কল্যাণ চৌবে (বাঁ দিকে) এবং কুণাল ঘোষ। —ফাইল চিত্র।
বাংলার চার বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনের কয়েক ঘণ্টা আগে আচমকাই বিজেপির বিরুদ্ধ ‘বোমা’ ফাটালেন তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ। মঙ্গলবার তিনি জানালেন, ভোটে সাহায্য চেয়ে স্বয়ং বিজেপি প্রার্থী ‘ঘুষের বিনিময়ে অন্তর্ঘাতের প্রস্তাব’ দিয়েছেন তাঁকে।
রাজ্যের বিধানসভা উপনির্বাচনের ঠিক তিন দিন আগে তাঁর কাছে ওই প্রস্তাব এসেছিল বলে জানিয়েছেন কুণাল। তৃণমূল নেতা বলেন, ‘‘গত ৭ জুলাই রাত সাড়ে ১১টার সময় আমাকে ফোন করেছিলেন মানিকতলা বিধানসভা কেন্দ্রের বিজেপির প্রার্থী কল্যাণ চৌবে। তিনি আমাকে প্রস্তাব দেন, তাঁর হয়ে কাজ করলে রাজ্য বা জাতীয় স্তরে খেলার জগতে বড় পদ দেবেন।’’ ওই টেলিফোনিক কথোপকথনের একটি প্রামাণ্য অডিয়ো রেকর্ডিংও (ওই অডিয়ো রেকর্ডিংয়ের সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার অনলাইন) প্রকাশ করেছেন তৃণমূল নেতা। তার পরে কুণাল বলেন, ‘‘ভোটের প্রচারে পিছিয়ে রয়েছেন বুঝে বিজেপির প্রার্থী প্রলোভন দেখাচ্ছেন জয়ের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা তৃণমূলকে। প্রস্তাব দিচ্ছেন দলের সঙ্গে বেইমানি করার। এটাই বিজেপি। এমনই ওদের নোংরা মানসিকতা।’’ কুণালের আনা এই অভিযোগ যদিও সরাসরি অস্বীকার করেছেন কল্যাণ। তবে একই সঙ্গে তিনি মেনেও নিয়েছেন যে, কুণালের প্রকাশ করা অডিয়ো রেকর্ডিংয়ের কণ্ঠস্বর তাঁরই।
কল্যাণ জানান, কুণালকে তিনি ফোন করেছিলেন ঠিকই। কিন্তু যে রেকর্ডিং প্রকাশ করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ নয় আংশিক। কল্যাণের এই বক্তব্যের অনতিবিলম্বেই অবশ্য কুণাল পাল্টা বলেন, ‘‘উনি বলেছেন আংশিক রেকর্ডিং। আমিও বলছি আংশিক। তবে কল্যাণ যদি চান, তবে ফোনের রিং বাজা থেকে ফোন রাখা পর্যন্ত রেকর্ডিং প্রকাশ করে দেব। যে রেকর্ডিংয়ের শেষে ক্ষমা চাইতেও শোনা গিয়েছে ওঁকে।’’
মঙ্গলবার কুণাল বনাম কল্যাণের এই বাগযুদ্ধ আলাদা মাত্রা পায় এর পরে। সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ কুণাল এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে একটি পোস্ট করে লেখেন, ‘‘কল্যাণ চৌবের পুরো অডিও এক ঘন্টা পর। দেখবেন— ১। ধর্মেন্দ্র প্রধান ইস্যুতে ক্ষমা চেয়েছে। ২। আমার বিজেপি যোগের গল্প নিয়ে একটি শব্দ নেই। ৩। ভোটে সাহায্য চেয়ে বিনিময়ে পদ দেওয়ার কথা বলেছে। রাত আটটায় মিলিয়ে নেবেন।’’
পরে রাত ৮টায় অডিয়োটি নিজের এক্স হ্যান্ডলে প্রকাশও করেন কুণাল (ওই অডিয়ো রেকর্ডিংয়ের সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার অনলাইন)। তাতে কুণালের বক্তব্য অনুযায়ী ওই টেলিফোনিক কথোপকথনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো রেকর্ডিংটিই রয়েছে।
রাত পোহালেই রাজ্যের চার বিধানসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচন। বুধবার মানিকতলা, বাগদা, রানাঘাট দক্ষিণ এবং রায়গঞ্জে ভোট। কুণালকে মানিকতলায় ভোট সামলানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তৃণমূলের তরফে। মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মানিকতলার ভোটের যে ‘টিম’ তৈরি করে দিয়েছেন, তারই আহ্বায়ক কুণাল। আর কল্যাণ হলেন মানিকতলার বিজেপির প্রার্থী। কুণালের অভিযোগ, তিনি তৃণমূলের আহ্বায়ক জেনেও কল্যাণ ভোটে তাঁর সাহায্য চেয়ে ফোন করেছিলেন গত রবিবার। কুণালের কথায়, ‘‘বিজেপির প্রার্থী কল্যাণ চৌবের সঙ্গে আমার ময়দান সূত্রে পূর্বপরিচয়। কল্যাণ এ-ও জানেন আমি আহ্বায়ক। দলকে জেতাতে নেমেছি। তার পরেও তিনি আমাকে অনুরোধ করেন তাঁকে সাহায্য করার জন্য।’’
কুণাল এই অভিযোগ এনে বলেছেন, ‘‘যদি ধরে নিই গণতান্ত্রিক পরিবারের সৌজন্যের খাতিরে উনি প্রতিপক্ষের কাছে সাহায্য চাইছেন, তবে আমার কিছু বলার ছিল না। উনিও সেটাই করতে পারতেন। কিন্তু এর পরে উনি বললেন, ওঁর হয়ে কাজ করলে ক্রীড়াক্ষেত্রে রাজ্য বা কেন্দ্রে বড় পদে নিয়ে যাবেন। এ তো ঘুষ!’’ এর পরেই ওই কল্যাণের সঙ্গে তাঁর কথোপকথনের অডিয়ো রেকর্ডিং প্রকাশ করেন কুণাল (আনন্দবাজার অনলাইন ওই অডিয়ো রেকর্ডিংয়ের সত্যতা যাচাই করেনি) বলেন, ‘‘মোহনবাগান সহ-সভাপতিকে ঘুষের কথা বলবেন, আর আমি নাচতে নাচতে যাব? অফার বাতিল করে দিয়েছি।’’
যদিও কুণালের ওই সাংবাদিক বৈঠকের পরে পাল্টা কল্যাণ বলেন, তিনি কুণালকে কোনও রকম ঘুষের প্রস্তাব দেননি। ওই রেকর্ডিংয়ে এডিট করে তাঁর বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।
কুণালের আনা ওই অভিযোগের এক ঘণ্টা পরেই একটি পাল্টা সাংবাদিক বৈঠক ডাকেন বিজেপির মানিকতলা প্রার্থী তথা অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট কল্যাণ। সেখানেই কুণালের ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ উড়িয়ে কল্যাণ বলেন, ‘‘আমি এক জন প্রার্থী হিসাবে সবার কাছেই গিয়েছি। তাঁদের কাছে সাহায্য চেয়েছি। ওঁকেও সে ভাবেই ফোন করেছিলাম। কিন্তু কোনও ঘুষের প্রস্তাব দিইনি। বরং উনিই এক সপ্তাহ আগে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। জানিয়েছিলেন তিনি বিজেপির নেতৃত্বের সঙ্গে বসতে চান। এর আগে উনি বহু বার আমার বাড়িতে এসেছেন। ২০১৯ সালে বিজেপিতে যোগ দিতেও চেয়েছিলেন। সেই সূত্রেই আমি ওঁর সঙ্গে কথা বলি। কারণ যিনি আমার দলেই আসার কথা ভাবছেন, তাঁর কাছে আমি সাহায্য চাইতে পারি বলে মনে হয়েছিল।’’
কল্যাণের সাংবাদিক বৈঠকের এই দাবি করার কয়েক মিনিটের মধ্যেই তার জবাব দেন কুণালও। তিনি বলেন, ‘‘উনি বলেছেন, প্রার্থী হিসাবে আমাকে ফোন করেছেন। কিন্তু আমি তো মানিকতলার ভোটারই নই। ফলে ভোট চেয়ে আমাকে ফোন করার প্রশ্ন নেই। আসলে আমি তৃণমূলের ভোট ম্যানেজার বলেই আমাকে ফোন করেছিলেন। ’’ উল্লেখ্য কুণালের বাড়ি উত্তর কলকাতার সুকিয়া স্ট্রিটে। সেটি বেলেঘাটা বিধানসভার মধ্যে পড়ে।
পরে ‘কুণালের বিজেপিতে যোগদান’ প্রসঙ্গে কল্যাণের অভিযোগেরও জবাব দেন কুণাল। তিনি বলেন, ‘‘কল্যাণকে বলব, আপনি আপনার দলের প্রাক্তন রাজ্যসভাপতি দিলীপ ঘোষকে জিজ্ঞাসা করুন, কুণাল ঘোষ কখনও বিজেপিতে আসতে চেয়েছিল কি না। আর আমার যদি বিজেপিতে যাওয়ার প্রয়োজন হয়, তা হলে মনে রাখবেন নরেন্দ্র মোদী আমাকে চেনেন। আমার কাকা মোদী যখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তাঁর সঙ্গে কাজ করেছেন। বিজেপিতে যোগ দিতে চাইলে ওই পচা কল্যাণকে আমার দরকার হবে না।’’