ব্রিগেডে বলছেন এসইউসি সাধারণ সম্পাদক প্রভাস ঘোষ। —সংগৃহীত।
শুক্রবার রাতে দক্ষিণ কলকাতার গীতাঞ্জলি স্টেডিয়ামে ভিড় জমিয়েছিলেন শনিবার এসইউসি-র ব্রিগেড সমাবেশে আগত সদস্য ও সমর্থকেরা। তাঁদের খাওয়ার জন্য রাতেই দেড় হাজার সেদ্ধ ডিম পৌঁছেছিল স্টেডিয়ামে। কে বা কারা পাঠালেন? রাজনীতিশ্রুতি: তৃণমূল নেতৃত্ব।
দীর্ঘ ৩৫ বছর পর শনিবার ব্রিগেডে সমাবেশ করল এসইউসি। সেই সমাবেশের প্রাক্ দুপুর থেকে দূরবর্তী জেলা ও ভিন্রাজ্যের এসইউসি কর্মী-সমর্থকদের রাত্রিবাসের জন্য একাধিক সরকারি জায়গা খুলে দেওয়া হয়েছিল। সল্টলেক স্টেডিয়াম, কসবার গীতাঞ্জলি স্টেডিয়াম, নেতাজি ইনডোর, আলিপুরের মুক্তমঞ্চ ‘উত্তীর্ণ’-য় ছিলেন তাঁরা। কাদের ‘সহায়তা’য়? রাজনীতিশ্রুতি: তৃণমূল নেতৃত্ব। বামপন্থী দল এসইউসি ব্রিগেডে সমাবেশ ঘোষণার পর থেকেই শাসক তৃণমূল সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তাদের ‘সহায়তা’ করার। কারণ, শাসকদল না চাইলে সমর্থকদের জমায়েত এনে রাখার জন্য পরিকিঠামোগত সহায়তা পেত না ‘বিরোধী’ এসইউসি।
প্রকাশ্যে অবশ্য তৃণমূলের কোনও নেতাই বিষয়টি স্বীকার করছেন না। তাঁদের বক্তব্য, যে কোনও বিরোধী দলই ব্রিগেডে সমাবেশ করলে এই ধরনের ‘সরকারি সহায়তা’ পাবে। বিজেপি পাবে? সিপিএম পাবে? মুখে তাঁরা বলছেন বটে যে, পাবে। কিন্তু গলার স্বরে স্পষ্ট, এটা নেহাতই কথার কথা। ঔপচারিকতা। বস্তুত, শনিবার তৃণমূলের একাধিক প্রথম সারির নেতা ঘরোয়া আলোচনায় জানিয়েছেন, ব্রিগেড সমাবেশের জন্য এসইউসি-কে ‘ঢালাও সহযোগিতা’ করা হয়েছে। সে সরকারি অনুমোদনে থাকার জায়গার বন্দোবস্ত করাই হোক বা রাতে জরুরি ভিত্তিতে খাবার পাঠানো।
শনিবার এসইউসি-র ব্রিগেড সমাবেশে লোক মন্দ হয়নি। ভিন্রাজ্য থেকে দু’টি ট্রেন ভাড়া করে সমর্থকদের আনা হয়েছিল ব্রিগেডে। এ ছাড়াও রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাসে করেও সমর্থকেরা এসেছিলেন সমাবেশে। দলের প্রতিষ্ঠাতা শিবদাস ঘোষের জন্মশতবর্ষের সমাপ্তি অনুষ্ঠান হিসেবেই ব্রিগেড সমাবেশের ডাক দিয়েছিল এসইউসি।
প্রশ্ন হল, সেই সমাবেশ ‘সফল’ করতে কেন এসইউসি-র মতো কলেবরে ছোট একটি বামপন্থী দলকে এ ভাবে ‘উপুড়হস্তে’ সহযোগিতা করল তৃণমূল তথা রাজ্য সরকার? শাসকদলের নেতাদের কাছে এর বিবিধ ব্যাখ্যা পাওয়া গিয়েছে। প্রথমত, তাঁরা জানিয়েছেন, এসইউসি তাঁদের পুরনো ‘জোটসঙ্গী’। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বে আন্দোলনের সলতে পাকানোর কাজ করেছিল তারা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছিল। এমনকি, ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটে কংগ্রেস এবং তৃণমূলের জোটের শরিক ছিল এই বামদল। সে বার জয়নগর লোকসভা আসন থেকে এসইউসি-র চিকিৎসক নেতা তরুণ মণ্ডল সাংসদও হয়েছিলেন। যদিও অনেকে বলেন, তৃণমূলের সঙ্গে জোট গঠন এসইউসি-র ‘কৌশলগত ভুল’ হয়েছিল। কারণ, তার পরে জয়নগরও তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়।
দ্বিতীয়ত, তৃণমূলের অনেক নেতার মতে, এসইউসি বামপন্থী দল হলেও ‘সিপিএম’ নয়। বরং তারা বরাবর সিপিএমের জনবিরোধী নীতি এবং সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। প্রাথমিক থেকে ইংরেজি তুলে দেওয়া, বাসভাড়া বৃদ্ধি, এবং শিক্ষায় দুর্নীতি নিয়ে এসইউসি রাস্তায় নেমে ধারাবাহিক রাজনৈতিক আন্দোলন করেছে। তৃণমূলের এক নেতার কথায়, ‘‘এসইউসি বরাবর আন্দোলনের ময়দানে থেকেছে। কখনও সেই রাস্তা থেকে সরে যায়নি। নিজেদের সীমিত অস্তিত্ব নিয়েও লড়াই চালিয়ে গিয়েছে।’’
তৃতীয়ত, তৃণমূলের নেতাদের একাংশের বক্তব্য, এসইউসি-র বিরুদ্ধে কখনও সন্ত্রাসের কোনও অভিযোগ ওঠেনি। দলের এক গুরুত্বপূর্ণ নেতার কথায়, ‘‘ওর চিরকাল গণতান্ত্রিক পথে আন্দোলন করেছে। কখনও গুলি-বন্দুক নিয়ে সন্ত্রাসের রাস্তায় যায়নি।’’
কারণ যা-ই থাকুক, এসইউসি-কে ‘প্রত্যক্ষ সহায়তা’র পিছনে তাদের ‘বামপন্থী’ দল হিসেবে সিপিএমের থেকে আলাদা করার প্রয়াসও ছিল শাসকদলের। পাশাপাশিই, এসইউসি-কে ‘অক্সিজেন’ দিয়ে বিজেপিকে প্রতিহত করারও হিসাব কষেছে তৃণমূল। শাসকদলের এক নেতার কথায়, রামের ভোট বামে ফেরানো একটা বড় চ্যালেঞ্জ। তার কিছু অংশ যদি এসইউসি-র দিকেও যায়, তাতে ক্ষতি কোথায়? ওই নেতার আরও বক্তব্য, জয়নগর ও মথুরাপুর লোকসভা কেন্দ্রে প্রচুর সংখ্যক তফসিলি ভোটার রয়েছেন। সেখানে সাংগঠনিক শক্তি বাড়ানোর চেষ্টা করছে গেরুয়া শিবির। আবার ওই সমস্ত এলাকায় এসইউসি ‘ঐতিহ্যগত’ ভাবেই শক্তিশালী। লোকসভা ভোটের আগে সেই অঙ্কও তৃণমূলের ভাবনায় রয়েছে।
তৃণমূলের সহায়তার ‘প্রতিদান’ দিতেই কি শনিবারের সমাবেশে সিপিএম, সিপিআই, আরএসপি, ফরওয়ার্ড ব্লকের মতো বাম দলগুলিকে তীব্র আক্রমণ শানিয়েছেন এসইউসি-র সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক প্রভাস ঘোষ? অনেকে তেমনই মনে করছেন। কারণ, প্রভাস আক্রমণ করেছেন ভাঙড়ের আইএসএফ বিধায়ক এবং ফুরফুর শরিফের পিরজাদা নওশাদ সিদ্দিকিকেও। ব্রিগেড সমাবেশের মঞ্চ থেকে এইইউসি-র এই প্রবীণ নেতা বলেন, ‘‘পঞ্চাশের দশকে অভিভক্ত সিপিআই, আরএসপি, ফরওয়ার্ড ব্লক আমাদের বিদ্রুপ করে বলত, চামচিকে পাখি হলে এসইউসিও পার্টি! এখন সেই পার্টিগুলির কী অবস্থা?’’ তাঁর কথায়, ‘‘এসইউসি কোনও দিন কোনও অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেনি।’’
সেই সঙ্গে কংগ্রেস এবং আইএসএফের সঙ্গে বামফ্রন্টের মোর্চা গঠনের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন প্রভাস। নাম না করে ফুরফুরা শরিফের পিরজাদা আব্বাস সিদ্দিকি ও নওশাদের সঙ্গে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের ‘সখ্য’ নিয়েও সমালোচনা করে বলেন, ‘‘এখন তারা (সিপিএম) কংগ্রেসের হাত ধরেছে! একটা পিরকে ধর্মনিরপেক্ষ সাজিয়ে তার হাত ধরেছে!’’
প্রত্যাশিত ভাবেই প্রভাসের ওই বক্তব্য তৃণমূল নেতৃত্বকে ‘সন্তুষ্ট’ করেছে। কারণ, তিনি সিপিএম-কংগ্রেস এবং নওশাদের আইএফএস— সকলকেই রাজনৈতিক আক্রমণ করেছেন। অর্থাৎ, তৃণমূলের কোনও ‘রাজনৈতিক শত্রু’-কেই রেয়াত করেননি।
তৃণমূলের বিরুদ্ধেও মুখ খুলেছেন প্রভাস। তবে তা তুলনায় যথেষ্ট ‘নরম’। তাঁর কথায়, ‘‘কংগ্রেসকে ধর্মনিরপেক্ষ বানাচ্ছে সিপিএম। কংগ্রেস কি গণতান্ত্রিক? সেখানে গিয়ে তৃণমূলও শামিল হয়েছে। তৃণমূল বলেছিল, বদল করবে। আর পরিবর্তনের নামে সিন্ডিকেট, প্রমোটার রাজ চলছে। বেলাগাম দুর্নীতি। ভোটের নামে রক্তগঙ্গা বয়ে গেল।’’ পাশাপাশিই, প্রভাস অভিযোগ করেছেন, তৃণমূলের সরকারও গণ আন্দোলনকে ‘দমন’ করছে।
প্রসঙ্গত, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বে তৃণমূল তথা মমতার পাশে যে দলগুলি ছিল, তারা প্রায় কেউই এখন নেই৷ সেই সব ছোট ছোট দলের বিরাট কোনও রাজনৈতিক শক্তি বা উপস্থিতি না থাকলেও তখন তারা শাসক বামফ্রন্টের বিরোধী রাজনৈতিক ধারণা নির্মাণে অনুঘটকের ভূমিকা নিয়েছিল। জনতার মধ্যে এই ধারণা তৈরি হয়েছিল যে, বামেদের বিরুদ্ধে মমতার পাশে এতগুলি দল রয়েছে। এসইউসির বক্তব্য, সেই সময়ে তারা তৃণমূলকে শর্ত দিয়েছিল, মার্ক্সবাদ ও বামপন্থাকে আক্রমণ করা যাবে না। তৃণমূল তা মেনে নিয়েছিল বলেও মনে করেন দলের নেতারা। যদিও ২০১১ সালে ‘পরিবর্তনের সরকার’ ক্ষমতায় আসার পর কংগ্রেস-তৃণমূলের জোট সরকারে অংশ নেয়নি এসইউসি। সেটি তাদের ঘোষিত অবস্থান ছিল। তৃণমূল জমানাতেও শিক্ষায় দুর্নীতি, নিচু ক্লাসে পাশ-ফেল প্রথা তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধেও আন্দোলনে নেমেছে এসইউসি। কিন্তু লোকসভা ভোটের আগে তৃণমূলের কাছে বিজেপি বড় বালাই।