সুমিত নাহা
তোলাবাজি-হুমকি-মৃত্যু। এবং ফের জড়াল রাজ্যের শাসক দলের নাম!
হাওড়া স্টেশনের কাছে এক হোটেল মালিককে রবিবার মধ্যরাতে ফোনে হুমকি দেওয়া এবং তার জেরে রাতেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যুর ঘটনায় অভিযোগের আঙুল উঠল হাওড়ার দুই তৃণমূল কর্মী রিয়াজ আহমেদ এবং দীপক সাউয়ের বিরুদ্ধে। মৃত হোটেল মালিকের নাম সুমিত নাহা (৫০)। তাঁর বাড়ি বাগুইআটির মহাবীরনগরে। সোমবার সন্ধ্যায় বাগুইআটি থানার পুলিশ সুমিতবাবুর বাড়িতে যায়। মৃতের মা মঞ্জু নাহা এবং বোন সোমা রায়ের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের বয়ান নেয়। ছেলের মৃত্যুর জন্য রিয়াজ, দীপক-সহ কয়েক জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন মঞ্জুদেবী।
ঘটনাটা কী?
হাওড়া স্টেশনের গা-ঘেঁষে যেখানে দূরপাল্লার বাসস্ট্যান্ড, সেখানেই সুমিত নাহার মাঝারি মানের হোটেলটি। তাঁর বাড়ির লোক এবং হোটেলের একাধিক কর্মীর অভিযোগ, গত বছর দেড়েক ধরেই ওই হোটেলটিতে যথেচ্ছ তোলাবাজি চালাচ্ছিল দীপক, রিয়াজ-সহ কয়েক জন দুষ্কৃতী। এরা সকলেই তৃণমূল কর্মী বলে এলাকায় পরিচিত। হোটেলের একটি ঘর রোজ রেখে দিতে হতো এদের এক জনের ‘নামে’। অভিযোগ, সেই ঘরেই প্রতিদিন মদের আসর বসাত দুষ্কৃতীরা। সেই সঙ্গে চলত যখন খুশি তোলা আদায়, ক্যাশবাক্স থেকে ইচ্ছেমতো টাকা তুলে নেওয়া বা হোটেলের প্রতিদিনের জমা-খরচের হিসেব দেখতে চাওয়া। প্রতিবাদ করলেই সুমিতবাবু ও তাঁর হোটেলের ম্যানেজার আশিস মান্নাকে খুনের হুমকি দেওয়া হতো। এমনকী আশিসবাবুকে গত ২০ জুন হোটেলে ঢুকে মারধরও করা হয়। তা নিয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ করেও লাভ হয়নি। এর মধ্যেই রবিবার রাতে হুমকি ফোন পান সুমিতবাবু। তাঁর পরিবারের অভিযোগ, প্রায় মধ্যরাতে ওই ফোনটি করে খুনের হুমকি দেয় রিয়াজ। সেই ফোন আসার কিছু পরে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বাড়িতেই মৃত্যু হয় সুমিতবাবুর।
দীপক সাউ ও রিয়াজ
তোলাবাজি থেকে শুরু করে সিন্ডিকেট রাজ্য জুড়ে একের পর এক ঘটনায় জড়াচ্ছে তৃণমূল কর্মীদের নাম। দলের শীর্ষ নেতৃত্ব বার বার সাবধানবাণী শোনালেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। উল্টে নতুন নতুন জায়গায় মাথাচাড়া দিচ্ছে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। শাসক দলের দাদাগিরিতে নবতম সংযোজন হাওড়ার ঘটনা। যে প্রসঙ্গে স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক অশোক ঘোষের মন্তব্য, “এই ঘটনায় তৃণমূলের নাম জড়ানোয় অত্যন্ত খারাপ লাগছে। বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রীর নজরে আনার চেষ্টা করছি। এই সব ঘটনায় দলের ক্ষতিই হচ্ছে।” উত্তর হাওড়ার তৃণমূল সভাপতি ও হাওড়ার পুরসভার মেয়র পারিষদ গৌতম চৌধুরী বলেন, “আমাদের দলের কোনও কর্মী জড়িত রয়েছেন কি না, তা তদন্ত করে দেখা হবে। কেউ জড়িত থাকলে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” জেলা তৃণমূলের একাধিক শীর্ষ নেতা অভিযুক্তদের তাঁদের দলের সক্রিয় কর্মী বলে মেনে নিলেও জেলার মন্ত্রী অরূপ রায়ের অবশ্য দাবি, “দু’বছর আগে ওদের দু’জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে।”
পুলিশ সূত্রের খবর, পারিবারিক হোটেল ব্যবসা সুমিতবাবুদের। বাবার মৃত্যুর পর দীর্ঘদিন ধরেই সুমিতবাবু ও তাঁর মা মঞ্জু নাহা হাওড়ার ওই হোটেলটি চালাচ্ছিলেন। পরিবারের লোকেদের অভিযোগ, বছর দেড়েক ধরেই দীপক, রিয়াজ-সহ এলাকার কয়েক জন তৃণমূল কর্মী নানা ভাবে তাঁদের ব্যবসায় সমস্যা তৈরি করছিল।
পুলিশ সূত্রের খবর, গত ৯ জুন হোটেলে ম্যানেজার হিসেবে কাজে যোগ দেন স্থানীয় গোলাবাড়ি থানা এলাকার ঘাসবাগানের বাসিন্দা আশিস মান্না। তিনি কাজে যোগ দেওয়ার পর জানতে পারেন দীপক সাউ নামে স্থানীয় এক তৃণমূল কর্মীর জন্য প্রতিদিন হোটেলের এক নম্বর ঘরটি বুক করে রাখতে হয়। এমনকী, প্রতিদিনের হোটেলের আয়-ব্যয়ের হিসেবও তাকে দেখাতে হয়। আশিসবাবু এ সবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে দীপক। গত ২০ তারিখ সন্ধ্যায় হোটেলে ঢুকে তাঁকে মারধর করে মোবাইল কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। হোটেলের সিসিটিভি ফুটেজে সেই ছবি ধরাও পড়েছে। ঘটনার পর দীপকের বিরুদ্ধে গোলাবাড়ি থানায় লিখিত অভিযোগ করেন আশিসবাবু ও তাঁর স্ত্রী রীনা। সেই অভিযোগ প্রত্যাহার করার জন্য আশিসবাবুর পাশাপাশি সুমিতবাবুকেও চাপ দেওয়া হচ্ছিল। চলছিল খুনের হুমকিও। রবিবার বিকেলের পর বিষয়টি চরমে ওঠে।
মৃত ব্যবসায়ী সুমিত নাহার মেয়ে উপাসনা এবং স্ত্রী মৌসুমী নাহা। ছবি: শৌভিক দে।
রবিবার কী হয়েছিল? আশিসবাবু এ দিন বলেন, “রবিবার সন্ধ্যায় মালিক হোটেলে এসেছিলেন দীপককে বোঝাবার জন্য। কিন্তু ওঁর সামনেই আমাকে ওরা ফের খুনের হুমকি দেয়। উনি প্রতিবাদ করায় ঘাড় ধাক্কা দিয়ে হোটেল থেকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করে। লজ্জা, অপমানে বাড়ি ফিরে যান তিনি।’’ আশিসবাবুর কথায়, “আমি ও স্ত্রী নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। কারণ, দীপকের নামে থানায় অভিযোগ করার পরেও পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। উল্টে প্রতিনিয়ত হুমকি শুনতে হচ্ছে।”
মৃতের পরিবারের লোকেরা জানিয়েছেন, রবিবার অনেক তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরেন সুমিতবাবু। অন্য দিন যেখানে বাড়ি ঢুকতে সাড়ে দশটা-এগারোটা বেজে যেত, রবিবার সেখানে সন্ধ্যা ছ’টার মধ্যেই ফিরে আসেন। মঞ্জুদেবী জানান, ছেলেকে অত তাড়াতাড়ি ফেরার কারণ জানতে চাওয়ায় সে ভেঙে পড়ে। বলেন, “মা, ওখানে আর ব্যবসা করা যাচ্ছে না। রোজ ওরা হমকি দিয়ে বলছে মেরে পুঁতে ফেলব। হোটেলটা এ বার বিক্রিই করে দিতে হবে।”
সুমিতবাবুর স্ত্রী মৌসুমী জানান, গত কয়েক দিন ধরে খুবই মানসিক চাপের মধ্যে ছিলেন তাঁর স্বামী। হোটেল যাওয়ার ব্যাপারেও নানা গড়িমসি করতেন। রবিবার বাড়ি ফেরার পর থেকে ছটফট করছিলেন। রাতে বিছানায় বসে টিভিতে ফুটবল ম্যাচ দেখতে দেখতেই রাতের খাওয়া খেয়েছেন। কিন্তু খেলাতেও মন দিতে পারছিলেন না। “রাত দেড়টা নাগাদ সুমিতবাবুর মোবাইলে একটা ফোন আসে। তিনি ফোনটা নিয়ে বারান্দায় গিয়ে কথা বলেন। তার পরে আরও তিন-চার বার ফোন আসে।” মৌসুমীর কথায়, রাত আড়াইটে নাগাদ আচমকাই গোঙানির আওয়াজে ঘুম ভেঙে পাশে তাকিয়ে দেখি ওঁর জিভ জড়িয়ে গিয়েছে, গোঙাচ্ছেন। কোনও মতে ওঁকে ধরে বাথরুমে নিয়ে যাই। কিন্তু সেখানেই পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারান। ডাক্তার এসে পরীক্ষা করে জানান, ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। সব শেষ।”
হাওড়ার পুলিশ কর্তারা কী বলছেন? পুলিশ কমিশনার অজেয় রানাডের কথায়, “ঘটনার পর থেকেই অভিযুক্ত দীপক সাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তার খোঁজে তল্লাশি চলছে। তবে রিয়াজ আহমেদের ব্যাপারে আমাদের কাছে কোনও অভিযোগ নেই।” পুলিশ কমিশনার জানান, হোটেলের ম্যানেজারকে মারধরের সঙ্গে হুমকি ফোনে হোটেল মালিকের মৃত্যুর ঘটনার যোগ আছে কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
কেন আগে পুলিশের দ্বারস্থ হননি তাঁরা? মঞ্জুদেবীর বক্তব্য, “কী করব? আমাদের তো ব্যবসাটা চালাতে হবে। ছেলে বলত, ‘মা, ওরা পকেটে রিভলবার গুঁজে আসে’। আমরা তাই সাহস পেতাম না। মুখ বুজে সব সহ্য করেছি।” পরিবারের লোকেদের অভিযোগ, মাসের পর মাস মানসিক চাপ সহ্য করছিলেন সুমিতবাবু। তাতেই তাঁর শরীর-মন ভেঙে পড়েছিল। রবিবার মধ্যরাতে হুমকি ফোন বিপর্যয় ডেকে আনে।
সুমিতবাবুর এক ছেলে, এক মেয়ে। মেয়ে উপাসনার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ছেলে তথাগত বিশাখাপত্তনমে একটি স্কুলে পড়ে। সুমিতবাবুর দেহ গোরাবাজার মিউনিসিপ্যাল হাসপাতালে রাখা হয়েছে। মঙ্গলবার সকালে ছেলে ফিরলে তাঁর সৎকার হবে।
প্রাণে বাঁচতে হোটেলের ব্যবসা তুলে দিতে চেয়েছিলেন সুমিতবাবু। এ বার কি তা হলে সেই পথেই হাঁটবে তাঁর পরিবার? মেয়ে উপাসনা বলেন, “কখনও না। আমরা অপরাধীদের চরম শাস্তি চাই। এত সাহস ওরা পাচ্ছে কোথা থেকে সেটাই আমাদের প্রশ্ন। এখন আমরা যদি ব্যবসা বন্ধ করে দিই, তা হলে ওদের সাহস আরও বেড়ে যাবে।”