেক শুনেছি। উতরাই ধরে কী ভাবে ট্রেন যায় সেই অভিজ্ঞতা নেওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল। ভারতে পৌঁছে জেনেছিলাম, ট্রেন নাকি বন্ধ। তারপরেই ট্রেন চালুর খবর পেয়ে চলে এসেছি।’’ বিহারের পর্যটক শ্বেতা রানির কথায়, ‘‘ছোট একটা খেলনার মতো ট্রেন হেলেদুলে পাহাড়ে উঠছে, এই অভিজ্ঞতা বলে বোঝানো সম্ভব নয়।’’ এক সময় মেঘ ছাপিয়েই ট্রেন উঠে গেল উপরে। পাহাড়ের গা থেকে দেখা গেল নীচে জমে রয়েছে ঘন মেঘের সারি। খাদের পাশ ঘেঁসে তখন ট্রেন চলেছে অতি ধীরে। গয়াবাড়ি ছাড়িয়ে পাহাড়ের উপরে মহানদী স্টেশনে পৌঁছনোর পরে আবার দেখা মিলল রোদের।
রেল কর্তৃপক্ষ অবশ্য কোনও ঝুঁকি নিতে চাননি। ডাউন ট্রেনটি বৃষ্টির মধ্যে তিনধারিয়ায় পৌঁছনোর পরে প্রায় ঘণ্টা খানেক সেখানেই দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। এই তিনধারিয়ার ধসের জন্যই এনজেপি-দার্জিলিং যাতায়াত বন্ধ ছিল টয় ট্রেনের। বেশ কিছু দিন ধরে ট্রেন চলত কেবল শিলিগুড়ি জংশন থেকে তিনধারিয়া ও দার্জিলিং থেকে ঘুম পর্যন্ত। এ বার পুরো রুটে ট্রেন চলাচল শুরু হতে শিলিগুড়ি জংশনের চিফ কমার্শিয়াল ইনস্ট্রাকটর রাজদীপ বসু নিজেই আপ ট্রেনটিতে পর্যটকদের সঙ্গে সুকনা পর্যন্ত যান। তারপরেও পর্যটকদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ রেখেছেন তিনি।
আপ ট্রেনটি সন্ধ্যা সাতটা দশে দার্জিলিং পৌঁছেছে। তারপরে গার্ড রবি প্রকাশ বলেন, ‘‘চাকরি পাওয়ার পর থেকেই মনে হত কবে যাত্রীদের নিয়ে টয় ট্রেনে করে পাহাড়ের রানির কাছে পৌঁছব। এ বার সেই স্বপ্ন পূরণ হল।’’