কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র।
ক্ষোভ, জেদ, অভিমানের দেওয়াল কি ভাঙল? দলে প্রান্তিক হয়ে যেতে যেতে, কিংবা নিজেকে প্রান্তিক করে নিতে নিতে আবার দলে তাঁর ভূমিকার মোড় ঘুরে গেল? শনিবার তৃণমূলের নির্বাচনী কমিটির বৈঠক শেষে কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রধান মুখপাত্রের ভূমিকায় দেখে চমকে উঠেছিলেন কালীঘাটেরই এক সক্রিয় তৃণমূল কর্মী। সমাজমাধ্যমে ‘লাইভ’ দেখতে দেখতে বিস্ময়ের সঙ্গে বলে উঠলেন, ‘‘আরে! কল্যাণদা!’’ এমন বিস্মিত অনেকেই হয়েছেন। বহু দিন পর তৃণমূলের রাজ্য স্তরের কোনও সাংবাদিক বৈঠকে একেবারে প্রথম সারিতে দেখা গেল তাঁকে। দলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ ও মেয়র ফিরহাদ হাকিম থাকা সত্ত্বেও কল্যাণকেই দেখা গেল দলের তরফে যাবতীয় প্রশ্নের জবাব দিতে। পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে বিরোধী শিবিরকে হুঙ্কার দেওয়ার পাশাপাশি, রাজ্যপালকেও আক্রমণ করতে ছাড়লেন না শ্রীরামপুরের তৃণমূল সাংসদ। একই সঙ্গে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সদ্য শেষ হওয়া ‘জনসংযোগ যাত্রা’ কর্মসূচির প্রশংসাও শোনা গেল তাঁর মুখে।
একটা সময় অভিষেকের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে জোর আলোচনা এবং জল্পনা চলেছিল তৃণমূলের ভিতরে-বাইরে। সেই জল্পনার নেপথ্যে ছিল কল্যাণেরই কিছু মন্তব্য। যেমন, ‘‘আমার নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর কাউকে নেতা বলে মানি না।’’ কিংবা, কম জলঘোলা হয়নি তাঁর ‘‘আগে ত্রিপুরা, গোয়া জিতে দেখান, তার পর নেতা মানব’’ জাতীয় মন্তব্য নিয়েও। সেই কল্যাণই শনিবারের সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, ‘‘আমাদের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক গত কাল তাঁর জনসংযোগ যাত্রা শেষ করেছেন। যেখানে তিনি সাধারণ মানুষের ব্যাপক সাড়া পেয়েছেন। ১০০ দিনের কাজ নিয়ে সাধারণ মানুষের ধারণা ছিল যে, প্রকল্পের পুরো অর্থই রাজ্য সরকার দেয়। কিন্তু আমাদের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক জনজোয়ার যাত্রায় মানুষকে বুঝিয়েছেন এই প্রকল্পের ৪০ শতাংশ অর্থ দেয় রাজ্য। ৬০ শতাংশ অর্থ কেন্দ্রীয় সরকার দেয়। যে হেতু কেন্দ্রীয় সরকার টাকা দিচ্ছে না। তাই মানুষ এই টাকা পাচ্ছেন না।’’ এর পর কল্যাণ বলেন, ‘‘আমরা একটি রেজোলিউশন পাশ করেছি, যেখানে বলা হয়েছে পঞ্চায়েত ভোট শেষ হয়ে গেলে ১০ লক্ষ মানুষ নিয়ে আমরা দিল্লিতে গিয়ে আন্দোলনকে সুদৃঢ় করব।’’ এই ‘আন্দোলনের’ ঘোষণা যদিও আগে শোনা গিয়েছিল স্বয়ং অভিষেকের গলায়।
কী ভাবে এল এই ‘কল্যাণকর’ পরিবর্তন? কী ভাবে কল্যাণের নব-অভিষেক হল তৃণমূলে? দলের অনেকে বলছেন, ‘নবজোয়ার’ কর্মসূচির সময়েই। অভিষেকের জনসংযোগ যাত্রা যখন হুগলির শ্রীরামপুর লোকসভায় পৌঁছেছিল, তখন সাংসদ হিসেবে সক্রিয় হয়ে অভিষেকের পাশে থেকেছিলেন কল্যাণ।
যদিও, পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে তৃণমূলের যে কমিটি গঠিত হয়েছে তাতে জায়গা হয়নি শ্রীরামপুরের তৃণমূল সাংসদের। ওই কমিটিতে রয়েছেন অভিষেক, রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী, মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, অরূপ বিশ্বাস, মলয় ঘটক ও ফিরহাদ হাকিম। পাশাপাশি বিরবাহা হাঁসদাকে তৃণমূলের আদিবাসী সেলের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তৃণমূলের প্রথম সারির ৫০ জন নেতাকে ২০-২৫ দিন রাজ্য জুড়ে প্রচারের কাজে সময় দিতে বলা হয়েছে। তাঁদের সবাইকে কম-বেশি ৪০টি করে সভা করতে হবে বলে দেওয়া হয়েছে নির্দেশ। পাশাপাশি, কল্যাণ জানিয়ে দিয়েছেন, যদি তৃণমূলের নির্দল প্রার্থীরা মনোনয়ন প্রত্যাহার না করেন তা হলে তাঁদের জন্য দলের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে। চিরকাল তাঁদের নির্দল হয়েই থেকে যেতে হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন কল্যাণ।
পঞ্চায়েত ভোটের রণনীতি ঠিক করতে শনিবার কালীঘাটে বৈঠকে বসে তৃণমূলের নির্বাচনী কমিটি। ওই বৈঠকে ছিলেন দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী-সহ অন্য নেতারা। বৈঠকের পর সাংবাদিক বৈঠকে দলের নির্দলদের উদ্দেশে হুঁশিয়ারি দেন কল্যাণ। সেখানে তিনি পঞ্চায়েত ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনীর ব্যবহার নিয়ে দলের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন। তাঁর কথায়, ‘‘কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে আমাদের কোনও মাথাব্যথা নেই। কারণ, ২০১১ সাল থেকে ২০১৪, ২০১৬, ২০১৯ ও ২০২১ সালের নির্বাচনে বার বার কেন্দ্রীয় বাহিনী এসেছে। এমনকি, ২০১৩ সালে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডেও কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে এসেছিলেন। তাতেও আমাদের জয় আটকায়নি। আর এ বার এলেও আটকাবে না। তাই এ বিষয়ে দলগত ভাবে আমাদের কোনও মাথাব্যথা নেই।’’
শনিবার সকালে ক্যানিংয়ে সন্ত্রাস কবলিত এলাকা পরিদর্শনে গিয়েছিলেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। এ প্রসঙ্গে কল্যাণের মন্তব্য, ‘‘কেবল বিজেপি ও আইএসএফের লোকজন আক্রান্ত হলে বা মারা গেলে রাজ্যপাল দেখতে যান। রাজ্যপাল একটি সাংবিধানিক পদ। তাই কোনও পদক্ষেপ করার আগে তিনি যেন নিজের সীমাবদ্ধতার কথা মাথা রাখেন।’’