দখল নিতে নিতে উত্তর ও মধ্যবঙ্গে মরূদ্যানের মতো দাঁড়িয়ে আছে দুই পুরসভা। বামেদের শিলিগুড়ি এবং কংগ্রেসের বহরমপুর। পুজোর আগে ও পরে সেই দুই পুরবোর্ডই দখল করে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে তৃণমূল। পর্যটনমন্ত্রী গৌতম দেব সোমবার সরাসরি ঘোষণাই করে দিয়েছেন, ‘‘পুজোর পরেই শিলিগুড়ি থেকে বামপন্থীদের বিসর্জন হবে! ডিসেম্বর মাসের পরে দলে আর কোনও নতুন যোগদান হবে না। তার আগেই সব প্রক্রিয়া শেষ হয়ে যাবে।’’ আগে তাঁর দাবি ছিল, শিলিগুড়িতে ‘বিপ্লব’ হবে অগস্টে।
শহরে পানীয় জল পরিষেবা ব্যাহত হয়েছে, এই অভিযোগে এ দিন বিরোধী তৃণমূলের সঙ্গে শিলিগুড়ি পুর কর্তৃপক্ষের রেষারেষি চলেছে দিনভর। পুরসভায় ঢোকার মুখে মেয়র অশোক ভট্টাচার্যের গাড়ি আটকে দেন তৃণমূল যুব এবং ছাত্র পরিষদের (টিএমসিপি) নেতারা। তৃণমূল কাউন্সিলরেরাও বিক্ষোভ দেখান। মেয়র অশোকবাবুও পাল্টা জানিয়ে দেন, তিনি পুরসভায় ঢুকবেন। মেয়রকে হেনস্থার প্রতিবাদে এসএফআই হাসমিচকে পাল্টা অবরোধ করে। বিরোধীদের সঙ্গে বৈঠক করে বিকালের মধ্যে জল সরবরাহের ব্যবস্থা হবে বলে ডেপুটি মেয়র ঘোষণা করলে পুরসভায় অবরোধ ওঠে।
এই গোটা ঘটনাই শিলিগুড়ির পুরবোর্ডকে অচল করার লক্ষ্যে ঘটানো হয়েছে বলে বামেদের অভিযোগ। রাজ্য বামফ্রন্টের তরফে এ দিন বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকেই বিরোধী দলগুলির পরিচালিত জেলা পরিষদ, পঞ্চায়েত সমিতি, গ্রাম পঞ্চায়েত ও পুরসভা দখল করতে চাইছে শাসক দল। যত ক্ষণ না দখলদারি সম্পূর্ণ হচ্ছে, তত ক্ষণ বিরোধী পরিচালিত পুরসভা বা নির্বাচিত সংস্থাগুলির সঙ্গে অসহযোগিতা ও অর্থনৈতিক অবরোধের রাজনীতি করা হচ্ছে। বামফ্রন্টের রাজ্য নেতৃত্বের বক্তব্য, জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের ইঞ্জিনিয়াররা মেরামতির কাজ করে যে জল সরবরাহ প্রায় স্বাভাবিক করে তুলেছেন, তার জন্য মেয়রকে তৃণমূল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে হেনস্থা করেছে। মেয়র অশোকবাবুর মন্তব্য, ‘‘জনস্বাস্থ্য কারিগরি মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে অনেক বার কথা হয়েছে। কিন্তু শিলিগুড়ির তৃণমূল নেতারা যা করছেন, তা শহরের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিপন্থী।’’ এর বিরুদ্ধে জেলায় জেলায় প্রতিবাদেরও ডাক দিয়েছে বামফ্রন্ট।
এমন ঘটনা ঘটার দিনে মিত্র সম্মিলনী হলে তৃণমূলের সভায় মন্ত্রী গৌতমবাবুর মন্তব্যেই ইঙ্গিত মিলছে, শিলিগুড়ি পুরসভা ও মহকুমা পরিষদ দখলে নেওয়াই এখন তাঁদের লক্ষ্য। বিধানসভা ভোটের পরে ফের দলের জেলা সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে গৌতমবাবুকে। পাশের জলপাইগুড়ি থেকে মালদহ জেলা পরিষদও ভাঙিয়ে নিয়েছে তৃণমূল। সব মিলিয়ে ‘চাপ’ বাড়ছে গৌতমবাবুদের উপরে। সেই চাপেরই প্রতিধ্বনি শোনা গিয়েছে গৌতমবাবুর বক্তব্যে— ‘‘শিলিগুড়ি সমতলের তিনটে আসনও বিধানসভায় হেরেছি। জলপাইগুড়ি থেকে চোপড়া সব আসনে দল জিতছে, আর শিলিগুড়িতে হারছে, মানা যায় না! আমার নেতৃত্বে বারবার দলের হারে বুকে রক্তক্ষরণ হয়!’’
শিলিগুড়িতে যখন এমন অবস্থা, অধীর চৌধুরীর বহরমপুরে তখন নিশানায় কংগ্রেস। মোট ২৮ আসনের ওই পুরসভায় কংগ্রেসের হাতে ২৬ জন কাউন্সিলর। তাঁদের মধ্যে দু-এক জন এর মধ্যে কলকাতায় এসে তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন বলে শাসক সূত্রের খবর। ভাঙানোর চেষ্টা আটকাতে দফায় দফায় বৈঠক শুরু করেছে জেলা কংগ্রেস। যদিও বহরমপুরের কংগ্রেস বিধায়ক মনোজ চক্রবর্তীর দাবি, ‘‘তৃণমূল এ সব রটাচ্ছে! কোনও কংগ্রেস কাউন্সিলর তৃণমূলে যোগ দিচ্ছেন না।’’ তবে তৃণমূলের এক নেতার ইঙ্গিত, ‘‘সম্ভবত ১৮ সেপ্টেম্বর একাধিক কংগ্রেস কাউন্সিলর তৃণমূলের পতাকা হাতে তুলে নেবেন।’’
কংগ্রেসে ভাঙনের আবহে সবংয়ের বিক্ষুব্ধ বিধায়ক মানস ভুঁইয়ার ঘনিষ্ঠ চার নেতা খালেদ এবাদুল্লা, অজয় ঘোষ, মনোজ পাণ্ডে এবং কনক দেবনাথ এ দিন সাংবাদিক সম্মেলন করে দাবি করেছেন, যে ভাবে জনপ্রতিনিধিরা তৃণমূলে যোগ দিচ্ছেন, তাতে তৃণমূলই এ রাজ্যে আসল কংগ্রেস! মানসবাবুর প্রতি অবিচারের প্রতিকার চেয়ে তাঁরা সনিয়া এবং রাহুল গাঁধীকে চিঠিতে লিখেছেন, কংগ্রেসকে বাঁচাতে অবিলম্বে অধীরবাবুকে সভাপতির পদ থেকে সরানো হোক।