ছেঁড়া কাগজ থেকে রঙিন ফুলের গোছা বার করে আনতে জাদুকরেরও কিছুটা সময় লাগে। কিন্তু সরকার বাহাদুরের প্রতিশ্রুতির ছাপ মারা নোট ছুমন্তরে কী ভাবে নিমেষে স্রেফ রদ্দি কাগজে পরিণত হয়ে যায়, হাড়ে হাড়ে তা টের পাচ্ছেন দেশি-বিদেশি পর্যটকেরা।
পাঁচশো আর হাজার টাকার নোট রাতারাতি বাতিলের রামধাক্কা পেড়ে ফেলেছে আমজনতাকে। তবু যাঁরা ঘরে থেকে সমস্যা সামলানোর চেষ্টা করছেন, তাঁদের তুলনায় পর্যটকদের হয়রানি অনেকটাই আলাদা। বাড়িতে বসে ব্যাগ-আলমারি হাতড়ে একশো টাকার নোট খোঁজা এক জিনিস। তার সঙ্গে ভ্রমণার্থীদের বিড়ম্বনার তুলনাই চলে না। বাড়ি থেকে কয়েকশো কিলোমিটার দূরে পর্যটকেরা হঠাৎ দেখলেন, হাতে থাকা টাকাগুলো কাগজে পরিণত হয়ে গিয়েছে! থাকা, খাওয়া বা ভ্রমণের রসদ জোগানোর ক্ষমতা খুইয়েছে সেই সব নোট। অগত্যা পেটে কিল মেরে কোনও ভাবে বাড়ি ফেরার রাস্তা খুঁজছেন বেড়াতে বেরোনো মানুষজন।
নির্ঝঞ্ঝাটেই সপরিবার দার্জিলিঙে পৌঁছেছিলেন উত্তর কলকাতার বাসিন্দা গৌরী বসু। পাঁচশো-হাজার টাকার নোট বেশি ছিল তাঁদের কাছে। বেড়াতে গেলে যেমনটা হওয়ার কথা। মঙ্গলবার রাতে হঠাৎ শুনলেন, বড় নোট বাতিল। গাড়ি-হোটেল-খাবার— পাঁচশো বা হাজার টাকার নোট দিয়ে বিল মেটানো যাবে না। এটিএম খুঁজে বার করে লম্বা লাইন ঠেলে মেশিনে যখন পৌঁছলেন, একশো টাকার নোট তত ক্ষণে শেষ। সন্ধে থেকেই বমি-মাথাব্যথা শুরু হয়েছিল গৌরীদেবীর। ওষুধটুকুও কিনতে পারেননি রাতে।
প্রায় একই অবস্থা বালিগঞ্জের গোপা সেনগুপ্তের। বললেন, ‘‘ছ’জনে রাজাভাতখাওয়ায় এসেছি। কয়েক দিন থাকার কথা। বন উন্নয়ন নিগমের লজ বুকিংয়ের টাকা অনলাইনে আগেই জমা দিয়েছি। এখন যে-টাকা আছে, তার বেশির ভাগই পাঁচশো-হাজার টাকার নোট। কিন্তু সেগুলো চালানোর রাস্তা বন্ধ। কী করব, বুঝতে পারছি না। বেড়ানোটাই মাটি হতে বসেছে।’’
৩৭ জনের দল নিয়ে উত্তরাখণ্ড সফরে বেরিয়েছেন কলকাতার একটি ভ্রমণ সংস্থার ম্যানেজার আশিস বিশ্বাস। কৌশানি থেকে ফোনে জানালেন, নোট বাতিলের ঘোষণায় বেড়ানোর আনন্দ ভুলতে বসেছেন পর্যটকেরা। কোনও দোকান বড় নোট নিচ্ছে না। ‘‘আমাদের যেটুকু যোগাযোগ রয়েছে, তাতে হোটেল বা গাড়ির টাকা কলকাতায় ফিরে পাঠিয়ে দেওয়া যাবে ব্যবসায়ীদের অ্যাকাউন্টে। কিন্তু এত লোককে খাওয়াব কী,’’ মহাচিন্তিত আশিসবাবু। আজ, বৃহস্পতিবার তাঁদের ফেরার কথা। দলের ছ’জনের আরও কয়েকটা দিন থাকার কথা ছিল উত্তরাখণ্ডে। কিন্তু আতঙ্কে ফিরে আসছেন তাঁরাও।
হিমাচলপ্রদেশ সফর করছেন পাটুলির বাসিন্দা জয়িতা মিত্র। ম্যাকলয়েডগঞ্জ থেকে জানালেন, মঙ্গলবার রাতে নোট বাতিল ঘোষণার পরে এই ছোট্ট পাহাড়ি এলাকায় হুড়োহু়ড়ি পড়ে যায়। একটি মাত্র এটিএমে একশো টাকা নোট পাওয়া যাচ্ছিল তখনও। বড় নোট বাতিলের ঘোষণার পরে শ’খানেক পর্যটকের সঙ্গে জয়িতাও লাইন দেন রাত ১২টা পর্যন্ত। নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেন, দু’বারের বেশি কেউ টাকা তুলবেন না। কিন্তু রাত ১২টায় এটিএমে লেনদেন বন্ধ হয়ে যায়। তখনও বহু মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে। ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড থাকায় হোটেলে বা বড় রেস্তোরাঁয় সমস্যা হচ্ছে না। ‘‘কিন্তু অনেক ছোট ছোট খাবারের দোকানে কার্ডে লেনদেন হয় না। বেড়াতে এসে বড় নোট হাতে নিয়েও যে এমন সমস্যায় পড়ব, তা স্বপ্নেও ভাবিনি,’’ অসহায় শোনাল জয়িতার গলা।
বিদেশি পর্যটকদের সমস্যা গুরুতর। টরন্টোর বাসিন্দা মারিয়া সাফেজ এই নিয়ে কুড়ি বার ভারতে এলেন। প্রতি বারের মতো এ বারেও এ দেশে পা রেখেই ডলারের বদলে টাকা সংগ্রহ করেছেন। তাঁর কাছে ৫০-৬০টা পাঁচশো টাকার নোট রয়েছে। কিন্তু যাঁরা বিদেশি অর্থ বদল করে দেন, তাঁরা ঝাঁপ ফেলে দিয়েছেন মঙ্গলবার রাতেই। ম্যাকলয়েডগঞ্জের কাছাকাছি বিমানবন্দর বলতে কাংড়া। গাড়িতে যেতে কম করে ঘণ্টা দুয়েক সময় লাগবে মারিয়ার। ‘‘এত বার এসেছি, কখনও এত অসহায় লাগেনি। এখন কী করব, বুঝতে পারছি না,’’ মারিয়া দিশাহারা।
সমীরবরণ সাহা মঙ্গলবার ছিলেন উত্তরবঙ্গের জলপাহাড় রোডের একটি হোটেলে। বড় নোট বাতিলের খবর পেয়ে একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের এটিএমে গিয়ে দেখেন, মেশিন কাজ করছে না। সেটাই এলাকার একমাত্র এটিএম। মাথায় হাত পর্যটকদের। তবে হোটেল-কর্তৃপক্ষ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন বলে জানান কিছু পর্যটক। কিছু হোটেলে বিদেশিদের পাঁচশো-হাজার টাকার নোটের বদলে একশো টাকার নোট দেওয়া হচ্ছে। ওই সব হোটেলে তাই লম্বা লাইন।
বুধবার রাতের ট্রেনে দার্জিলিং থেকে ফিরছেন সঞ্জয় সরকার। ‘‘ট্যুরটা দারুণ ছিল। কিন্তু শেষ বেলায় এই সমস্যা! কোনও রকমে এনজেপি স্টেশনে পৌঁছই। কিন্তু শিয়ালদহ থেকে কী করে বাড়ি যাব, বুঝতে পারছি না,’’ বললেন সঞ্জয়।
টালিগঞ্জের সৌরভ সামন্ত কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে ট্রেকিংয়ে গিয়েছিলেন সিকিম। মঙ্গলবার রাতে এনজেপি থেকে ট্রেনে উঠেই শোনেন, পাঁচশো-হাজারের নোট বাতিল। বুধবার সকালে শিয়ালদহে নেমে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে গিয়েই মাথায় হাত। পাঁচশো টাকার নোট নিতে রাজি নন কোনও ট্যাক্সিচালক। একশো টাকার নোট দু’-একটা পড়ে ছিল তাঁদের কাছে। তাতে সকলের বাড়ি ফেরা সম্ভব নয়। সৌরভ বললেন, ‘‘ট্রেকিংয়ে গেলে কত রকম বিপদের কথা ভাবতে হয়। কিন্তু নিরাপদে ট্রেকিং শেষ করে নিজের শহরে পা দিয়ে পকেটে যথেষ্ট টাকা থাকা সত্ত্বেও যে এমন বিপদে পড়তে হবে, সেটা ভাবিনি!’’