জনরোষ: বেলিয়া গ্রামে ‘কাটমানি’ নিয়ে বিবাদ। নিজস্ব চিত্র
বিক্ষোভ থেকে মুচলেকা, ঘেরাও থেকে হাতাহাতি—‘কাটমানি’র অভিযোগ তুলে বিশৃঙ্খলা থামার নাম নেই বীরভূমে। পুলিশ-প্রশাসনের পক্ষ থেকে থানায় অভিযোগ জমা দেওয়ার আবেদন করা হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গ্রামবাসীরা ঘেরাও-বিক্ষোভের পথে হাঁটছেন। কিছু ক্ষেত্রে ওই ঘটনাকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলার অবনতিও ঘটছে।
বুধবার ঠিক তেমনই ঘটেছে সাঁইথিয়ার বেলিয়া গ্রামে। সেখানে গ্রামবাসীদের চাপে ‘কাটমানি’র টাকা ফেরতের মুচলেকা দিতে হয়েছে ভ্রমরকোল পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্যকে। স্থানীয় সূত্রে খবর, কয়েক দিন আগে ওই গ্রামের পঞ্চায়েত সদস্য মিলন দেবাংশীর হাতে ‘কাটমানি’ নেওয়ার তালিকা তুলে দেন গ্রামবাসীরা। এ দিন সেই তালিকা অনুযায়ী টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য তাঁকে গ্রামের ধর্মরাজ মন্দিরে ডাকা হয়। ওই পঞ্চায়েত সদস্য এবং তাঁর অনুগামীদের সঙ্গে গ্রামবাসীর বচসা, হাতাহাতি শুরু হয়। পুলিশ পরিস্থিতি সামলায়। দেড় মাসের মধ্যে কাটমানি ফেরতের মুচলেকা লিখে দিয়ে রেহাই পান ওই পঞ্চায়েত সদস্য।
স্থানীয়দের একাংশের অভিযোগ, জনা ২০ গ্রামবাসীর কাছে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার অনুদান থেকে ৫ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত কেটে নেওয়া হয়েছে। তাই অনেকে বাড়ি তৈরির কাজ শেষ করতে পারেননি। টাকা নেওয়ার কথা অস্বীকার করেননি মিলনবাবুও। তবে, টাকা নেওয়ার জন্য একটা কারণও খাড়া করেছেন। তাঁর দাবি, ‘‘২ থেকে ৫ হাজার টাকা করে নেওয়া হয়েছিল। সেই টাকায় গ্রামে আলো লাগানো, গরিব মানুষের মেয়ের বিয়ে, দুঃস্থ পরিবারের মৃতদেহ সৎকারে সাহায্য করা হয়েছে।’’ তিনি জানান, গ্রামবাসীরা টাকা ফেরতের জন্য চাপ দিচ্ছেন। দেড় মাসের মধ্যে টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার মুচলেকা লিখে দিয়েছেন। তৃণমূলের সাঁইথিয়া ব্লক সভাপতি প্রশান্ত সাধু বলেন, ‘‘ওই ঘটনার দায় দল নেবে না। বৈঠক করে সবাইকে বলে দেওয়া হয়েছে, যাঁরা কাটমানি নিয়েছেন, তার দায় তাঁদের নিজেদের।’’
গণবিক্ষোভ কঙ্কালীতলা পঞ্চায়েতেও। নিজস্ব চিত্র
এ দিন সাঁইথিয়ারই আমোদপুর পঞ্চায়েত অফিসে এসে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে নেওয়া ‘কাটমানি’ ফেরতের দাবিতে প্রাক্তন উপপ্রধানের নেতৃত্বে বিক্ষোভ দেখান স্থানীয় বাসিন্দারা। এ দিন তৃণমূলেরই প্রাক্তন নেতা কৌশিক প্রামাণিকের নেতৃত্বে শ’দুয়েক গ্রামবাসী পঞ্চায়েতে বিক্ষোভ দেখান। বিক্ষোভের কথা মানতে চাননি আমোদপুর পঞ্চায়েতের উপপ্রধান শুভাশিস মুখোপাধ্যায়। তাঁর বক্তব্য, ‘‘ওঁরা তথ্য জানার অধিকার আইনে কিছু তথ্য জানতে চেয়েছেন। আমাদের পক্ষে যে সব তথ্য দেওয়া সম্ভব তা নির্ধারিত সময়ে দেওয়া হবে।’’
স্থানীয় সূত্রে খবর, কৌশিকবাবু তৃণমূলের টিকিটে জিতে ২০০৮-’১৩ সাল পর্যন্ত ওই পঞ্চায়েতেরই উপপ্রধান ছিলেন। লোকসভা ভোটের আগে পর্যন্ত তৃণমূলের সাঁইথিয়া ব্লক কমিটির সদস্যও ছিলেন। তাঁর স্ত্রী মৃন্ময়ী মুখোপাধ্যায় প্রামাণিক বর্তমানে তৃণমূল পরিচালিত সাঁইথিয়া পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ। গত ১ জুন দলের প্রতি বিষোদ্গার করে দিল্লিতে বিজেপিতে যোগ দেন কৌশিকবাবু। তাঁর স্ত্রীকেও সে দিন মুকুল রায়ের পাশে তাঁকেও বসে থাকতে দেখা যায়। কৌশিকবাবুর, ‘‘তথ্য জানার অধিকার আইনে এ দিন ওই সব প্রকল্প সম্পর্কে তথ্য জানতে চেয়েছি। সে সব মিললেই সবার মুখোশ খুলে যাবে।’’ এলাকাবাসীর একাংশের বক্তব্য, এ দিন বিক্ষোভে শামিল কয়েক জন বিজেপি কর্মী-সমর্থক। তবে বিজেপির সাঁইথিয়া মণ্ডল কমিটির সভাপতি রামপ্রসাদ মণ্ডলের বক্তব্য, ‘‘আমোদপুর পঞ্চায়েতে আমাদের দলের কোনও কর্মসূচি ছিল না। কৌশিক প্রামাণিক আমাদের দলের কেউ নন।’’ পঞ্চায়েতের প্রধান কৃষ্ণা ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘পঞ্চায়েতে কাটমানি খাওয়ার সুযোগ নেই। যিনি বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁর বিরুদ্ধেই অনেক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।’’
এ দিন সকালে ‘কাটমানি’র টাকা ফেরতের দাবিতে পাড়ুই থানার নারায়ণপুর গ্রামে তৃণমূলের বুথ সভাপতির বাড়ি ঘেরাও করে বিক্ষোভ দেখান গ্রামবাসী। তাঁদের দাবি, কারা ১০০ দিনের কাজ পাবেন বা কে আবাস যোজনার বাড়ি পাবেন, সব ঠিক হত ওই নেতার কথায়। গ্রামবাসী অজিত দাস, তারাপদ দাসদের অভিযোগ, ‘‘১০০ দিনের কাজ করিয়ে নিয়ে মজুরি দেওয়া হয়নি, আবাস যোজনার বাড়ির জন্যও টাকা নেওয়া হয়েছে। তাই ন্যায্য টাকা ফেরতের দাবিতে আমরা ওই নেতার বাড়িতে এসেছি।’’ বিক্ষোভের সময়ে বাড়িতে ছিলেন না ওই তৃণমূল নেতা। পুলিশি আশ্বাসে বিক্ষোভ ওঠে। ইলামবাজার পঞ্চায়েতের দেবীপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্যা অঞ্জনা বিশ্বাস ও তাঁর এক অনুগামীর বিরুদ্ধে সরকারি প্রকল্পের টাকা আত্মসাতের অভিযোগে এ দিন গ্রামবাসীরা বিক্ষোভ দেখান। অঞ্জনাদেবী বলেন, ‘‘আমার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সমস্ত মিথ্যা।’’ কঙ্কালীতলা পঞ্চায়েতের আদিত্যপুর গ্রামে তৃণমলের পঞ্চায়েত সদস্যা মঞ্জু সাহার বাড়ি ঘেরাও করে হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে কাটমানি ফেরতের দাবিতে বিক্ষোভ দেখান গ্রামবাসীরা। মঞ্জুদেবী বলেন, ‘‘আমার সমস্ত কাজে দেখাশোনা আমার ছেলে করে। আমি কাগজপত্র দেখে শুধু সই করে দিই।’’
সিউড়ি ২ ব্লকের গাংটে ও মালডিহা এবং সিউড়ি ১ ব্লকের চাঙ্গুরিয়া গ্রামেও একই কারণে বিক্ষোভ হয় এ দিন। মালডিহা গ্রামের স্থানীয় তৃণমূল নেতার বাড়ি ঘিরে বিক্ষোভ দেখান স্থানীয় বাসিন্দারা। তাঁদের অভিযোগ, ওই নেতা দীর্ঘদিন ধরে ১০০ দিনের কাজ-সহ বিভিন্ন প্রকল্পে টাকা তছরুপ করেছেন। আবাস যোজনার বাড়ি বানিয়ে দেওয়ার জন্য কাটমানি নিয়েছেন। সেই টাকা এ বার ফেরত দিতে হবে। কোমা পঞ্চায়েতের গাংটে গ্রামে কাটমানি ফেরতের দাবিতে স্থানীয় তৃণমূল নেতা বিপত্তারণ বাগদি এবং কোমা পঞ্চায়েতের প্রাক্তন উপপ্রধানের কাঞ্চন বৈদ্যের বাড়ি ঘিরে বিক্ষোভ দেখান গ্রামবাসীরা। ঘটনায় সাময়িক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি সামলায়। ওই তৃণমূল নেতাকে প্রকল্পের টাকার হিসাব এবং কাটমানি ফেরত দেওয়ার জন্য ৭ দিনের সময়সীমাও বেঁধে দেওয়া হয়। বিপত্তারণবাবু বলেন, ‘‘কাটমানির অভিযোগ ভিত্তিহীন। তবে সরকারি প্রকল্পের টাকার যে হিসেব চেয়েছে, তা আমি আগামী বুধবারের মধ্যে ওদের দিয়ে দেব।’’ তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের দাবি, ‘‘এটা সংবাদমাধ্যম এবং বিজেপির সৃষ্টি। যেটুকু জেনেছি, ওটা জব কার্ড রাখা নিয়ে গণ্ডগোল।’’