গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
মাত্র ছ’মাস। তার মধ্যেই ভগ্নমনোরথ দশা কাটিয়ে নিমেষে চাঙ্গা হয়ে উঠল তৃণমূল। ৩টি বিধানসভা আসনের উপনির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চমকে দেওয়া পুনরুত্থান ঘটালেন নিজের দলের। তৃণমূলের ২১ বছরের ইতিহাসে কোনও দিন জয় মেলেনি যে দুই আসনে, সেই কালিয়াগঞ্জ এবং খড়্গপুর সদর আসনও ছিনিয়ে নিল ঘাসফুল। আর লোকসভা নির্বাচনে করিমপুরে যে ব্যবধানে এগিয়ে ছিল তৃণমূল, এ বার জিতল তার চেয়ে অনেকটা বেশিতে।
প্রত্যাশিত ভাবেই উচ্ছ্বসিত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অন্য দিকে, বিজেপি নেতা মুকুল রায় বলছেন, ‘‘মানুষ কেন প্রত্যাখ্যান করলেন, বিশ্লেষণ করতে হবে।’’
বিজেপির বিশ্লেষণে কী উঠে আসবে, তা জানার জন্য বিজেপি কর্মীরা হয়তো অপেক্ষা করবেন। কিন্তু রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা একাধিক ‘ফ্যাক্টর’-এর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করতে শুরু করেছেন। বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী জেলা উত্তর দিনাজপুর এবং নদিয়ার কালিয়াগঞ্জ ও করিমপুর আসনে এনআরসি আতঙ্ক বড় ফ্যাক্টর হয়েছে বলে পর্যবেক্ষকদের মত। ও-পার বাংলা থেকে উদ্বাস্তু হয়ে চলে আসা লোকজন বা তাদের উত্তরসূরিদের সংখ্যা দুই আসনেই বিপুল। অতএব এনআরসি হলে নাগরিকত্ব চলে যাওয়ার আতঙ্ক গ্রাস করেছিল অনেককেই। যে সব পরিবার ও-পার বাংলা থেকে আসেননি, তাঁদের মধ্যেও নাগরিকত্বের প্রমাণ দেওয়ার নথি নিয়ে উদ্বেগ ছিল। কারণ পুরনো নথি সংরক্ষণের অভ্যাস অনেকেরই নেই। জমিজমার কাগজপত্রেও বংশ পরম্পরায় ভুল রয়েছে অনেকেরই।
আরও পড়ুন: ছ’মাসেই বদলে গেল হাওয়া, বিজেপি ২ থেকে শূন্য, তৃণমূল ১ থেকে ৩
এনআরসি হলে নিজের দেশেই উদ্বাস্তু হয়ে যেতে হবে, এ কথা বার বার বলতে শুরু করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পাড়ায় পাড়ায় মিটিং করে একই কথা বলতে শুরু করেছিলেন তৃণমূল নেতারাও। আর তার পাশাপাশি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই আশ্বাসও দিতে শুরু করেছিলেন যে, তিনি থাকতে বাংলায় এনআরসি হতে দেবেন না।
তৃণমূলের এই তুমুল প্রচারের মোকাবিলা বিজেপি একেবারেই করতে পারেনি। এনআরসি আসার আগে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল সংসদে পাশ করানো হবে বলে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ একাধিক বার বলেছেন। নতুন নাগরিকত্ব আইনে বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানিস্তান থেকে আসা সব হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, খ্রিস্টান ও পার্সিকে শরণার্থী হিসেবে ধরে নিয়ে ভারতের নাগরিকত্ব দিয়ে দেওয়া হবে— এ কথাও অমিত শাহ বলেছিলেন। কিন্তু তাতে সংশয় এবং আতঙ্ক যে পুরোপুরি কাটেনি, উপনির্বাচনের ফলেই তা প্রমাণিত।
কেন কাটেনি আতঙ্ক? বিশ্লেষকরা বলছেন, একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, তৃণমূল যে ভাবে বিষয়টি নিয়ে প্রচারে নেমেছিল, বিজেপির পাল্টা প্রচারের তীব্রতা তার ধারেকাছে ছিল না। দ্বিতীয়ত, অমিত শাহের ঘোষণার পরেও বিভ্রান্তি ছিল বিস্তর। যে সব জনগোষ্ঠীকে শরণার্থী ধরে নিয়ে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে বলে অমিত শাহ জানিয়েছিলেন, তাঁদেরও কি নথি দেখাতে হবে এনআরসি প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পরে? ছিল এই প্রশ্ন। যদি নথি ঠিক মতো দেখানো না যায়, তা হলে কী হবে? ছ’বছরের জন্য ভোটাধিকার এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা হারিয়ে শুধু শরণার্থী হিসেবে দিন কাটাতে হবে? তার পরে গিয়ে ফিরে পাওয়া যাবে অধিকারগুলো? ছিল এই প্রশ্নও। কিন্তু বিজেপির কাছে সে সবের স্পষ্ট উত্তর ছিল না। যেটুকু উত্তর ছিল, তা নিয়েও দরজায় দরজায় পৌঁছে যাওয়ার পরিশ্রমটা বিজেপি করেনি বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মত।
উত্তর দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জ বরাবরই কংগ্রেসের দুর্গ ছিল। কোনও দিন সেখানে জেতেনি তৃণমূল। এ বারের লোকসভা নির্বাচনে সেই দুর্গ কংগ্রেসের হাতছাড়া হয় ঠিকই, কিন্তু তৃণমূলের হাতে যায়নি। যায় বিজেপির দিকে। রায়গঞ্জ লোকসভা আসনের বিজেপি প্রার্থী দেবশ্রী চৌধুরী প্রায় ৫৮ হাজার ভোটে এগিয়ে যান কালিয়াগঞ্জ বিধানসভা এলাকা থেকে। সেই কেন্দ্র কী ভাবে হাতছাড়া হয়ে গেল ছ’মাসের মধ্যে, এর জবাব দেওয়া দেবশ্রীর পক্ষে সত্যিই কঠিন হবে।
কংগ্রেস বিধায়ক প্রমথনাথ রায়ের প্রয়াণে কালিয়াগঞ্জ আসন খালি হয়েছিল। এ বারের উপনির্বাচনে কংগ্রেস আবার বামেদের সঙ্গে জোট গড়ে লড়ছিল। কিন্তু বাম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী ধীতশ্রী রায় যে লড়াইয়ে নেই, তা আগেই আঁচ করা গিয়েছিল। ফল প্রকাশিত হওয়ার পরেও দেখা গেল সিপিএম এবং কংগ্রেস আলাদা আলাদা করে যে ভোট পেয়েছিল লোকসভা নির্বাচনে, এ বার ধীতশ্রী রায় তার অর্ধেক ভোট পেয়েছেন।
কালিয়াগঞ্জের মতো করিমপুরেও কিন্তু বাম এবং কংগ্রেসের ভোট অনেক কমে গিয়েছে। ২০১৬ সালে কংগ্রেস সমর্থিত সিপিএম প্রার্থী করিমপুরে পেয়েছিলেন ৭৫ হাজার ভোট। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে আলাদা আলাদা লড়ে কংগ্রেস পায় ২২ হাজারের কিছু বেশি আর সিপিএম পায় সাড়ে ১৭ হাজারের মতো। সেই ভোট যোগ করলে যা হয়, কংগ্রেস সমর্থিত সিপিএম প্রার্থী গোলাম রাব্বি এ বার পেয়েছেন তার অর্ধেক।
করিমপুর বিধানসভায় বরং কিছুটা স্বস্তিতে বিজেপি। হার হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ছ’মাসে ভোট প্রায় হাজার পাঁচেক বেড়েছে।
ভোট কৌশলী প্রশান্ত কিশোর (পিকে)-ও এই নির্বাচনে ফ্যাক্টর হয়েছেন বলে রাজনৈতিক শিবির মনে করছে। লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল ধাক্কা খাওয়ার পরেই তাঁকে নিয়ে এসেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অপ্রত্যাশিত ধাক্কার জেরে মনোবল হারিয়ে তৃণমূল কর্মীরা যাতে ঘরে ঢুকে না যান, সর্বাগ্রে সেটাই নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন পিকে। রাজ্য জুড়ে তৃণমূলের জন্য একের পর এক জনসংযোগ কর্মসূচি বেঁধে দেওয়া, ‘দিদিকে বলো’ কর্মসূচির মাধ্যমে সব ব্লকে নেতৃত্বকে ময়দানে থাকতে বাধ্য করা, বিভিন্ন স্তরের জনপ্রতিনিধিদের গ্রামে গ্রামে বা ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে পাঠিয়ে কর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক এবং খাওয়া-দাওয়া সারতে বাধ্য করা, কর্মীদের বাড়িতে রাত কাটাতে বাধ্য করা— এ সবের মাধ্যমে তৃণমূলের সংগঠনকে পিকে সচল রেখেছিলেন। ফলে বিভিন্ন ইস্যুতে বিজেপির বিরুদ্ধে তৃণমূলের বক্তব্য জনতার কাছে পৌঁছে দিতে দলের অসুবিধা হয়নি। ভেঙে না পড়তে দিয়ে সংগঠনকে সচল রাখতে পারা, এই নির্বাচনে ঘুরে দাঁড়াতে তৃণমূলকে খুব সাহায্য করেছে বলে বিশ্লেষকদের মত।
উল্টো দিকে, বিজেপির মধ্যে আত্মতুষ্টি কাজ করতে শুরু করেছিল বলেও রাজনৈতিক শিবিরের বড় অংশই মনে করছে। বিজেপি নেতাদের অনেকে আড়ালে মানছেন যে, লোকসভা নির্বাচনে এ রাজ্যে ১৮টা আসন পেয়ে যাওয়ার পরে নেতৃত্বের কেউ কেউ অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসে ভুগতে শুরু করেছিলেন। ফলে তৃণমূলের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপানোর তাগিদও বিজেপি অনুভব করেনি।
৩টি আসনের সব ক’টিতেই হারের পরে কিন্তু প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে রাজ্য নেতৃত্বের সক্ষমতা নিয়েও। তৃণমূলের বিরুদ্ধে যে সব ইস্যু নিয়ে রাজ্য জুড়ে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলা যেত, সেগুলো কি আদৌ কাজে লাগাতে পেরেছে রাজ্য বিজেপি? উঠেছে সে প্রশ্ন। তৃণমূল, বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে যোগদানের যে ঢল শুরু হয়েছিল লোকসভা ভোটের ফল প্রকাশের পরে, সেই ঢল কেন থেমে গেল, প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েও। অন্যান্য দল থেকে বিজেপিতে ঢুকেছেন যে নামী নেতারা, তাঁরা বিজেপিতে কতটুকু গুরুত্ব পেয়েছেন? রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে আরও যাঁরা বিজেপির সঙ্গে জুড়তে চাইছিলেন, যোগদানের পরে তাঁরা কতটা গুরুত্ব পাবেন? এ নিয়ে বিস্তর সংশয় তৈরি হয়েছিল। ফলে বিজেপিতে যোগদানের ঢল অচিরেই থেমে যায়। সে প্রসঙ্গে এ দিন বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বকে দলের এক মুখপাত্রের কটাক্ষ, ‘‘তৃণমূলের ভাঙন তো তৃণমূলকে ঠেকাতে হল না। আমরা নিজেরাই ঠেকিয়ে দিলাম।’’ কেন এমন মন্তব্য? তাঁর জবাব, ‘‘বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পরে তৃণমূলের একাধিক বড় নাম কী অবস্থায় পড়ে রয়েছেন, তা দেখেই অনেকে আর পা বাড়ানোর সাহস করেননি। তৃণমূলের হয়েই তাঁরা লড়াইটা চালিয়ে যাওয়ায় মন দিয়েছেন। ফলে তৃণমূলের পালের হাওয়া যতটা কেড়ে নেওয়া সম্ভব ছিল, ততটা পারিনি।’’
ফলপ্রকাশের পর কালিয়াগঞ্জে তৃণমূলের উচ্ছ্বাস। ছবি: পিটিআই।
আরও পড়ুন: লাথি-কাণ্ডের সেই বুথে মাত্র দুটো ভোট পেলেন বিজেপি-র জয়প্রকাশ
শুধু অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস, আত্মতুষ্টি, আন্দোলন বিমুখতা বা তৃণমূলে ভাঙন ধরাতে না পারা নয়— প্রার্থী বাছাই এবং নির্বাচন ব্যবস্থাপনা নিয়েও প্রশ্ন উঠে গিয়েছে গেরুয়া শিবিরের অন্দরে। খড়্গপুর সদর আসনে প্রেমচাঁদ ঝা-কে যে বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বের বড় অংশই প্রার্থী হিসেবে চাননি, তা কারও অজানা নয়। প্রেমচাঁদের ভাবমূর্তি কতটা ‘ভাল’, তা খড়্গপুরের যে কোনও প্রান্তে কান পাতলেই টের পাওয়া যায়। কিন্তু রাজ্য স্তরের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ নেতার কথা না মেনে এবং স্থানীয় আপত্তি উড়িয়ে দিয়ে দিলীপ ঘোষ প্রেমচাঁদেই অনড় ছিলেন। তার জেরে দলে বিদ্রোহ হয়। খড়্গপুরের প্রবীণ বিজেপি নেতা প্রদীপ পট্টনায়ক নির্দল হয়ে ভোটে দাঁড়িয়ে পড়েন। তাঁকে বিজেপি বহিষ্কার করে দেয়। কিন্তু তাতে দলের অভ্যন্তরীণ অনৈক্য চাপা দেওয়া যায়নি।
করিমপুরে জয়প্রকাশ মজুমদারকে প্রার্থী করা নিয়েও আপত্তি ছিল রাজ্য বিজেপির একাধিক প্রভাবশালী নামের। করিমপুরের বিজেপি কর্মীদের মধ্যেও ক্ষোভ ছিল। ভোটের কয়েক মাস আগে করিমপুরে একটি কর্মীসভায় গিয়ে বিজেপি কর্মীদের হাতেই জয়প্রকাশকে হেনস্থাও হতে হয়েছিল। তার পরেও শুধুমাত্র দিলীপ ঘোষের ইচ্ছায় জয়প্রকাশ করিমপুরে টিকিট পান বলে বিজেপির একটি অংশের দাবি। তার ফলই মিলল বলে অনেকে মনে করছেন।
তবে জয়প্রকাশকে প্রার্থী করে কোনও ভুল হয়নি বলে দিলীপ শিবিরও পাল্টা দাবি করছে। করিমপুর এমনিতেই হারা আসন। সংখ্যালঘু ভোটও বিপুল। সেই রকম আসনে বিজেপি জিতবে, এমন আশা ছিল না বলেই দিলীপ অনুগামীদের দাবি। কিন্তু ছ’মাস আগে করিমপুরে বিজেপি যত ভোট পেয়েছিল, এ বার তার চেয়ে হাজার পাঁচেক ভোট বেশি পেয়েছে। জয়প্রকাশের মতো প্রার্থীর কারণেই সেটা সম্ভব হয়েছে বলে দিলীপ শিবির দাবি করছে।
আরও পড়ুন: বিজেপির ‘ঔদ্ধত্য-অহংকার’ মানুষ ভাল ভাবে নেয়নি, উপনির্বাচনের ফল স্পষ্ট হতেই তোপ মমতার
খড়্গপুরেও ফুটল জোড়াফুল। ছবি: পিটিআই।
খড়্গপুরের প্রার্থী নিয়েও যে অসন্তোষ ছিল, এত দিনে দিলীপ নিজে তা মেনেছেন। উপনির্বাচনে এই হারের কারণ কী, তা নিয়ে বিশদে মুখ খুলতে দিলীপ রাজি হননি। সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে আলাপচারিতায় বরং লঘু করে দেখানোর চেষ্টা করেছেন উপনির্বাচনের গুরুত্বকে। তবে খড়্গপুরে যে প্রার্থী নিয়ে অসন্তোষ থেকে থাকতে পারে, সে কথা এ দিন নিজেই বলেন দিলীপ ঘোষ।
রাজ্য বিজেপির আর এক শীর্ষনেতা তথা দলের জাতীয় কর্মসমিতির সদস্য মুকুল রায় অবশ্য এই ফলাফলকে লঘু করে দেখানোর চেষ্টা করেননি। তিনি বলেন, ‘‘মানুষ আমাদের প্রত্যাখ্যান করেছেন। কেন করেছেন, তা আমাদের বিশ্লেষণ করতে হবে।’’ কিন্তু চলতি বছরে হওয়া লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের সঙ্গে এই ফলাফলের তুলনা টানতে মুকুল রায় রাজি হননি। তিনি বলেন, ‘‘দুটো নির্বাচন পুরো আলাদা। আমি ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনের সঙ্গে বরং এর তুলনা করতে পারি। কারণ সেটাতেও বাম এবং কংগ্রেসের জোট ছিল, এটাতেও ওরা জোট করে লড়েছে।’’ মুকুল রায়ের কথায়, ‘‘২০১৬-র ফলাফলের সঙ্গে যদি তুলনা করা হয়, তা হলে খড়্গপুরেই শুধু ভোট কমেছে। বাকি দুটো আসনেই আমাদের ভোট অনেক বেড়েছে। তবু আমরা খতিয়ে দেখব, কেন লোকসভা নির্বাচনে পাওয়া ভোট কালিয়াগঞ্জে ধরে রাখতে পারলাম না।’’
খড়্গপুর সদর আসনে তৃণমূল আগে কখনও জেতেনি। ওটা বরাবর ছিল কংগ্রেসের দুর্গ। ২০১৬ সালে রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ সেখানে জেতেন। ব্যবধান ছিল ৬ হাজার ৩০৯। তৃণমূল তখনও ছিল তৃতীয় স্থানে। এ বছরের লোকসভা নির্বাচনে খড়্গপুরে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে তৃণমূল। কিন্তু বিজেপি প্রার্থী দিলীপ ঘোষের চেয়ে তৃণমূলের মানস ভুঁইয়া তখনও পিছিয়ে ছিলেন ৪৫ হাজার ভোটে। ছ’মাস পরেই চমকে দিয়ে প্রথম স্থানে উঠে এল তৃণমূল। রাজ্য বিজেপির সভাপতি তথা মেদিনীপুরের সাংসদের খাসতালুকে এ বার বিজেপি-কে হারাল প্রায় ২১ হাজার ভোটে।
৩টি আসনের মধ্যে একমাত্র খড়্গপুর সদরেই বাম-কংগ্রেসের ভোট আগের চেয়ে বেড়েছে। ছ’মাস আগের ভোটটায় কংগ্রেস এবং সিপিএম যে ভোট সেখানে পেয়েছিল, তার যোগফল দাঁড়ায় সাড়ে ১৬ হাজারেরও কম। এ বার বাম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী তথা খড়্গপুরের কংগ্রেস কাউন্সিলর চিত্তরঞ্জন মণ্ডল পেয়েছেন সাড়ে ২২ হাজারের বেশি ভোট। তৃণমূল ছ’মাস আগে পেয়েছিল ৪৮ হাজারের কিছু বেশি। এ বার তার ৭২ হাজার ছাড়িয়ে গেল। কমল শুধু বিজেপি। ছ’মাস আগে যে খড়্গপুরে ৯৩ হাজার ৪২৫টি ভোট পদ্মফুলে পড়েছিল, এ বার সেখানেই বিজেপি ৫২ হাজারের সামান্য বেশি।
বিজেপির রাজ্য সভাপতির ছেড়ে যাওয়া খড়্গপুর আসনে বিজেপির এই বিপুল হারের কারণ হিসেবে শুভেন্দু অধিকারীর সক্রিয়তার কথাও কিন্তু উঠে আসছে। ওই কেন্দ্রে ভোট সামলানোর দায়িত্ব শুভেন্দুর উপরেই ছেড়েছিলেন মমতা। দিন-রাত এক করে কর্মীদের মাঠে-ময়দানে ছুটিয়েছেন শুভেন্দু। নির্বাচনী খরচেও কোনও কার্পণ্য হয়নি বলে খবর। পরিস্থিতি এমন হয়েছিল যে, খড়্গপুরের ভোট শেষ পর্যন্ত মেদিনীপুরের সাংসদ এবং রাজ্যের পরিবহণ মন্ত্রীর মধ্যে মর্যাদার লড়াইয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। সে লড়াইয়ে শেষ হাসি শুভেন্দুই হেসেছেন।
কালিয়াগঞ্জে বিজেপির পরাজয়ে আঙুল উঠছে রায়গঞ্জের সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দেবশ্রী চৌধুরীর দিকে। স্থানীয় সাংসদ হওয়ায় দেবশ্রীর উপরেও বেশ খানিকটা বর্তেছিল কালিয়াগঞ্জে দলের প্রচার এবং ভোট সামলানোর দায়িত্ব। রাজ্য বিজেপির শীর্ষনেতারা সেখানে বার বার গিয়ছিলেন ঠিকই, কিন্তু আসনটা তাঁর নিজের নির্বাচনী ক্ষেত্রের অন্তর্গত হওয়ায় দেবশ্রীর উপরে বাড়তি দায়িত্ব স্বাভাবিক ভাবেই ছিল। সে দায়িত্ব পালনে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী যে ডাহা ফেল করেছেন, তা নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের সংশয় নেই। স্থানীয় বিজেপি কর্মীদের দাবি, ভোটের প্রচারে এবং ব্যবস্থাপনার কাদের সামনে রাখা দরকার, দেবশ্রী বুঝতেই পারেননি। কালিয়াগঞ্জে এমনিতেই রাজবংশী ভোট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু প্রচার এবং ব্যবস্থাপনায় রাজবংশী নেতাদের আলাদা করে গুরুত্ব দেওয়ার কথা দেবশ্রী মাথায়ই রাখেননি বলে বিজেপি কর্মীদের অনেকেই দাবি করছেন এখন।
আরও পড়ুন: ঘাসফুল ঝড়ে উড়ে গেল পদ্ম, খড়্গপুর-কালিয়াগঞ্জ ছিনিয়ে নিল তৃণমূল, করিমপুরে বাড়ল ব্যবধান
করিমপুরে প্রার্থীর সঙ্গেই জয়ের আনন্দে মাতলেন তৃণমূল সমর্থকরা। ছবি: পিটিআই।
ভোটদাতাদের দু’রকম প্রবণতা সামনে আনল এই উপনির্বাচন।
প্রথম প্রবণতা— এনআরসি নিয়ে আতঙ্ক যে দুই আসনে বেশি, বাম-কংগ্রেসের ভোট সেখানে কমে গিয়েছে বিপুল ভাবে। রক্ষাকর্তা ভেবে নিয়ে শাসক তৃণমূলের দিকেই ঝুঁকে পড়েছেন ওই ভোটাররা। ফলে ভোট বেড়ে গিয়েছে তৃণমূলের।
দ্বিতীয় প্রবণতা— পর পর দুটো নির্বাচনে প্রথম স্থান পেয়ে খড়্গপুরে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী ছিল বিজেপি। আত্মতুষ্টি ধস নামিয়ে দিয়েছে ভোটব্যাঙ্কে। তৃণমূলের ভোট তো লাফিয়ে বেড়েছেই। ভোট বেড়ে গিয়েছে বাম-কংগ্রেসের ঝুলিতেও।