দিনভর অপেক্ষা করেও তৃণমূলের আয়-ব্যয়ের হিসেব সংক্রান্ত কোনও নথি হাতে পেল না সিবিআই। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার তরফে রাজ্যের শাসক দলকে নোটিস পাঠিয়ে মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টার মধ্যে আয়-ব্যয় সংক্রান্ত তথ্য জমা দিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু এ দিন তৃণমূলের কোনও প্রতিনিধি সল্টলেকে সিবিআই দফতরে যাননি। এই পরিস্থিতিতে সরাসরি তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেত্রীকে তলব করে তাঁর কাছ থেকেই তথ্য আদায়ের দাবি তুলে চাপ বাড়িয়েছে বিরোধী সিপিএম ও বিজেপি।
আয়-ব্যয়ের তথ্য চেয়ে সিবিআইয়ের আদতে নোটিস পাঠানো হয় তৃণমূলের তৎকালীন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়কে। কিন্তু মুকুলবাবু জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি এখন আর ওই পদে নেই। তাই তথ্য দেওয়ার এক্তিয়ারও তাঁর নেই। দলের বর্তমান নেতৃত্বের তরফে কেউ তাদের সঙ্গে মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত যোগাযোগ করেননি বলেই সিবিআই সূত্রের খবর। তদন্তকারীরা আরও কিছু সময় অপেক্ষা করে নতুন করে নোটিস পাঠানো বা অন্য পদক্ষেপের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।
তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় এ দিন তারাপীঠে একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে এই বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, “সিবিআই কেন, হাজার হাজার লোক তৃণমূল ভবনে চিঠি দেন। আমরা তার উত্তর দিই। দলের প্রশ্নের জবাব দলই দেবে।” তবে পার্থবাবুর আরও বক্তব্য, “তৃণমূল ভবনে আমাদের কর্মকর্তারা এ রকম কিছু পাননি। তবে শুনলাম, আমাদের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক এই চিঠি পেয়ে একটা উত্তর দিয়েছেন। সেটা তো আমাদের জানার কথা নয়। তবুও সব কিছু খবর নেব। তার পরে উত্তর দেব। ঢাক ঢাক গুড় গুড়ের কিছু নেই!” তাঁদের দল অত্যন্ত স্বচ্ছ বলেও দাবি করেছেন পার্থবাবু।
তপসিয়ার তৃণমূল ভবন চত্বরে এ দিন অবশ্য বাইপাস থেকে ঢোকার রাস্তার মুখেই বসানো ছিল গার্ডরেল। দফতরে আসা দলীয় কর্মীদেরও পরিচয় যাচাই করে গার্ডরেল পেরোতে দেওয়া হয়েছে! পূর্তমন্ত্রী শঙ্কর চক্রবর্তী, দলীয় নেতা ইন্দ্রনীল সেন প্রমুখকেও বাইরে গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে ভবনে ঢুকতে হয়েছে। সিবিআইয়ের প্রতিনিধিদের জন্যই এমন আঁটোসাঁটো ভাব কি না, জল্পনা ছিল দিনভর।
দিল্লিতে দলের রাজ্যসভার নেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন অবশ্য পার্থবাবুর সুরেই বলেছেন, “বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনও কারণ নেই! কোনও রাজনৈতিক দলের তহবিল নিয়ে আয়কর দফতরের নির্দিষ্ট আইনকানুন রয়েছে। আয়কর দফতর এটাই দেখে যে, কত টাকা চাঁদা তোলা হয়েছে এবং কারা সেই টাকা দিয়েছেন। এবং এই পুরো খতিয়ান আয়কর রিটার্নে দাখিল করা হয়েছে কি না। তৃণমূলের ক্ষেত্রে এই নিয়ে কোনও অস্বচ্ছতা নেই।” ডেরেক জানিয়েছেন, তৃণমূলে সব চাঁদাই চেকে নেওয়া হয়েছে। তার রিটার্ন দাখিল হয়েছে। গত চার বছরে নির্বাচনের তহবিলের হিসেব নির্বাচন কমিশনের কাছে দেওয়া রয়েছে।
বিরোধীরা অবশ্য তৃণমূলের ‘স্বচ্ছতা’র দাবি মানতে নারাজ। দলের রাজ্য সম্মেলনের অবসরে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মহম্মদ সেলিম বরং অভিযোগ করেছেন, তহবিল নিয়ে সিবিআইয়ের নোটিস পাওয়ার পরেই তড়িঘড়ি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দ্বারস্থ হয়েছিলেন। রাজ্য সম্মেলনে এ দিন অর্থ লগ্নি সংস্থার দুর্নীতি নিয়ে একটি প্রস্তাব নেওয়া হয়েছে। যেখানে সিপিএম বলেছে, ‘তৃণমূল এবং স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কে অকাট্য তথ্য জনসমক্ষে হাজির হয়েছে’! যারা এই কেলেঙ্কারি থেকে লাভবান হয়েছে, তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে তা নিলামে বিক্রি করে আমানতকারীদের টাকা ফেরতের দাবিও তোলা হয়েছে।
সেলিম বলেন, “সিবিআইয়ের নোটিসের ব্যাপারে এ দিনই তৃণমূল নেতৃত্বের জবাব দেওয়া উচিত ছিল। কারণ, তৃণমূল নেত্রীই এই দলের প্রধান। অর্থাৎ সিবিআই মুখ্যমন্ত্রীর দরজায় কড়া নাড়ছে।” রাজ্যের আর্থিক দাবি-দাওয়া নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক থাকলে কেন সরকারি অফিসারদের নিয়ে যাওয়া হল না, সেই প্রশ্ন তুলে সেলিমের মন্তব্য, “এখন বিজেপিরও তৃণমূলকে দরকার। কারণ, রাজ্যসভায় তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই!” সারদা নিয়ে এ দিনই কলকাতায় মিছিল করে ফের পথে নামা শুরু করেছে সিপিএম।
বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ অবশ্য এ দিন সেলিমের সুরেই দাবি করেছেন, “মুকুল রায় বলবেন, তিনি এখন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক নেই। আবার সুব্রত বক্সী বলবেন, তিনি সবেমাত্র সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন। অতএব, তিনিও ওই চিঠির জবাব দেবেন না! সুতরাং, তৃণমূল নেত্রীর উপরেই ওই চিঠির জবাব দেওয়ার দায় বর্তাচ্ছে! তৃণমূলের চেয়ারপার্সনকেই এই রহস্য উন্মোচন করতে হবে!” তৃণমূলের তহবিলে ‘ত্রিনেত্র’ নামক সংস্থার অনুদানের প্রসঙ্গেও সরব হয়েছেন রাহুল-সেলিম। রাহুলবাবুর প্রশ্ন, “ওই সংস্থার অধিকর্তা মনোজ শর্মা বেপাত্তা। সন্দেহ জাগছে, সত্য ধামাচাপা দেওয়ার জন্য, মনোজকে খুন করা হয়নি তো?”