এ বলে আমায় দেখ তো ও বলে আমায়...!
মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদের ১০ জন সদস্যকে শুক্রবার তৃণমূলে এনে শুভেন্দু অধিকারী সদর্পে বলেছিলেন, ‘‘ডিসেম্বরের পরে কংগ্রেস নামে কোনও বস্তু মুর্শিদাবাদে থাকবে না।’’ এর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শনিবার দক্ষিণ ২৪ পরগনার কুলতলি পঞ্চায়েত সমিতি দখল করে শোভন চট্টোপাধ্যায়ও একই সুরে জানিয়ে দিলেন, ‘‘আগামী দিনে দক্ষিণ ২৪ পরগনায় সিপিএমের চৌকি পাতারও জায়গা থাকবে না!’’ অর্থাৎ গোটা রাজ্যকে বিরোধীশূন্য করতে তৃণমূলের নেতাদের মধ্যেই যেন প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গিয়েছে!
দক্ষিণ ২৪ পরগনায় এমনিতেই তৃণমূলের ভিত শক্ত, বামেরা সেখানে যথেষ্ট দুর্বল। তার উপর যেখানে যেখানে কংগ্রেস বা সিপিএম একটু-আধটু কিছু ক্ষমতা পেয়েছিল, তাও ধুয়েমুছে সাফ করা শুরু করে দিয়েছে তৃণমূল। এ দিন সিপিএম পরিচালিত কুলতলি পঞ্চায়েত সমিতি দখল করে নিল শাসক দল। ২৭ আসনের কুলতলি পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি, সহ-সভাপতি, পাঁচ জন কর্মাধ্যক্ষ-সহ ১৩ জন সিপিএম সদস্য এ দিন তৃণমূলের ওই জেলার সভাপতি শোভন চট্টোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে তৃণমূলে যোগ দেন। ২০১৩ সালে পঞ্চায়েত ভোটে ওই পঞ্চায়েত সমিতিতে তৃণমূলের টিকিটে মাত্র দু’জন জিতেছিলেন। বামেদের ঘরে ভাঙন ধরিয়ে সেই সংখ্যা বেড়ে হল ১৫। এবং ১৯৭৮ সালের পরে এই প্রথম কুলতলি পঞ্চায়েত সমিতি অ-বাম কোনও দলের দখলে এল।
২০১৮ সালে রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোট। তার আগে রাজ্যকে বিরোধীশূন্য করাই যে এখন তৃণমূলের লক্ষ্য, তা এ দিন স্পষ্ট করে দেন শোভনবাবু। তাঁর বক্তব্য, ‘‘বিধানসভা ভোটে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে যে এ রাজ্যে বিরোধীদের অস্তিত্ব প্রায় শেষ। পঞ্চায়েতকেও বিরোধীশূন্য করার লক্ষ্যে আমরা সংগঠিত হতে চাই।’’ আর এ ভাবে বিরোধীশূন্য করার প্রেক্ষাপটেই উঠেছে নৈতিকতার প্রশ্ন। একের পর এক জেলা দখল করে রাজনৈতিক একাধিপত্য স্থাপনের এই দৃষ্টান্ত অবশ্য ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি। বাম জমানায় এ ভাবে বিরোধী দল ভাঙানো হতো না ঠিকই, কিন্তু ভোটের আগে বিরোধীদের মনোনয়ন জমা দিতে না দেওয়ার নজির আছে ভূরি ভূরি। বিরোধীদের অভিযোগ, তৃণমূল অন্য দলের টিকিটে জেতা সদস্যদের ভাঙিয়ে এনে নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব কায়েমের পথে এগোচ্ছে। যদিও এ প্রসঙ্গে শোভনবাবু বলেন, ‘‘নৈতিকতার প্রশ্ন যাঁরা করছেন, তাঁদেরই জিজ্ঞাসা করুন, তাঁরা কোন দলের কাউন্সিলর আর কোন দলের বিধায়ক! যাঁরা এ ধরনের প্রশ্ন করছেন, তাঁদের বলব উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে আমাদের দরজা সকলের জন্য উন্মুক্ত। আর কাউকে ভাঙিয়ে আনা হচ্ছে না। উন্নয়নমুখী চিন্তাধারায় সামিল হতে যাঁরা চাইছেন, তাঁদের সম্মান দিয়ে আমাদের দলে জায়গা করে দেওয়া হচ্ছে।’’ রাজ্যে ২১১টি বিধানসভা আসনে জিতেও তৃণমূলের এ হেন দল ভাঙানোর খেলাকে কটাক্ষ করে বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু এ দিন মন্তব্য করেছেন, ‘‘যেন-তেন প্রকারে জেলা পরিষদ দখলের মনোভাব গণতন্ত্রের বিরোধী। গণতন্ত্রের সমাধি তৈরি করছে তৃণমূল। এরা সব ক্ষেত্রে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করতে চাইছে। হাটে বাজারে টাকার থলি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর যারা গরু, ছাগল, ভেড়ার মতো বিক্রি হচ্ছে, তাদেরও ধিক্।’’ নিজেদের অস্তিত্ব বিপন্ন বুঝে মানুষের কাছে আরও বেশি করে যাওয়ার উপর জোর দিচ্ছে বামফ্রন্ট। আগামী ২ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির ডাকা দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট ও হরতাল নিয়ে তারা প্রচার তো করবেই। তার সঙ্গে ১৫ অগস্ট সারা রাজ্যে মানব বন্ধন, ২৩ অগস্ট ধর্মঘটের সমর্থনে প্রতিটি জেলায় অবস্থান, ৩১ অগস্ট শহিদ দিবসে মহানগর-সহ বিভিন্ন জেলায় মিছিল, পরের দিন ১ সেপ্টেম্বর ছাত্র আন্দোলনের শহিদদের রাজ্য জুড়ে স্মরণ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে শুক্রবার বামফ্রন্টের বৈঠকে।
বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নানও বলেন, ‘‘বাম জমানায় সিপিএম ভোটের আগে নানা রকম পন্থা অবলম্বন করত। কিন্তু ভোটের পরে কখনও বিরোধী দল ভাঙিয়ে নিয়ে পুরসভা, পঞ্চায়েত দখল করেনি। রাজ্যকে বিরোধীশূন্য করার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুপ্রেরণায় যে পথে তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীরা দল ভাঙানোর নোংরা খেলায় মেতে উঠেছে, তা এক ভয়াবহ পরিস্থিতি ডেকে আনছে।’’ বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের বক্তব্য, ‘‘সংখ্যার জোরে, ভয় এবং লোভ দেখিয়ে তৃণমূল শুধু তো দল ভাঙাচ্ছে না, গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত সংস্থাকেও ভাঙাচ্ছে। অর্থাৎ এটা ওদের গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই।’’