ছবি: সংগৃহীত।
কোন্নগরের হীরালাল পাল কলেজে নিগৃহীত শিক্ষককে ফোন করে দুঃখ প্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর খাস কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজে ক্লাসে ঢুকে কুকথা ও দুর্ব্যবহারের ঘটনায় নিগৃহীত শিক্ষিকার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন মমতারই দলের অভিযুক্ত ছাত্রনেতা।
শিক্ষা শিবিরের পর্যবেক্ষণ, একই দিনের দু’টি অপ্রীতিকর ঘটনায় শাসক দলের তরফে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগে সদর্থক ইঙ্গিত নিশ্চয়ই আছে। তবে শিক্ষাঙ্গনে বারবার হিংসা ও বর্বরতার ঘটনা কেন ঘটছে, সেই অসুখের উৎস সন্ধান করে অচিরে নিরাময়ের বন্দোবস্ত না-করলে শিক্ষায় অগ্রগতি ব্যাহত হতেই থাকবে।
বুধবার বিদ্যাসাগর কলেজে ক্লাস চলাকালীন শ্রেণিকক্ষে ঢুকে শিক্ষিকার সঙ্গে অভব্য আচরণের অভিযোগ উঠেছে ওই প্রতিষ্ঠানের তৃণমূল ছাত্র পরিষদের (টিএমসিপি) নেতা শানু মাকালের বিরুদ্ধে। ইতিহাসের শিক্ষিকা ঈশিতা চক্রবর্তীর অভিযোগ, প্রথম বর্ষের ক্লাস নেওয়ার সময় কয়েক জন পড়ুয়া দেরিতে ঢোকেন। ঈশিতা তাঁদের জানান, দেরিতে আসায় তাঁদের ক্লাস করতে দেওয়া হবে না। তবে তাঁদের ওই দিনের হাজিরা নথিভুক্ত করে দেবেন। তার পরেই সদলবল সেখানে হাজির হন ছাত্রনেতা শানু। ঈশিতার অভিযোগ, অশ্রাব্য ভাষায় এবং বিচিত্র ভঙ্গিতে শানু তাঁকে শাসাতে থাকেন। শানুর প্রশ্ন তোলেন, পরে আসা পড়ুয়াদের ক্লাসে ঢুকতে দেওয়া হয়নি কেন? ঈশিতা কলেজের অধ্যক্ষ গৌতম কুণ্ডুকে বিষয়টি জানাতে গেলে তাঁর পিছনে পিছনে সদলবল শানুও সেখানে পৌঁছে যান। ওই ছাত্রনেতা সেখানে উপস্থিত শিক্ষকদের সঙ্গেও অত্যন্ত উদ্ধত আচরণ করেন বলে অভিযোগ। অধ্যক্ষ কোনও মতে তাঁদের ঘর থেকে বার করে দেন।
রাজ্যে শিক্ষক-নিগ্রহের খতিয়ান
• জানুয়ারি, ২০১২: রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি কলেজে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের উপরে হামলা। অভিযুক্ত স্থানীয় তৃণমূল নেতা।
• জানুয়ারি, ২০১২: মাজদিয়া সুধীরঞ্জন লাহিড়ী কলেজে পাঁচ ছাত্রের হাতে নিগৃহীত অধ্যক্ষ। অভিযুক্ত এসএফআই।
• জানুয়ারি, ২০১২: রামপুরহাট কলেজে ছাত্র-বিক্ষোভে অসুস্থ ও অজ্ঞান অধ্যক্ষ। অভিযুক্ত টিএমসিপি এবং সিপি।
• এপ্রিল, ২০১২: ভাঙড় কলেজের শিক্ষিকা
দেবযানী দে-র দিকে জগ ছোড়েন তৃণমূল নেতা আরাবুল ইসলাম।
• সেপ্টেম্বর, ২০১২: ঝাড়গ্রাম রাজ কলেজে অধ্যক্ষের গালে চড় মারার অভিযোগ টিএমসিপি জেলা সহ-সভাপতির বিরুদ্ধে।
• ফেব্রুয়ারি, ২০১৫: ঘাটাল রবীন্দ্র শতবার্ষিকী মহাবিদ্যালয়ের অধ্যাপক অমিত রায়কে মারধর টিএমসিপি-র।
• জুলাই, ২০১৯: কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজে ক্লাসে ঢুকে শিক্ষিকা ঈশিতা চক্রবর্তীর সঙ্গে অভব্যতা। অভিযুক্ত টিএমসিপি নেতা শানু মাকাল।
• জুলাই, ২০১৯: কোন্নগরের হীরালাল পাল কলেজে শিক্ষকের কলার ধরে মার। অভিযুক্ত টিএমসিপি।
শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এ দিন পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, ছাত্রদের অছাত্রসুলভ আচরণ কোনও ভাবেই বরদাস্ত করা হবে না। টিএমসিপি-র রাজ্য সভাপতি তৃণাঙ্কুর ভট্টাচার্য জানান, শানুকে ক্ষমা চাওয়ার নির্দেশ তাঁরাই দিয়েছেন। তবে এ দিনও তৃণাঙ্কুর দাবি করেন, ক্লাস নিয়মিত হয় না। সেই বিষয়ে কথা বলতেই শানু ওই ক্লাসে ঢুকেছিলেন। তবে পুরো বিষয়টি নিয়ে তাঁরা তদন্ত করছেন। তদন্ত শেষ হওয়ার আগে পর্যন্ত শানুকে কলেজে যেতে বারণ করা হয়েছে।
বিদ্যাসাগর কলেজের টিচার্স কাউন্সিলের সম্পাদক সোহিনী ঘোষ জানান, শানু কলেজের নিয়মিত ছাত্র নন। শিক্ষকদের অসম্মান করার বেশ কিছু ঘটনা আগেও ঘটিয়েছেন ওই ছাত্রনেতা। এ দিন ঈশিতার পাশাপাশি অন্য শিক্ষকদের কাছেও শানুকে ক্ষমা চাইতে বলা হয়। শানু তাঁদের কাছেও ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন। যে-সব পড়ুয়ার সামনে তিনি এই ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছেন, তাঁদের সামনেও ক্ষমা চাইতে বলা হয়েছে ওই ছাত্রনেতাকে। তিনি তাতেও রাজি হয়েছেন।
কিন্তু মুখে কুলুপ এঁটেছেন অধ্যক্ষ গৌতমবাবু। এ দিন তিনি জানান, এই বিষয়ে কোনও কথাই বলবেন না। কেন এই নীরবতা? প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে অধ্যক্ষেরই তো প্রয়েজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সর্বাগ্রে এগিয়ে আসা উচিত! শিক্ষা মহলের বক্তব্য, অধ্যক্ষদের অনেকেই শাসক দলের ছাত্র সংগঠনকে ভয় করেন। খুব শক্ত পদক্ষেপ করতে পারেন না।
দু’বছর ধরে এ রাজ্যে ছাত্র সংসদের নির্বাচন স্থগিত রয়েছে। হিসেব অনুযায়ী দু’বছর আগের ছাত্র সংসদের নেতাদের পাশ করে কলেজ ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু প্রায় প্রতিটি কলেজেই তাঁদের দাপট অব্যাহত রয়েছে। সম্প্রতি সূর্য সেন স্ট্রিটের সিটি কলেজ অব কমার্স অ্যান্ড বিজনেস অ্যাডমিনেস্ট্রেশন কর্তৃপক্ষ কলেজে বহিরাগতদের প্রবল দাপট ঠেকাতে ইউনিয়ন রুম বন্ধ করে দিয়ে নোটিস জারি করেছেন। কিন্তু সব কলেজের অধ্যক্ষেরা তা পারেন না। মধ্য কলকাতার একটি কলেজের অধ্যক্ষের বক্তব্য, ছাত্র সংসদ ভোট নিয়ে বলে শুধু আর কী হবে! অধ্যক্ষদের সংগঠন নিখিল বঙ্গ অধ্যক্ষ পরিষদেও তো এ বছর নির্বাচন হয়নি। আগে যাঁরা পদাধিকারী ছিলেন, তাঁরাই রয়েছেন। সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের পদে যে-দু’জন রয়েছেন, তাঁরা এখন রাজ্যের দু’টি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। অধ্যক্ষ পরিষদের নেতৃত্বে বদল ঘটেনি।
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।