Housewife

লালবাজার, নবান্ন হয়ে এ বার ফেসবুকেই সুবিচার চাইলেন বধূ

ফুলে যাওয়া মুখ, লাল হয়ে যাওয়া গাল-চোখ, রক্তে ভেজা জিভ, ছড়ে যাওয়া হাত— একের পর এক ছবি দিয়ে অদিতি অত্যাচারের অভিযোগ তুলেছেন তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে। স্বামীর ‘বিবাহবহির্ভূত’ সম্পর্কের কথা জানতে পারার পর থেকেই তাঁর উপর অত্যাচার শুরু হয় বলে ওই তরুণীর দাবি।

Advertisement

উজ্জ্বল চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০১৭ ১৫:৫৫
Share:

ফেসবুকে সাহায্য চাইলেন অদিতি। ছবি: ফেসবুকের সৌজন্যে।

প্লিজ হেল্প মি! ফিলিং ভেরি হেল্পলেস!

Advertisement

প্লিজ হেল্প মি টু গেট আ প্রপার জাস্টিস!

এই দু’লাইনের মধ্যে আরও আট-ন’টি বাক্য। স্বল্প সেই পরিসরে নিজের অত্যাচারিত হওয়ার কাহিনি শুনিয়েছেন অদিতি। শেষে সুবিচার চেয়েছেন। না, কোনও পুলিশকর্তার কাছে এই আবেদন করেননি। প্রশাসনের কোনও উচ্চপদস্থের কাছেও নয়। এমনকী, কোনও নামী আইনজীবীর কাছেও এই দাবি জানাননি অদিতি। ফেসবুকে নিজের কাহিনি শুনিয়ে বিচার চেয়েছেন আমজনতার দরবারে। আবেদন জানানোর পাশাপাশি অত্যাচারের ‘নমুনা’ হিসেবে গোটা দশেক ‘রক্তাক্ত’ ছবি পোস্ট করেছেন।

Advertisement

আরও পড়ুন- বোরখার ফাঁকে জয়ীর চোখ

অথচ গত ২০ অগস্ট এই লেখা-ছবি পোস্ট করার আগে পর্যন্ত অদিতি নন্দী ঘোষের কাছে ফেসবুকের মানে একেবারে অন্য ছিল। নিজের জীবনের নানা খুশির মুহূর্তই তিনি সেই ২০১০ থেকে পোস্ট করেন। কখনও নিজের সাজগোজ করা ছবি, তো কখনও স্বামীর সঙ্গে কোথাও ঘুরতে যাওয়া, কখনও আবার গৃহদেবতার ছবি— এ সবই পোস্ট করতেন তিনি। কিন্তু সেই ফেসবুকই যে তাঁর সঙ্গে ঘটে চলা ‘অন্যায়’-এর প্রতিবাদের মাধ্যম হতে পারে, ‘সুবিচার’ চাওয়ার অন্যতম অবলম্বন হতে পারে, তা কখনও ভাবেননি বছর তিরিশের ওই তরুণী। তাঁর কথায়: ‘‘আনন্দের মুহূর্তই এত দিন শেয়ার করেছি। কিন্তু, এখন আমার পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গিয়েছে। আইনি ব্যাপারগুলো একদমই বুঝি না। তাই, ফেসবুকেই নিজের সমস্যার কথা তুলে ধরেছি। দেখি কোনও সুরাহা মেলে কি না!’’ আদালতে মামলা চলছে। লালবাজার থেকে নবান্ন— সব জায়গায় বিচার চেয়ে আবেদন জানিয়েছেন। এ বার সোশ্যাল মিডিয়ার দরবারেও ‘সুবিচার’ চাইলেন ওই তরুণী।

ফুলে যাওয়া মুখ, লাল হয়ে যাওয়া গাল-চোখ, রক্তে ভেজা জিভ, ছড়ে যাওয়া হাত— একের পর এক ছবি দিয়ে অদিতি অত্যাচারের অভিযোগ তুলেছেন তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে। স্বামীর ‘বিবাহবহির্ভূত’ সম্পর্কের কথা জানতে পারার পর থেকেই তাঁর উপর অত্যাচার শুরু হয় বলে ওই তরুণীর দাবি। একা স্বামী নন, শাশুড়ি থেকে ননদ— শ্বশুরবাড়ির সকলেই তাঁকে মারধর করতেন বলে তাঁর অভিযোগ। এমনকী, তাঁর স্বামীর সঙ্গে যাঁর সম্পর্ক আছে বলে অভিযোগ, সেই মহিলা এবং তাঁর স্বামীও অদিতিকে মারধর করেছেন। স্বামী-সহ বাকিদের বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টার অভিযোগও করেছেন সরশুনার ওই বাসিন্দা। তাঁর দাবি, ‘‘আমি গোটা ঘটনার কথা জানিয়ে নবান্ন, কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার— প্রত্যেককেই জানিয়েছি। এখনও আমার সঙ্গে কোনও রকম যোগাযোগ করা হয়নি।’’

আরও পড়ুন- কানহাইয়াকে কালি দিতে গিয়ে প্রহৃত

যদিও অদিতির স্বামী তাঁর বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগ মানতে চাননি। তাঁর দাবি, ‘‘কোনও মহিলার সঙ্গেই আমার কোনও সম্পর্ক ছিল না। অদিতিরই বরং এক যুবকের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। সে কথা জানতে পেরেই ওকে বলেছিলাম। তার পর ওরা দু’জনে মিলে আমাকে মারধর করে। আমার মায়ের উপরেও অত্যাচার চালাত ও। আমাকে মিথ্যে অভিযোগে ফাঁসানো হয়েছে।’’ আদালতে বিষয়টি বিচারাধীন বলে এ নিয়ে আর কোনও মন্তব্য করতে চাননি তিনি।

মঙ্গলবার অদিতি জানালেন, তাঁর বাপের বাড়ি হুগলি জেলায়। কিন্তু ছোট থেকেই তিনি নবদ্বীপে পিসির বাড়িতে মানুষ। স্কুলের পড়াশোনা শেষে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক এবং পরে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ এবং বিএড করেন। ২০১৩ সালে বিয়ে হয়েছিল সরশুনায়। স্বামীর সঙ্গে মিলে সরশুনাতেই একটি ‘বিউটি পার্লার’ খোলেন। সেই পার্লারের উল্টো দিকেই তাঁর বোনের ফ্ল্যাট আছে। বোন বিয়ের পর দুবাই চলে যাওয়ায় অদিতিই সেই ফ্ল্যাটটি দেখভাল করেন। শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে কয়েক মাস ধরে এখন অদিতি সেখানেই থাকেন।

অদিতির অভিযোগ, তাঁর পার্লারে এক যুবতী কাজ করতেন। সেই মহিলার সঙ্গেই তাঁর স্বামীর সম্পর্ক রয়েছে। তাঁর দাবি, বোনের ফ্ল্যাটে এক বার দু’জনকে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখে ফেলেন তিনি। তার পর থেকেই অত্যাচারের মাত্রা বাড়ে। অদিতির কথায়: ‘‘বিয়ের চার বছরে ওর সঙ্গে একাধিক বার মনোমালিন্য হয়েছে। কোনও দিন গায়ে হাত তোলেনি। কিন্তু, ও ভাবে দেখে ফেলার পর আমাকে পুড়িয়ে মারার হুমকিও দেওয়া হয়। গায়ে কেরোসিন ছিটিয়ে দিতেও পিছপা হয়নি ও।’’

অদিতির সেই ফেসবুক পোস্ট...

তবে, আগে না ঘটলেও মারধরের সূত্রপাতটা গত ২৫ ফেব্রুয়ারি বলে জানিয়েছেন অদিতি। বিবাহবার্ষিকীতে পুরী গিয়ে তা শুরু হয়। সেই ছবিও তিনি ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। কিন্তু, ‘মদ্যপ’ অবস্থায় গায়ে হাত তুলেছেন বলে তাঁর স্বামী ভুল স্বীকার করায় তিনি নাকি স্বামীকে ‘ক্ষমা’ও করে দেন। গত ২৭ এপ্রিল ফের মারধর করা হয় তাঁকে। তার আগের দিনই স্বামীকে ওই মহিলার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখেন তিনি। তার পরেই সরশুনা থানায় অভিযোগ দায়ের করেন অদিতি। ওই অভিযোগ তুলে নেওয়ার কথা বলে তাঁর স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেন বলে অদিতির অভিযোগ।

আরও পড়ুন- আক্ষেপ, এমন রায় কেন আগেই হলো না!

এর পর নবদ্বীপে পিসির বাড়ি চলে যান অদিতি। কিন্তু, স্বামী তাঁকে ফিরিয়ে আনেন সরশুনায়। কিন্তু অদিতির দাবি, ফিরিয়ে নিয়ে আসার পরে একটুও বদলাননি তাঁর স্বামী। শুরু হয় মারধর। গত ২৩ জুন তাঁর স্বামীর সঙ্গেই পার্লারের ওই মহিলা ও ওই মহিলার স্বামী— তিন জন মিলে তাঁকে প্রচণ্ড মারধর করেন। সঙ্গে যোগ দেন অদিতির শাশুড়ি ও ননদ। শেষে তাঁর ভাইকে কোনও মতে ফোন করে পুলিশকে জানাতে বলেন অদিতি। ১০০-য় ডায়াল করে অভিযোগ জানান তাঁর ভাই। লালবাজারের নির্দেশে সরশুনা থানার পুলিশ এসে অদিতিকে উদ্ধার করে।

এর পর অদিতি এফআইআর করেন। যদিও এই মামলার তদন্তকারী অফিসার জানান, প্রথমে তাঁরা দু’পক্ষের মধ্যে মিটমাটের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু অদিতি রাজি হয়েও পরে বেঁকে বসায় ৪৯৮ ধারায় তাঁর স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির লোকেদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। এর পর গ্রেফতারও করা হয় তাঁদের। পরে তাঁরা আদালত থেকে জামিন পেয়ে যান। বুধবার সরশুনা থানার এক অফিসার বলেন, ‘‘বিষয়টি বিচারাধীন। আগামী ২০ ডিসেম্বর ফের শুনানি। তাই এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাই না।’’ পাশাপাশি তাঁর প্রশ্ন, আদালতে বিচার চেয়ে মামলা চলছে। তার মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় এ ভাবে ‘সুবিচার’ চাওয়ার মানে কী?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement