নতুন কর্মসূচি ঘোষণার আগে সোমবার নজরুল মঞ্চে মমতা ও অভিষেক। — নিজস্ব চিত্র।
রবিবার নতুন দলীয় দফতরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন কর্মসূচিতে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সটান বলেছিলেন, ‘‘দুর্নীতি প্রমাণিত হলে কেউ রেহাই পাবে না। দল থেকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বার করে দেব!’’
তার ২৪ ঘণ্টা পরেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন ‘পোকা বাছা’র কথা। তাঁর কথায়, ‘‘যদি একটা পোকা ধানে জন্মায়, তাকে সমূলে বিনাশ না করলে কিন্তু ওই পোকাটা থেকেই সারা ধানে পোকা লেগে যাবে। সুতরাং, আমাকে পোকাটা আগেই নির্মূল করতে হবে।’’
দেখা গেল, দুর্নীতি-প্রশ্নে ইদানীং সবচেয়ে বেশি টালমাটাল শাসক তৃণমূলে একযোগে ‘শুদ্ধকরণ’-এর কাজ শুরু করেছেন মমতা-অভিষেক জুটি। এক দিকে যেমন এর ফলে গোটা দলে বার্তা গেল যে, দুর্নীতির প্রশ্নে দলের শীর্ষমহল আর কোনও আপসে যাবে না। তেমনই এটাও প্রতিষ্ঠিত হল যে, দলের দুই প্রজন্মের দুই শীর্ষ নেত্রী এবং নেতার মধ্যে এই প্রশ্নে সমন্বয়ের কোনও অভাব নেই। আবার এরই পাশাপাশি এই প্রশ্নও থেকে গেল যে, দুর্নীতির দায়ে গ্রেফতার হওয়া অনুব্রত মণ্ডল এবং মানিক ভট্টাচার্যকে এখনও দলের পদে কেন রেখে দেওয়া হয়েছে!
তবে শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগ এবং তার পরে আবাস যোজনায় দুর্নীতির লাগাতার অভিযোগ ওঠার পর তৃণমূল যে ‘বেকায়দায়’, তা নিয়ে দলের নেতাদের কোনও সন্দেহ নেই। এক নেতার কথায়, ‘‘পরিস্থিতি কঠিন। তা নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই।’’
বস্তুত, শিক্ষাক্ষেত্রে পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই ‘সক্রিয়’ হয়েছিলেন অভিষেক। পঞ্চায়েত ভোটের আগে তাঁর ‘সক্রিয়তা’ আরও বেড়েছে। সম্প্রতি তৃণমূলের বেশ কয়েক জন জনপ্রতিনিধিকে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় সরকারি পদ থেকে ইস্তফা দিতে হয়েছে। প্রতিটির ক্ষেত্রেই নির্দেশ ছিল অভিষেকের। এর পরে অনেকেই মনে করেছিলেন, দলে শৃঙ্খলা আনতে ‘নতুন তৃণমূল’ গড়তে চাইছেন অভিষেক। সেই কারণেই দলের নিয়ন্ত্রণ হাতে নিচ্ছেন। সোমবার মমতার কথায় বোঝা গেল, অভিষেকের সিদ্ধান্তে তাঁর অনুমোদন রয়েছে। সংগঠনের প্রধানের মতো প্রশাসনের প্রধান হিসাবে তিনিও দলের পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি বজায় রাখতে চাইছেন।
নতুন বছরে দল কী কর্মসূচি নেবে, মূলত তা ঘোষণা করতেই সোমবার সাংগঠনিক বৈঠক ডেকেছিল তৃণমূল। নতুন বছরের কর্মসূচির সঙ্গে নতুন নীতিও ঘোষণা করে দেন মমতা। তিনি বলেন, ‘‘দেখতে হবে যাতে পোকা না জন্মায়। আর যদি পোকা জন্মে থাকে, তা হলে প্রথমে তাকে সতর্ক করতে হবে। বলতে হবে, ‘হয় নিজেকে সংশোধন করো, না হলে আমাদের অন্য কিছু ভাবতে হবে’। মনে রাখবেন, আমিও দলের ঊর্ধ্বে নই। মানুষের ঊর্ধ্বে নই। আমার উপর মানুষের কী কী দায়বদ্ধতা আছে, তা আমি প্রতিদিন সকাল থেকে রাত মেনে চলি।’’
সম্প্রতি খড়্গপুর পুরসভার প্রধান পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন প্রদীপ সরকার। তৃণমূলের তরফেই জানানো হয়েছিল, সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তার আগে পূর্ব মেদিনীপুর ও নদিয়া জেলায় পঞ্চায়েত স্তরের কয়েক জনকে রাতারাতি পদ ছাড়তে নির্দেশ দিয়েছিলেন অভিষেক। ডিসেম্বরের গোড়ায় পূর্ব মেদিনীপুরে কাঁথিতে জনসভা ছিল অভিষেকের। তার আগে মরিশদা গ্রামে গিয়ে কয়েক জনের মুখে নানা ক্ষোভের কথা শোনেন তিনি। এর পরেই জনসভা থেকে নির্দেশ দেন, মারিশদা ৪ পঞ্চায়েতের প্রধান, উপপ্রধান এবং তৃণমূলের অঞ্চল সভাপতিকে পদত্যাগ করতে হবে। ৭২ ঘণ্টা সময়সীমা দেন। নির্দেশ মেনে তিন জনই পদত্যাগ করেছেন। এর পরে ১৭ ডিসেম্বর নদিরায় রানাঘাটের সভামঞ্চ থেকে চাকদহ ব্লকের তাতলা-১ গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান পার্থপ্রতিম দে-কে পদত্যাগের নির্দেশ দেন অভিষেক। সময় দেন ৪৮ ঘণ্টা। সেই নির্দেশও মান্য হয়েছে।
খড়্গপুরের পুরপ্রধানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রকাশ করে অভিষেককে চিঠি দিয়েছিলেন দলেরই কয়েক জন কাউন্সিলর। তৃণমূল সূত্রে জানা যায়, তার পরেই প্রদীপকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা তৃণমূলের কো-অর্ডিনেটর অজিত মাইতি প্রদীপকে জানিয়ে দেন, অভিষেকের নির্দেশ মেনে তাঁকে সরতে হবে। সোমবারেও অভিষেকের গলায় ছিল কড়া সুর। তিনি ‘দিদির সুরক্ষা কবচ’ প্রকল্পের কথা ঘোষণা করেন। কিন্তু তারই পাশাপাশি ‘দিদির দূত’ কর্মীদের আচরণবিধিও ঠিক করে দেন অভিষেক। বলেন, ‘‘দিদির দূতের আচরণ হবে নম্র, বিনয়ী এবং ধৈর্যশীল।’’