দু’দিনের টানা ধর্না থেকে এক বারও কংগ্রেসকে আক্রমণ করেননি মমতা। গ্রাফিক— শৌভিক দেবনাথ।
বিজেপি এবং সিপিএমকে একই বন্ধনীতে রেখে কড়া ভাষায় আক্রমণ। পক্ষান্তরে, কংগ্রেসের সম্পর্কে একটিও ‘বিমাতৃসুলভ’ মন্তব্য নয়। বুধ এবং বৃহস্পতিবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কেন্দ্র-বিরোধী ধর্নামঞ্চের রাজনৈতিক নির্যাস আপাতত এটাই।
বুধবার ধর্নামঞ্চে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা আক্রমণ করছিলেন বামেদের। নাম না করে সিপিএমকে ‘চোর-ডাকাত’ বলেছিলেন মমতা। একই বাক্যে বিজেপির নাম উচ্চারণ করে ‘গুণ্ডা’ বলেছিলেন। বৃহস্পতিবার, ধর্নার দ্বিতীয় দিনে নাম করেই তিনি এক বন্ধনীতে ফেলেছেন সিপিএম-বিজেপিকে। মমতা বলেছেন, ‘‘বিজেপি আর সিপিএম, মনে রাখবেন বাম আর রাম এক হয়েছে। আর তারা এক হয়েই বলছে, ‘আমরা সব কাগজপত্র হাতে পেয়ে যাচ্ছি।’ পাবে না কেন! সিপিএমের আমলের অফিসারগুলোকে তো তাড়াইনি! তারা তো এখনও কোঅর্ডিনেশন কমিটির সঙ্গে মিলে আছে। ওরাই কাগজপত্রগুলো সরাচ্ছে।’’
অর্থাৎ, সরকারি নথিপত্র হাতে পেতে বিজেপি সিপিএম পরষ্পরকে সাহায্য করছে বলে অভিযোগ করলেন মুখ্যমন্ত্রী। একইসঙ্গে এটিও প্রণিধানযোগ্য যে, দু’দিনের টানা ধর্না থেকে এক বারও কংগ্রেসকে আক্রমণ করেননি মমতা। বরং মমতা এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় মুখর হয়েছেন কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধীর সাংসদ পদ খারিজ করা নিয়ে। সাগরদিঘির হারের পর যে মমতা ঘোষণা করেছিলেন, তৃণমূল ‘একলাই’ চলবে, সেই মমতাই ‘একের বিরুদ্ধে এক’ লড়াইয়ের কথা বলেছেন। অথচ, সপ্তাহদুয়েক আগে কালীঘাটের বাড়িতে দলীয় বৈঠকেও কংগ্রেসের ‘দাদাগিরি’ নিয়ে সরব হয়েছিলেন মমতা-সহ তৃণমূলের শীর্ষনেতৃত্ব। সেই সূত্রেই কংগ্রেস ছাড়া দেশের অন্য আঞ্চলিক দলগুলিকে একজোট হওয়ার আহ্বানও জানিয়েছিল তৃণমূল। বৃহস্পতিবার সেই তৃণমূলনেত্রীই কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সকলকে একজোট হওয়ার ডাক দিয়ে বলেছেন, ‘‘সমস্ত বিরোধী দলকে বলছি, আপনারা জোট বাঁধুন।’’
এই আবহেই বৃহস্পতিবার মমতার ধর্নামঞ্চের অদূরে ডিএ আন্দোলনের মঞ্চে গিয়েছিলেন কংগ্রেস, সিপিএম এবং বিজেপির নেতৃত্ব। ফলে তৃণমূলের শীর্ষনেতৃত্বের কাছে এই ইঙ্গিত স্পষ্ট যে, আন্দোলনরত সরকারি কর্মচারীদের পাশে জোটবদ্ধ হচ্ছে তিনটি বিরোধীদল। মমতা তাই কৌশলে বিজেপি-সিপিএমকে একই বন্ধনীতে রেখে ‘সমমনোভাবাপন্ন’ কংগ্রেসকে আলাদা করতে চাইছেন।
বস্তুত, অনেকেই মনে করছেন, রাহুলের সাংসদ পদ খারিজের পর থেকেই কংগ্রেস-তৃণমূলের সমীকরণে খানিক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। সাসংদ পদ খারিজ হওয়ার আগে ইংল্যান্ডে গিয়ে ভারতে ‘গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ’ প্রসঙ্গে রাহুলের মন্তব্যের বিরোধিতা করে তাঁকে ক্ষমা চাইতে বলেছিলেন বিজেপি সাংসদেরা। ‘ন্যাশনাল হেরাল্ড’ মামলায় কংগ্রেসের কার্যালয়ে তল্লাশি চালাতে পাঠানো হয়েছিল কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডিকে। কিছুদিন আগেও রাহুলের বাড়িতে পুলিশ গিয়েছিল তাঁকে জেরা করতে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই নীরব ছিল তৃণমূল। কিন্তু বৃহষ্পতিবার ধর্নার মঞ্চ থেকে মমতা বলেছেন, ‘‘যেহেতু বলছি, সব বিরোধীরা জোট বাঁধো, তাই সকলে দুর্নীতিগ্রস্ত? সকলেই কালা আদমি? সকলে কালো আর বিজেপি সাদা? সকলে দেশবিরোধী আর বিজেপি একা জাতীয়তাবাদী?’’ সরাসরি রাহুলের নাম না-করলেও তাঁর জেলের সাজা এবং লোকসভার সাংসদের পদ খারিজের প্রসঙ্গও উঠে মমতার কথায়। তৃণমূল নেত্রী বলেন, ‘‘কেন্দ্রের শাসকদল বিজেপি ক্রমশ সামন্ততান্ত্রিক জমিদার হয়ে উঠছে। কেউ বিরুদ্ধে কথা বললেই তাকে জেলে পাঠিয়ে দিচ্ছে! তাকে সংসদ থেকে বার করে দিচ্ছে।’’
প্রসঙ্গত, বুধবার শহিদ মিনার ময়দানে তৃণমূল সাংসদ তথা দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক রাহুলের নাম করেই বলেছিলেন, ‘‘রাহুলকে সরানো হয়েছে। সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে দুটো কথা বলেছে। আমরা ভাবাবেগে আঘাত করতে চাই না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ২০২০-’২১ সালেও ‘দিদি, ও দিদি’ বলেছিলেন। সেটাও তো কুরুচিকর। মহিলাদের অপমান। শুভেন্দু অধিকারী কুরুচিকর ভাষায় আক্রমণ করেছেন বিরবাহা হাঁসদাদের। উনি বলেছিলেন, ওরা জুতোর তলায় থাকে। আমরাও তা হলে কোর্টে যাব তাঁদের পদ খারিজ করার দাবিতে!’’ সেই মতো মামলার প্রস্তুতিও শুরু হয়ে গিয়েছে।
তৃণমূলের অন্দরে একাংশের বিশ্লেষণ, সাগরদিঘি-উত্তর পর্বে মমতা যে সংখ্যালঘু ভোট নিয়ে চিন্তিত, তা তিনি গোপন করেননি। অনেকে মনে করছেন, শুধু সংখ্যালঘু ভোট নয়, সাগরদিঘিতে কিছু ‘প্রতিষ্ঠান-বিরোধী’ ভোটও পড়েছে। যদিও একটি আসনের ফলাফল কোনও নিশ্চিত ইঙ্গিত দেয় না। তবুও সাগরদিঘির ফলাফল কিছু প্রশ্ন এবং সম্ভাবনার জন্ম দিয়ে গিয়েছে। সেই কারণেই সিপিএমকে কড়া আক্রমণের রাস্তায় গিয়েছে তৃণমূল। এবং পাশাপাশিই কংগ্রেসের প্রতি ‘বার্তা’ পাঠানো শুরু করেছে।
রাহুলের সাংসদ পদ খারিজ নিয়ে কংগ্রেসের ডাকা বৈঠকে দুই সাংসদকে পাঠিয়েছেন মমতা। যদিও তাঁদের কেউই আপাদমস্তক রাজনীতিক নন। কিন্তু তৃণমূলের প্রতিনিধি তো বটে! ডিএ-র দাবি এবং নিয়োগ দুর্নীতির প্রশ্নে রাজ্যের বামেরা ‘সক্রিয়’। তারা তাদের অস্তিত্বও জাহির করতে শুরু করেছে। আন্দোলন করতে ময়দানে নামছে। খানিকটা হলেও তারা ‘উজ্জীবিত’। অন্যদিকে, বিজেপি রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল। অনেকের মতে, তাই সিপিএম-বিজেপিকে একই বন্ধনীতে ফেলে আক্রমণ শুরু করেছেন মমতা। তৃণমূলের শীর্ষনেতৃত্বের একাংশের বক্তব্য, নবান্নের একশ্রেণির কর্মচারীর ‘ঘনিষ্ঠ’ কোনও কোনও বিজেপি নেতার মাধ্যমে সরকারের বিভিন্ন তথ্য বিরোধী দলনেতা শুভেন্দুর কাছে নিয়মিত পৌঁছচ্ছে।
এই আবহেই মমতা বৃহস্পতিবার রাম-বামকে একই বন্ধনীতে রেখে তাদের আক্রমণ করেছেন। অন্যদিকে, ‘বার্তা’ দিয়েছেন কংগ্রেসকে। বিরোধী জোটের আহ্বানও করেছেন। এখন দেখার, আগামিদিনে জাতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূলের সম্পর্কের সমীকরণ আরও বদলায় কি না। পাশাপাশিই, রাজ্য রাজনীতিতে বিজেপি এবং সিপিএমকে দূরে রেখে কাছাকাছি আসেন কি না মমতা এবং অধীর চৌধুরী।