তৃণমূলের দাবি, মিরিক লেকের সংস্কার-সহ শহরে পর্যটন পরিকাঠামো গড়ে তোলার লক্ষ্য তাদের।
বিমল গুরুঙ্গদের হৃদ্কম্প বাড়িয়ে পাহাড়ের কোলে ঘাসফুল ফুটিয়ে দিল মিরিক। এবং মোটামুটি ৩৫ বছর পর কোনও পাহাড়ি দলের একচ্ছত্র দখলদারি থেকেও মুক্ত হল পাহাড়। মিরিক পুরসভার দখল নিল তৃণমূল কংগ্রেস। পাহাড়ের বাকি তিন পুরসভাতেও খাতা খুলেছে রাজ্যের শাসক দল। মিরিকে মোট ৯টি আসনের মধ্যে ৬টিতে জিতেছে তৃণমূল। বাকি ৩টিতে জিতে কোনও রকমে মুখরক্ষা করেছে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। তৃণমূলের দখলে এসেছে মোট ভোটের ৪৪ শতাংশ ভোট। মোর্চা পেয়েছে ৩৯.৫ শতাংশ। বাকিটা ভোট তুলে নিয়েছেন নির্দল প্রার্থীরা। গত পুরভোটে মিরিকের ৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৯টিই ছিল মোর্চার দখলে।
গত শতকে আশির দশকের গোড়ায় সুবাস ঘিয়িংয়ের জিএনএলএফের হাত ধরে পাহাড় জুড়ে গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকে পাহাড়ের বড়, ছোট সব ভোটেই এক তরফা দখলদারি কায়েম রেখেছে কোনও না কোনও পাহাড়ি দল। প্রথমে জিএনএলএফ। পরে বিমল গুরুঙ্গদের গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। একটা সময় পাহাড়ে ভাল সংগঠন ছিল যে বামেদের, তারা মুছে গিয়েছিল পাহাড় থেকে। ২০০৬ সাল পর্যন্ত রাজ্যের সর্বত্র বামেদের সাংগঠনিক বা নির্বাচনী আধিপত্য বজায় থাকলেও, পাহাড়ে শত চেষ্টাতেও দাঁত ফোটাতে পারেনি তারা। এমনকী বাম আমলের শেষ পর্বে পাহাড়ে কার্যত সমান্তরাল প্রশাসন পর্যন্ত চালিয়েছে মোর্চা।
আরও পড়ুন
মিরিক-সহ চার পুরসভা তৃণমূলের, মোর্চার দখলে দুই, প্রায় নিশ্চিহ্ন জোট
২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার পর আলাদা ভাবে নজর দেন পাহাড়ে। নরমে, গরমে পাল্টা চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে থাকেন মোর্চাকে। সশরীরে বারবার ছুটে গেছেন দার্জিলিং, কালিম্পং, কার্সিয়ং, মিরিক-সহ পাহাড়ের এলাকা থেকে এলাকায়। এ বারের পুরভোটে তৃণমূল যে তারই ফসল ঘরে তুলেছে বলে মনে করছেন দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিনের পর দিন পাহাড়ে গিয়েছেন। তারই প্রতিফলন ঘটেছে মিরিকে।” পাহাড়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত তৃণমূল নেতা অরূপ বিশ্বাসও বার বার সেখানে গিয়ে গোটা প্রক্রিয়ার পর্যবেক্ষণে ছিলেন। বুধবার ফল ঘোষণার পর দৃশ্যতই তৃপ্ত অরূপবাবু বলেন, “এ জয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়নের জয়। এই জয়ে পাহাড়বাসীকে অভিনন্দন।”
মিরিক জয়ের পর তৃণমূল সমর্থকদের উল্লাস।
উন্নয়নের প্রশ্ন ছাড়াও মিরিকবাসীদের সঙ্গে জনসংযোগে ব্যর্থ গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। এ দিন পুরভোটের ফলাফল সামনে আসার পরই দলীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়েন মোর্চা কর্মীদের একাংশ। জিটিএ-র সদস্য অরুণ সিকচির সামনেই তাঁরা অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তবে তাঁদের শান্ত করে ভোটে কারচুপির অভিযোগ তোলেন অরুণ সিকচি। একই সুর শোনা গেল মোর্চা সভাপতি বিমল গুরুঙ্গের গলাতেও। তাঁর দাবি, “মিরিকে আধঘণ্টায় গণনা শেষ কেন? কারচুপির অভিযোগে পুনর্গণনা চাইব।” যদিও সে অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী তো দূরের কথা, আগের জমানায় কোনও মন্ত্রীও পাহাড়ে পা রাখেননি।” তাঁর দাবি, “মুখ্যমন্ত্রীর উন্নয়নের প্রতি আস্থা রেখেছেন পাহাড়ের মানুষ।”
আরও পড়ুন
দার্জিলিং, কার্শিয়াং, কালিম্পঙেও গুরুঙ্গদের চিন্তায় ফেলল তৃণমূল
তৃণমূলের দাবি, মিরিক লেকের সংস্কার-সহ শহরে পর্যটন পরিকাঠামো গড়ে তোলার লক্ষ্য তাদের। লেকের শহর মিরিককে মহকুমা হিসাবে ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। ৩০ হাজার মিরিকবাসীর অধিকাংশের কাছেই জমির পাট্টা নেই। ভোটের আগেই জমির সমীক্ষার কাজ শেষ করে প্রায় ন’হাজার ভোটারের কাছে সদর্থক বার্তা দিতে পেরেছে তৃণমুল। সে কথাই ফের মনে করালেন আলিপুরদুয়ারের বিধায়ক তৃণমূলের সৌরভ চক্রবর্তী। তিনি বলেন, “এটা টিমওয়ার্কের জয়।”
মিরিকে মোট ৯টি আসনের মধ্যে ৬টিতে জিতেছে তৃণমূল।
উন্নয়ন ছাড়াও ভোটের আগে তিন বারের পুর চেয়ারম্যান লাল বাহাদুর রাই-সহ মণিকুমার জিম্বার মতো মোর্চা নেতারা তৃণমূলে যোগ দেওয়াতেও ধস নেমেছে গুরুঙ্গদের ঘরে। মিরিক ছাড়া দার্জিলিং, কালিম্পং, কার্শিয়াং-এর ফল অবশ্য নিজেদের দিকে রাখতে পেরেছে মোর্চা। তা নিয়েও মোর্চা নেতাদের বিরুদ্ধে ভোট কেনার অভিযোগ তুলেছে তণমূল। সৌরভের দাবি, “বহু জায়গায় কারচুপি হয়েছে। মিরিকে আমরা তা রুখে দিয়েছি।”
ব্যতিক্রমী জয়ের পাশাপাশি আরও একটি ক্ষেত্রে নজির গড়ল মিরিক। এর আগে দু’বারই বিরোধীশূন্য বোর্ড গঠন হয়েছিল। এ বার অবশ্য সে দিক থেকে খানিকটা ব্যতিক্রম এ শহর। ৩টি আসন জিতে বিরোধী আসনে বসবেন মোর্চা নেতারা। বিমল গুরুঙ্গ বলেন, “যাই হোক, বিরোধী থাকাটা গণতন্ত্রের পক্ষে ভাল। আমি তো আগেই বলেছিলাম, পাহাড়ে বিরোধীরা এ বার কিছু পাবে। আমরা কাজ করে যাব।”
ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।