partha chatterjee

Partha Chatterjee: পার্থকে নিয়ে অনর্থ সামলাতে জোড়া কৌশল শাসক তৃণমূলের, গরমে মমতা, নরমে অভিষেক

পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও মন্ত্রীর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ, তার অভিঘাত যে কম নয়, গত কয়েকদিনে তা বিলক্ষণ বুঝেছে শাসক তৃণমূল।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০২২ ২২:০১
Share:

পার্থ-কাণ্ড সামাল দিতে আসরে মমতার সঙ্গে অভিষেকও। ফাইল চিত্র।

এক হাতে অনুশাসনের চাবুক। অন্য হাতে বরাভয়। পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে কেন্দ্র করে উদ্ভুত বেনজির সঙ্কট সামলাতে এই জোড়া কৌশল নিয়েছে শাসক তৃণমূল। প্রথমটি শুরু করেছেন দলের সর্বময় নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দ্বিতীয় পন্থা নিয়েছেন দলের অন্যতম শীর্ষনেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতা যখন কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়ে পার্থকে মন্ত্রিসভা থেকে ছেঁটে ফেলেছেন, তখন অভিষেক নিজে উদ্যোগী হয়ে আলোচনার রাস্তা খুলেছেন এসএসসি চাকরি নিয়ে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে।

Advertisement

অভিযুক্ত পার্থের ‘ঘনিষ্ঠ’ মডেল-অভিনেত্রী অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের ফ্ল্যাট থেকে কোটি কোটি টাকা, অলঙ্কার এবং বিবিধ সম্পত্তির দলিল উদ্ধার হয়েছে। এখন আসছে একের পর এক ‘বেনামি’ সম্পত্তির খোঁজ। টিভি-তে টাকার পাহাড় দেখে সচকিত গোটা রাজ্য। শুধুমাত্র দৃশ্যাবলির অভিঘাতে তৃণমূলের কাছে এই ঘটনা সারদা বা নারদ-কাণ্ডের চেয়েও অনেক বেশি অস্বস্তির।

একই সঙ্গে অন্য যে কোনও নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার তুলনায় পার্থের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ ওঠা এবং সেই অভিযোগে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার তাঁকে গ্রেফতার করা অনেক বেশি উদ্বেগের। কারণ, পার্থ প্রথম দিন থেকে তৃণমূলের প্রথম সারির নেতা। তিনিই দলের প্রথম মহাসচিব। দল ক্ষমতায় আসার পর থেকে টানা মন্ত্রী। সদ্যপ্রাক্তন হওয়ার আগে পর্যন্তও একই সঙ্গে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দফতরের ভার ছিল তাঁর হাতে।

Advertisement

এমন একজন শীর্ষনেতার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ ওঠার প্রাথমিক অভিঘাতে খানিকটা হতচকিত হয়ে গিয়েছিল গোটা দল। কারণ, তৃণমূলের ইতিহাসে এমন সঙ্কট নজিরবিহীন! ফলে তা সামাল দেওয়াও সহজ নয়। প্রথম থেকেই মেপে পা ফেলেছে তৃণমূল। প্রথমে প্রকারান্তরে পার্থের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও দেখা গিয়েছে, তাতে লাভের চেয়ে ক্ষতিই হচ্ছে বেশি। তখন থেকেই সঙ্কট মোচনে দ্বিমুখী কৌশল নিয়েছে রাজ্যের শাসকদল।

দলের শীর্ষ স্তরে আলোচনার পর মমতা তাঁর পুরনো সহকর্মী পার্থ সম্পর্কে কড়া পদক্ষেপ নিয়েছেন। তাঁকে মন্ত্রিত্ব থেকে ছেঁটে ফেলে ‘কঠোর’ হওয়ার বার্তা যেমন দিয়েছেন, তেমনই মুখেও বলেছেন, ‘‘আমাদের দল খুব কঠোর।’’ প্রশাসনিক স্তরে পার্থের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার মাধ্যমে মমতা বোঝাতে চেয়েছেন, তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনও ধরনের আপসে বিশ্বাসী নন। যত বড় নেতা বা মন্ত্রীই হোন না কেন, রাজ্যের প্রধান প্রশাসক হিসেবে তাঁর বিরুদ্ধেও তিনি কঠোরতম ব্যবস্থা নিতে পারেন।

ঘটনাচক্রে, পার্থকে যে তিনি মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দিতে চলেছেন, সে বিষয়ে বৃহস্পতিবার রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে কোনও আঁচ দেননি মমতা। পার্থকে নিয়ে মন্ত্রিসভার সদস্যদের সঙ্গে কোনও আলোচনাই করেননি তিনি। রুটিন আলোচ্যসূচি মেনেই মন্ত্রিসভার বৈঠক হয়েছে। কিন্তু ওই বৈঠকের পরেই পার্থকে মন্ত্রিত্ব থেকে সরানোর বিষয়ে সরকারি বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছে।

এরই পাশাপাশি, একই দিনে অভিষেক কথা বলেন আন্দোলনকারীদের নেতৃস্থানীয়দের সঙ্গে। তাঁদের তিনি জানান, শুক্রবার বিকেলে নিজের দফতরে তিনি তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করতে চান। সেই মতো আন্দোলনকারীদের মধ্যে বাছাই প্রতিনিধিদের নিয়ে আসেন তৃণমূলের মুখপাত্র তথা দলের রাজ্য সম্পাদক কুণাল ঘোষ। বৈঠকে ডাকা হয় শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুকেও। সেখানে দীর্ঘ সময় ধরে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনা করেন অভিষেকরা। বৈঠকের শেষে আন্দোলনকারীরা বেরিয়ে এসে জানান, তাঁরা ‘সন্তুষ্ট’। অর্থাৎ, গোটা বিষয়ে শাসক তৃণমূলের ‘নমনীয়’ মনোভাব তাঁদের মধ্যে খানিকটা হলেও আস্থা তৈরি করতে পেরেছে। তাঁরা আরও জানান, অভিষেক যথেষ্ট ‘মানবিক’ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন।

ঘটনাচক্রে, এসএসসি চাকরির জন্য আন্দোলনকারীদের সঙ্গে অভিষেকের আলোচনা চলার সময়েই ক্যামাক স্ট্রিটে অভিষেকের দফতরের সামনে পৌঁছে যান টেট-উত্তীর্ণরা। তাঁরাও দাবি করেন, তাঁদের সমস্যা সমাধানের জন্য তাঁদেরও অভিষেকের সঙ্গে দেখা করতে দিতে হবে। অভিষেকের দফতর থেকে তাঁদের জানানো হয়, আগামী সপ্তাহে অভিষেক তাঁদের সঙ্গে কথা বলবেন। কিন্তা তাতে তাঁরা ক্ষান্ত হননি। রাত পর্যন্ত তাঁদের অবস্থান-বিক্ষোভ এবং স্লোগান চলছে ক্যামাক স্ট্রিটে। আন্দোলকারীদের মধ্যে দু’জন অসুস্থ হওয়ায় তাঁদের অ্যাম্বুল্যান্স আনিয়ে হাসপাতালে পাঠাতে হয়েছে। কিন্তু অভিষেক এক বারেও বলেননি যে, তাঁদের সঙ্গে দেখা করবেন না। অর্থাৎ, এ ক্ষেত্রেও অভিষেক ‘নমনীয়’ হওয়ার কৌশল নিয়েছেন। যে কোনও বিক্ষোভ সামলাতে যা সবচেয়ে আগে হওয়া প্রয়োজন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসলে সমস্যা সমাধানের পথে এগনো যায়। জেদ ধরে না-থেকে অভিষেক সেই রাস্তাতেই চলা শুরু করেছেন। যখন মমতা কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার রাস্তায় হাঁটছেন।

গত শুক্রবার যখন পার্থের বাড়িতে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) তাঁকে জেরা করতে গিয়েছিল, তখন থেকে পরিস্থিতির সাপেক্ষে বিভিন্ন সময়ে নীতি বদল করেছে তৃণমূল। প্রথমে ২১ জুলাইয়ের পর দিন ভোরেই কেন জেরা, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। কিন্তু শুক্র-সন্ধ্যায় অর্পিতার ফ্ল্যাট থেকে কোটি কোটি টাকা উদ্ধারের খবর পেতেই দূরত্ব তৈরির প্রাথমিক পদক্ষেপ করে তৃণমূল। দলের তরফে কুণাল বলে দেন, ‘‘এর সঙ্গে দলের কোনও সম্পর্ক নেই। যাঁদের থেকে টাকা উদ্ধার, তাঁরাই জবাব দেবেন।’’ কিন্তু তার পর থেকে পরিস্থিতি দ্রুত বদল হতে থাকে। সঙ্কটও বাড়তে থাকে। বাধ্য হয়েই মমতাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয় পার্থকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেওয়ার।

প্রসঙ্গত, গত বিধানসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণার পরে পরেই নারদ-কাণ্ডে ফিরহাদ হাকিম, মদন মিত্র এবং শোভন চট্টোপাধ্যায়কে সিবিআই গ্রেফতার করার পর তৃণমূল যে পথে চলেছিল, এ বার তা দেখা যায়নি। দলের পক্ষে ক্ষোভ-বিক্ষোভ দূরস্থান, মন্তব্য করার ক্ষেত্রেও নিয়ন্ত্রণ দেখানো হয়। কুণাল বারবারই বলেছেন, ‘‘দল নজর রাখছে। যথা সময়ে সিদ্ধান্ত জানাবে।’’

সোমবার প্রথম মুখ খোলেন মমতা। তিনি বিরোধীদের কড়া রাজনৈতিক আক্রমণ করেন। পার্থ আইনের চোখে দোষী প্রমাণিত হলে দল কঠোর শাস্তি দেবে, এমনও বলেন। কিন্তু দ্বিতীয় দফায় আরও কোটি কোটি টাকা উদ্ধার হওয়ার পর আর শুধুমাত্র বিরোধীদের আক্রমণের পথে হাঁটেননি মমতা। পার্থকে সরিয়ে দিয়েছেন। তার কাছাকাছি সময়েই এসএসসি চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলনের নেতাকে ফোন করেন অভিষেক।

আবার পার্থকে মন্ত্রিত্ব থেকে সরানোর পাশাপাশিই দলের তরফেও ‘কড়া’ পদক্ষেপ করা হয়। তৃণমূল ভবনে দলের শৃঙ্খলরক্ষা কমিটির বৈঠকের পর অভিষেক দলীয় স্তরে পার্থের বিরুদ্ধে সেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কথা জানিয়ে দেন। একই সঙ্গে তিনি জানান, শুক্রবার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন। সেই মতোই তিনি আলোচনা শুরুও করেছেন। প্রাথমিক ভাবে আন্দোলনকারীরাও তাঁদের ‘সন্তুষ্টি’র কথা জানিয়েছেন। যা থেকে তৃণমূলের অন্দরে এই দ্বিমুখী কৌশল নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। যা বলছে, মমতা-অভিষেক ‘গরমে-নরমে’ সঙ্কট মোকাবিলায় নেমেছেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement