মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। —গ্রাফিক শৌভিক দেবনাথ।
ধূপগুড়ি উপনির্বাচনে তৃণমূলের জয়কে ‘ঐতিহাসিক’ বলে আখ্যা দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুক্রবার দিল্লি যাওয়ার আগে কলকাতা বিমানবন্দরে তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেত্রী মমতা বলেন, ‘‘এটা উত্তরবঙ্গে বড় জয়। ধূপগুড়ির মা-মাটি-মানুষকে ধন্যবাদ। ওটা বিজেপির আসন ছিল। সেখানে তৃণমূল কংগ্রেসের জয় ঐতিহাসিক।’’ ধূপগুড়ির জয়ের সঙ্গে ‘ইন্ডিয়া’-কেও জুড়ে নিয়েছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, ‘‘দেশে সাতটি উপনির্বাচনের চারটিতে বিজেপি হেরেছে। এটা সম্ভব হয়েছে বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র জন্যই।’’
ধূপগুড়ি জয়ের পর সেখানকার মানুষকে অভিনন্দন জানিয়েছেন ‘তৃণমূলের সেনাপতি’ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেছেন, ধর্মান্ধতার রাজনীতিকে হারিয়ে উন্নয়নের রাজনীতিকে বেছে নেওয়ার জন্য ধূপগুড়িকে অভিনন্দন। তৃণমূলের প্রতিটি কর্মীকেও অভিনন্দন জানিয়েছেন অভিষেক। যাঁরা এলাকার মানুষের সঙ্গে আগাগোড়া সংযোগ রক্ষা করে গিয়েছেন। পরিশেষে বলেছেন, ধূপগুড়ির সার্বিক উন্নয়নের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাবেন।
বস্তুত, ধূপগুড়ির ফলাফলের পর আলাদা করে আলোচনা শুরু হয়েছে অভিষেকের ভূমিকা নিয়ে। তিনি ধূপগুড়িতে প্রচারে গিয়েছেন মাত্র এক দিন। কিন্তু তৃণমূল সূত্রের খবর, উত্তরবঙ্গের ওই আসনে তাঁর ‘উপস্থিতি’ ছিল ভোট ঘোষণা হওয়ার দিন থেকেই। সাগরদিঘি উপনির্বাচনে বিপর্যয়ের পর ধূপগুড়ি ছিল অভিষেকের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। বিজেপির হাত থেকে তৃণমূল ধূপগুড়ি ছিনিয়ে নেওয়ার পর রাজনৈতিক মহলের অনেকেই বলছেন, দলের সেনাপতি হিসাবে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা ছিল কার্যত মেঘনাদের মতো। এক দিন প্রকাশ্য সভা বাদ দিয়ে, গোটা উপনির্বাচন প্রক্রিয়ায় তিনি ছিলেন নেপথ্যে। সময়ে সময়ে পরিস্থিতি অনুযায়ী সাংগঠনিক কৌশল ঠিক করেছেন। এক দিকে তিনি অঙ্ক কষে ছক বদলেছেন, অন্য দিকে তাঁর টিম মাটি কামড়ে পড়ে থেকেছে। অনেকের মতে, এই দুইয়ের মিলিত ফলেই বিজেপির হাত থেকে ধূপগুড়ি তৃণমূলের দখলে এল। প্রসঙ্গত, ধূপগুড়ির ভোট নিয়ে বিরোধীরাও কোনও অশান্তি, সন্ত্রাস বা রিগিংয়ের অভিযোগ তোলেনি।
একেবারে শেষ বেলায় ধূপগুড়িতে প্রচারে গিয়ে একটিমাত্র সভা করেছিলেন অভিষেক। সেই সভায় বক্তৃতায় তিনি ধূপগুড়ির মহকুমা হওয়া নিয়ে যা বলেছিলেন, সেটাই এই উপনির্বাচনে কার্যত ম্যাজিকের মতো কাজ করে গিয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। অভিষেক বলেছিলেন, ‘‘আমি কথা দিচ্ছি, ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ধূপগুড়ি মহকুমা হবে।’’ পাশাপাশিই তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমি বলতে পারতাম এক বছর বাদে হবে। দু’বছর বাদে হবে। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলব। দেখছি। কিন্তু না! আমি কথা দিয়ে যাচ্ছি, ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ধূপগুড়ি মহকুমা হবে। এটা আমার প্রতিশ্রুতি। আমি করে দেখাব!’’
ধূপগুড়িকে মহকুমা করে দেখানোর আগে অভিষেক ধূপগুড়ি আসনটিও বিজেপির থেকে ছিনিয়ে নিয়েছেন। বিজেপি মনে করছে, মহকুমা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েই অভিষেক বাজি মেরে বেরিয়ে গিয়েছেন।ধূপগুড়ির মানুষের বহু দিনের দাবি ছিল পৃথক মহকুমার। কিন্তু কোনও এলাকাকে মহকুমা করা হবে কি না, সেটা একেবারেই প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত। সে দিক থেকে অভিষেকের ওই ঘোষণা রাজনৈতিক ভাবেও ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ ছিল। ফল ঘোষণার পর বিজেপির পরাজিত প্রার্থী তাপসী রায়ও বলেছেন, ‘‘ধূপগুড়িকে মহকুমা করার ঘোষণা শেষ মুহূর্তে মানুষের মন ঘুরিয়ে দিয়েছিল।’’ একই কথা বলেছেন শেষ মুহূর্তে তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যোগ-দেওয়া এলাকার প্রাক্তন বিধায়ক মিতালি রায়ও। তাঁর কথায়, ‘‘শেষ বেলায় মহকুমার করার ঘোষণা মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করে দিয়েছিল।’’
রাজনীতিতে সাধারণ ধারণা হল, উপনির্বাচন হলে শাসকদলই জেতে। কিন্তু বাংলায় সাগরগিঘির ভোট সেই ধারণা ভেঙে দিয়েছিল। সেই কারণেই সাগরদিঘির পরে ধূপগুড়ির উপনির্বাচন শাসক তৃণমূলের কাছে বড়সড় চ্যালেঞ্জ ছিল। ‘সংগঠক’ অভিষেকের কাছেও ধূপগুড়ি তাই ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ ছিল বিবিধ কারণে। সে কারণেই অভিষেক গোটা বিষয়টিকে হালকা ভাবে নেননি। তাঁর টিম কাজ করেছে ঘুরে ঘুরে। কোন এলাকায় কী খামতি, তা চিহ্নিত করেছে। তার পর সেই মতো সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড সুনির্দিষ্ট করে তা বাস্তবে প্রয়োগ করেছে। সেই কারণেই পুর এলাকার ভোট তৃণমূলের পক্ষে গিয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন। তারই পাশাপাশি সংখ্যালঘু ভোটও এসেছে তৃণমূলের দিকে।
একইসঙ্গে এটাও দেখার যে, যেখানে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী, বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদাররা বার বার গিয়েছেন ধূপগুড়িতে, সেখানে অভিষেক গিয়েছেন মাত্র একটিই দিন। যার ফল, রাজবংশী ও চা বলয়ের ধূপগুড়ির পদ্ম থেকে জোড়াফুলে ফিরে আসা। যা ধারণার সাপেক্ষে লোকসভার আগে তৃণমূলের কাছে যেমন ‘বাড়তি অক্সিজেন’, তেমনই বিজেপির কাছে ‘অস্বস্তিকর’।