জয় প্রত্যাশিতই ছিল। বাস্তবেও তার অন্যথা হয়নি। কিন্তু সেই জয়ের গৌরবে কালির দাগ! গত বারের তুলনায় আসন এবং ভোট বাড়িয়ে কলকাতা পুরসভা দখলে রাখল তৃণমূল। গোটা রাজ্যে ছড়িয়ে থাকা বাকি ৯১টি পুরসভাতেও তাদের রমরমা। ৬৯টি পুরসভা এখনই তৃণমূলের ঝুলিতে। ত্রিশঙ্কু ১২টি পুরসভারও বেশ কয়েকটি দখল করার আশায় তারা। কিন্তু তার পরেও এক তৃণমূল সাংসদের খেদোক্তি, ‘‘আমরা জিতব তো জানাই ছিল! কিন্তু এমন ভাবে ভোটটা হল, লোকে বলবে মেরেধরে জিতেছে!’’ শাসক দলেরই আর এক রাজ্য নেতার উপলব্ধি, ‘‘নিজেদের জয় নিজেরাই যেন কলঙ্কিত করে ফেললাম! জয়ের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে গেল!’’
গত বছরের লোকসভা ভোট এবং তার পরে দু’দফায় বিধানসভা-লোকসভা মিলিয়ে চারটি আসনের উপনির্বাচনের ফলের দিকে তাকালে পুরভোটে তৃণমূলের সাফল্য নিয়ে কোনও সংশয় কোনও মহলেই ছিল না। কলকাতার পুরভোটের আগে দু’দফায় জনমত সমীক্ষাও ইঙ্গিত দিয়েছিল, ১০০-র বেশি আসন পেয়ে ক্ষমতায় ফিরছে তৃণমূল। কিন্তু তার পরেও গত ১৮ এপ্রিল, ভোটের দিন কার্যত লাগামছাড়া সন্ত্রাস ও গা-জোয়ারি দেখল কলকাতা। আর মঙ্গলবার সেই ভোটের ফলপ্রকাশের পরে বিস্মিত শহরের কটাক্ষ, ‘‘এত করেও ১১৪!’’ তৃণমূলের এক তরুণ নেতার কথায়, ‘‘একশোর বেশি আসন আমরা এমনিতেই পেতাম। জুলুম করে আসন তার থেকে খুব বেশি বাড়ল না। অথচ লোকের মনে প্রশ্ন উঠে গেল, রিগিং না-করলে তৃণমূল জিততে পারত কি না, তা নিয়েই।’’
তাঁদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের জবাব দিতে তৃণমূল নেতারা প্রকাশ্যে অবশ্য ওই ১১৪-কেই পাল্টা হাতিয়ার করছেন। তাঁরা বলছেন, কলকাতায় সব ভোট লুটে নিলে বিরোধীরা কিছু আসন জিতল কী ভাবে? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বলেছেন, ‘‘রিগিং হলে কি পরেশ পাল হারতো? শহরের ৭ আর ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে আমরা হারতাম? আপনারাই (সংবাদমাধ্যম) তো হিসেব করে বলেছিলেন, ১১০ পাব! সেখানে ১১৪! অঙ্কতেই ক্লিয়ার যে, রিগিং হয়নি!’’
রাজ্যের অন্যত্রও তৃণমূলের জয়ে কোনও কলঙ্কের দাগ আছে বলে মানতে চাননি মমতা। তাঁর দলের বিরুদ্ধে ওঠা যাবতীয় অভিযোগ ‘সংবাদমাধ্যমের বানানো’ বলে নস্যাৎ করে তৃণমূল নেত্রীর মন্তব্য, ‘‘ওদের (বিরোধী) তো এত পাওয়ার কথা ছিল না! আর কী চায়!’’ যা শুনে বিরোধীদের অনেকের ব্যাখ্যা, যে পরিমাণ রিগিংয়ের নিদান মমতা দলের নেতাদের দিয়েছিলেন, তা তাঁরা পালন করতে পারেননি— এই কথাটাই নিজের অজান্তে বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি।
তবে নেত্রীর মনপসন্দ না হলেও যা হয়েছে, তা-ই বা কম কী! উদাহরণ হিসেবে কলকাতা পুরসভারই একাধিক ওয়ার্ডের ফল তুলে ধরছেন বিরোধীরা। যেমন, ৬৬ নম্বর ওয়ার্ড। সেখানে ৩০ হাজারের বেশি ভোটে জিতেছেন তৃণমূল প্রার্থী ফৈয়াজ আহমেদ খান। যা দেখে দলের নেতারাই বলছেন, এ তো বাম আমলে কেশপুরে নন্দরানি ডলের জয়কে ছাপিয়ে যাওয়ার জোগাড়। ফৈয়াজ একা নন। ১০ হাজারের বেশি ভোটের ব্যবধানে জিতেছেন শাসক দলের আরও ১৪ জন প্রার্থী। এবং যার জেরে কলকাতা শহরে তৃণমূলের ভোট গত লোকসভা নির্বাচনের থেকে ১৩ শতাংশেরও বেশি বেড়ে ৫০.৭ শতাংশ হয়ে গিয়েছে বলে বিরোধীদের অভিযোগ।
সরকারি ভাবে কোনও শতাংশের হিসাব অবশ্য মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। কিন্তু বেসরকারি সূত্রের বিশ্লেষণ থেকে পাওয়া ভোট শতাংশের এই হিসেব দেখেই সিপিএমের বিমান বসু, বিজেপি-র শমীক ভট্টাচার্য বা কংগ্রেসের অধীর চৌধুরীরা একযোগে প্রশ্ন তুলছেন, ভোটপ্রাপ্তির এই শতাংশের হিসাবে আদৌ কি কিছু এসে যায়? তাঁদের মতে, ‘‘যে ভোটে এত ব্যাপক ছাপ্পা আর জালিয়াতি, সেখানে ভোটপ্রাপ্তির হিসাব থেকে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর মানেই হয় না!’’ তৃণমূলের এক অভিজ্ঞ নেতাও ঘরোয়া আলাপচারিতায় মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন, ‘‘ভোটে জল থাকলে হিসেব দিয়ে আর কী হবে!’’
তবে এই হিসেবই স্বস্তি বাড়িয়েছে বাম মহলের। কারণ, একে তো গত লোকসভা ভোটের তুলনায় তাদের আসনসংখ্যা বেড়েছে। সেই সঙ্গে লাগাতার বেশ কয়েকটি নির্বাচনের পরে এই প্রথম ধরা পড়ছে বামেদের রক্তক্ষরণ কমার ইঙ্গিত। লোকসভা ভোটে বামফ্রন্টের ভোট ছিল ২৪.৯৫%। এ বার হয়েছে ২৪.৫%। বাম নেতাদের দাবি, সন্ত্রাস-রিগিং না হলে এই হার অনেকটাই বাড়ত।
শুধু কলকাতা নয়, উত্তর দমদম থেকে কাটোয়া, তাহেরপুর থেকে গঙ্গারামপুর— রাজ্যের সর্বত্র ভোট দিতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন সাধারণ মানুষ, তা নজিরবিহীনই বলা চলে। প্রিসাইডিং অফিসারেরা যে আতঙ্কের কাহিনির বর্ণনা দিয়েছেন, যে ভাবে তাঁদের অনেকে প্রকৃত ঘটনার রিপোর্ট নির্বাচন কমিশনকে দিতে ভয় পেয়েছেন বা রিপোর্ট দিলেও মাঝপথে তা বদলে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে, এ সবের পরে তৃণমূলের বিপুল জয়ের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য, এমনই মনে করছে বিরোধী শিবির এবং প্রশাসনিক মহলের একাংশও। প্রসঙ্গত, রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায় এ দিনও বলেছেন, ‘‘অবাধ ও সুষ্ঠু ভোট করার জন্য সব রকম চেষ্টা হয়েছে। সবটা হয়েছে, তা বলব না।’’
তৃণমূলের পুর-জয়ের ‘নেপথ্য রহস্য’ নিয়ে নানা চাপানউতোরের পাশাপাশিই এ বারের পুরভোটের বিশেষ চর্চার বিষয় শিলিগুড়িতে প্রাক্তন পুরমন্ত্রীর ‘কামব্যাক’! শাসক দল সন্ত্রাস করছে বলে শুধু অভিযোগ করে ক্ষান্ত হব না। নিজেরা মোকাবিলার জন্য তৈরি থাকব। ভোটের দিন ভোটার বা এজেন্ট বাধা পেলে সব বিরোধী দলের শক্তিকে এককাট্টা করে ভোটারদের বুথে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করব। নিজে সামনে দাঁড়িয়ে এবং মাটি কামড়ে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেব। এ সব ফর্মুলাই হাতে-কলমে প্রয়োগ করে দেখিয়ে উত্তরবঙ্গের রাজধানীতে তৃণমূলের গৌতম দেবের রমরমা ঠেকিয়েছেন অশোকবাবু। ধারাবাহিক ভাবে একের পর এক নির্বাচনে তৃণমূলের হাতে বিপর্যস্ত হচ্ছিল বামেরা। তার উপরে সন্ত্রাস এবং জালিয়াতির অভিযোগ এ বারের পুরভোটকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিল। এই আবহে অশোকবাবুর সাফল্য শুধু বামেদের মনোবলই ফেরায়নি, এ দিন দিল্লিতে সংসদ চত্বরে পর্যন্ত নানা দলের সাংসদদের চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিরোধী শিবিরে অনেকে বলছেন, যাঁকে সমর্থন করলে শাসক দলকে হারানো যায়, তলায় তলায় তাঁর পক্ষেই একজোট হব— শিলিগুড়িতে অশোকবাবুর সাফল্যের পরে এই ‘মানুষের জোট’ মডেল আগামী বিধানসভা ভোটেও অনিবার্য হয়ে উঠতে চলেছে! যা করলে বিরোধী ভোট ভাগাভাগি আটকানো যাবে, তাত্ত্বিক অবস্থানের বাইরে এসে নিচু তলার কর্মী-সমর্থকেরা মানুষকে সঙ্গে নিয়ে তা-ই করবেন। খোদ অশোকবাবুও বলেছেন, ‘‘শুধু শিলিগুড়ির পুরসভা নয়। এ রাজ্যের গণতন্ত্র রক্ষার জন্যই লড়াইটা লড়েছিলাম। তৃণমূলের বিরোধী ভোটটা দু-তিন জায়গায় ভাগ হওয়া আমরা আটকাতে চেয়েছি।’’ অশোকবাবু ও জেলায় তাঁর দলের লড়াকু মনোভাব দেখেই সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক শিলিগুড়ি গিয়ে ভোটের আগে প্রাক্তন পুরমন্ত্রীকে দলের মেয়র পদপ্রার্থী ঘোষণা করে এসেছিলেন। যা বাম দলে সচরাচর হয় না। শিলিগুড়ির সাফল্যের পরে উত্সাহিত এক বাম সমর্থক সোশ্যাল সাইটে মন্তব্য করেছেন, ‘অশোকবাবু সেলাম। আপনিই পথ দেখালেন। উদয়নবাবু (ফরওয়ার্ড ব্লকের উদয়ন গুহ, যিনি দিনহাটা ও কোচবিহারে তৃণমূলের রথ থমকে দিয়েছেন) আপনাকেও কুর্নিশ। ইশ্, তিন বছর আগেই যদি সূর্যকান্ত মিশ্র দলের ভার নিতেন’!
অশোকবাবুর মতোই ঘাঁটি আগলে থেকে নিজেদের তালুকে তৃণমূলের প্রকোপ রুখেছেন ফব-র উদয়নবাবু, কংগ্রেসের দীপা দাশমুন্সি, রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, অধীর চৌধুরীরা। পক্ষান্তরে, যোগ্য সেনাপতির অভাবেই উত্তর ২৪ পরগনা ও হুগলি শিল্পাঞ্চলে তৃণমূলের ‘সন্ত্রাসে’র মোকাবিলায় একেবারে ব্যর্থ হয়ে প্রায় শূন্য হাতে ফিরেছে বিরোধীরা! একই সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে কিছু ওয়ার্ড জেতা ছাড়া কোনও এলাকায় সে ভাবে দাপট প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি বিজেপি। যা থেকে শিক্ষা নিয়ে বিরোধী শিবিরের এক বিধায়ক বলেন, ‘‘এ বার এলাকায় এলাকায় অশোক ভট্টাচার্য তৈরি হবে! বিধানসভায় কিন্তু অন্য লড়াই!’’