ডাঁটা চচ্চড়ি তো সবাই জানে। কাঁটা চচ্চড়িও। কিন্তু পাঁঠা চচ্চড়ি?
বাঁধাকপির মূল ডাঁটা, পাঁঠার বাঁ দিকের পাঁজরের হাড়, ছ’টা কাঁচালঙ্কা, আদা...। এটাই পাঁঠা চচ্চড়ির রেসিপি। তপন সিংহের ছবি ‘গল্প হলেও সত্যি’-র একান্নবর্তী পরিবারে সদ্য রান্নার কাজে যোগ দিতে আসা ধনঞ্জয় জানিয়েছিলেন, কাঁটা চচ্চড়ি রান্না সোজা ব্যাপার, তিনি পাঁঠা চচ্চড়ি খাওয়াতে পারেন। কিংবা কই মাছ, জিরে, শশার বিচি দিয়ে রাঁধা পদ। আবার কাঁচা আমড়া ছেঁচে, সর্ষে দিয়ে স্পেশ্যাল চাটনিও তাঁর করায়ত্ত।
অভিনব বাঙালি রান্না নিয়ে ‘ধনঞ্জয়’ রবি ঘোষের বক্তব্য ছিল, ‘‘রান্না একটা শিল্প। সমস্ত শিল্পেই যেমন নতুন নতুন সৃষ্টি হয়, রান্নাতেও হবে না কেন?’’
বাংলার রন্ধনশিল্পের এ হেন সৃষ্টিসম্ভার গোটা দুনিয়াকে জানাতে ও সে সবের সুলুক-সন্ধান দিতে রাজ্য পর্যটন দফতর এ বার আনছে ওয়েবসাইট— www.bengalcuisine.in। যেখানে বাঙালি রান্নার ইতিহাস-ভূগোল, অতীত-বর্তমান, টক-ঝাল, তেতো-মিষ্টি সব কিছুর হদিস মিলবে। পর্যটন দফতর সূত্রের খবর, আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই সবার জন্য চিচিং-ফাঁক হবে ‘বেঙ্গল ক্যুইজিন’-এর রত্ন-দরজা। অর্থাৎ, সুকুমার রায়ের অমর ‘খাই খাই’-এর মোক্ষম দু’লাইন ধার করে বলা যায়, ‘যত কিছু খাওয়া লেখে বাঙালির ভাষাতে / জড় করে আনি সব, থাক সেই আশাতে...।’
হোমপেজ খুললেই স্বাগত জানাবে ধবধবে লুচি, বেগুনভাজা, নারকোল দেওয়া ডাল, মাছের চপ, পোলাও, সর্ষে ইলিশ, মাংস, চাটনি, ছানার পায়েসের বিপুল সম্ভার। আর বাঙালির জীবনে-মননে ও অবশ্যই পাকস্থলিতে গাঁথা হয়ে যাওয়া সেই ছবি, যেখানে ভূতের রাজার বরে বলীয়ান গুপী গাইন-বাঘা বাইন তালি মেরে চর্ব্য-চুষ্য-লেহ্য-পেয় আনিয়ে খাচ্ছে কব্জি ডুবিয়ে।
তার পর যত ওই সাইটে ঢোকা যাবে, ততই পরতে পরতে খুলতে থাকবে বাংলার ভোজ্য-দুনিয়া, তার ইতিহাস, তার স্বাদের রহস্য বা রন্ধনপ্রণালী, কোন সৃষ্টি কোথায় মিলবে তার ঠিকানা, মহান মানুষদের পছন্দের খাবার— এ রকম আরও কত কী! নিম-বেগুন থেকে শোল-মুলো, কচুবাটা থেকে চালতার টক, পার্শে পোস্ত থেকে এলোঝেলো— শতাধিক বাঙালি খাবার ও সেগুলোর রেসিপি পাওয়া যাবে ওয়েবসাইটে।
আর কলকাতা তো বটেই, সেই সঙ্গে কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ— কোথায় কোন জায়গায় এই সব খাবার-দাবার চেখে দেখা যেতে পারে, মিলবে তারও সন্ধান। ঝাল টাবাস্কো সসে স্বামী বিবেকানন্দের কাবু না হওয়া, নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবীর রাঁধা কুচো চিংড়ি দেওয়া চচ্চড়ির প্রতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুর্বলতা এবং জিলিপি ও সন্দেশের প্রতি রামকৃষ্ণদেবের ভক্তির কাহিনিও বিস্তারিত জানা যাবে। সেই জন্যই ওই সাইটের ওয়েব পেজের সংখ্যা পাঁচশো ছাড়িয়ে গিয়েছে।
ট্যুর অপারেটরদের একাংশের বক্তব্য, কোনও রাজ্যের পর্যটন দফতর সেই রাজ্যের খাবার নিয়ে আস্ত একটা ওয়েবসাইট তৈরি করেছে, এমন নজির এ দেশে সম্ভবত এ-ই প্রথম।
কিন্তু বাংলার খাবার নিয়ে এই উদ্যোগে পর্যটন শিল্পের কী লাভ?
পর্যটনমন্ত্রী ব্রাত্য বসুর বক্তব্য, ‘‘এই ওয়েবসাইট পর্যটকদের এখানে আসতে যেমন উৎসাহ দেবে, আবার কৃষ্ণনগর, কোচবিহার বা বিষ্ণুপুরের কোথায় গিয়ে বাঙালি খাবার বা মিষ্টি পাওয়া যাবে, সেটাও তাঁরা জানতে পারবেন।’’ মন্ত্রী বলেন, ‘‘বাংলার পর্যটনের সঙ্গে খাবার ওতপ্রোত। কারণ, বাংলার কৃষ্টি-সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালির খাদ্যাভ্যাস।’’
পর্যটন দফতর মনে করছে, কলকাতায় স্বামী বিবেকানন্দের বাড়িতে যে পর্যটক যেতে চান, তিনি বিধান সরণিতে চপ-কাটলেটের রেস্তোরাঁ ও রামদুলাল সরকার স্ট্রিটে সন্দেশের দোকানের সন্ধান পেলে আরও আকৃষ্ট হবেন। কৃষ্ণনগর ও সরপুরিয়ার ক্ষেত্রেও সেটা প্রযোজ্য।
ট্যুর অপারেটরদের সংগঠন ‘ওয়ার্ল্ড ফু়ড ট্র্যাভেল অ্যাসোসিয়েশন’-এর সদস্য শুদ্ধব্রত দেব জানালেন, ভারতের মোটামুটি পাঁচ ধরনের খাবার আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত বলে ধরা যায়— কাশ্মীরি, পঞ্জাবি, অবধি, বাঙালি ও মালাবারি। তাই বাংলাকে বিশ্বের দরবারে গুরুত্বপূর্ণ পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে তুলে ধরার পক্ষে এই ওয়েবসাইট বড় ভূমিকা নিতে পারে বলে তিনি মনে করেন। বিদেশি পর্যটকদের জন্য কলকাতায় ‘স্ট্রিট ফু়ড ওয়াক’ চালু করা শুদ্ধব্রতবাবুর কথায়, ‘‘এতে বাংলার পর্যটন শিল্পের যেমন সামগ্রিক প্রসার হবে, তেমনই উন্নতি হবে ছোটখাটো হোটেল-রেস্তোরাঁর।’’
এই ধরনের পর্যটনের আর এক পুরোধা তথা ‘অ্যাসোসিয়েশন ফর কনজারভেশন অ্যান্ড ট্যুরিজম’-এর প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক অসিত বিশ্বাসও আশাবাদী। তিনি মনে করেন,
বাংলার খাবার ঘিরে সম্ভাব্য পর্যটনের বাজার একেবারে তৈরি। বিশেষ করে যেখানে গত কয়েক বছরে মোচার ঘণ্ট, পেঁয়াজ পোস্তর মতো বাঙালির হেঁশেলের আদি খাবার ফেরাতে উদ্যোগী হয়েছে কয়েকটি রেস্তোরাঁ। একটি সর্বভারতীয় রেস্তোরাঁ-চেনের কর্ণধার অঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ও বলছেন, ‘‘এখন খাওয়া-দাওয়া বাদ দিয়ে পর্যটন সম্ভব নয়। রাজ্য সরকারের এই ওয়েবসাইট ভিন্ রাজ্যের ও ভিন্ দেশের পর্যটকদের আরও বেশি করে বাংলামুখী করে তুলবে।’’
তবে এই সাফল্যের কিছু শর্তও আছে। যেমন, স্বাস্থ্যবিধি, যেমন পরিকাঠামো। ধরা যাক, সড়ক। পর্যটক হয়তো সাইট ঘেঁটে মনের মতো খাবারের সন্ধান পেলেন। কিন্তু ভাঙা রাস্তা পেরিয়ে গন্তব্যে পৌঁছতেই যদি তাঁর প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠে, স্বাভাবিক ভাবেই পেটপুজোর ইচ্ছেটা উবে যাবে। এ সম্পর্কে অবশ্য পর্যটন ব্যবসায়ীরাও ওয়াকিবহাল। ইস্টার্ন হিমালয়া ট্র্যাভেল অ্যান্ড ট্যুর অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশন-এর কার্যকরী সভাপতি সম্রাট সান্যাল বলেন, ‘‘শুধু ওয়েবসাইট দিয়ে কিন্তু হবে না। খাবার যাতে পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যসম্মত ভাবে তৈরি হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। পরিকাঠামোও দরকার। যাতে বেলাকোবার বিখ্যাত চমচম খেয়ে পর্যটক গজলডোবায় থাকতে পারেন।’’
‘অ্যাসোসিয়েশন ফর কনজারভেশন অ্যান্ড ট্যুরিজম’-এর অসিতবাবুও বলছেন, ‘‘পর্যটক টানতে রাস্তাঘাট, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিও দরকার। না হলে শুধু এই ওয়েবসাইট খারাপ স্বাস্থ্যের উপরে পমেটমের প্রলেপ হয়েই থাকবে।’’