CPM-BJP alliance

ত্রিশঙ্কু পঞ্চায়েত দখলের পথে কাঁটা ‘রাম-বাম’ জোট! নদিয়ায় ‘অশুভ আঁতাঁত’ নিয়ে সরব তৃণমূল

জাতীয় স্তরে বিরোধী দলগুলি যখন বিজেপির বিরুদ্ধে এককাট্টা হয়ে ‘ইন্ডিয়া’ নামে জোট গড়েছে, নদিয়ায় ঠিক তার বিপরীত অবস্থা নিয়ে সরব হয়েছে শাসক তৃণমূল।

Advertisement

প্রণয় ঘোষ

কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ০৭ অগস্ট ২০২৩ ২০:৩৯
Share:

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

জেলার বেশ কয়েকটি পঞ্চায়েত আটকে গিয়েছে ত্রিশঙ্কু জটে। অবস্থা এমন হয়েছে যে, তৃণমূল বা বিজেপি— জয়ী বাম সদস্যেরা যাদের সমর্থন দেবেন, সেই দলেরই দখলে যাবে পঞ্চায়েত। এই পরিস্থিতিতে বাম-বিজেপি বোঝাপড়া প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে নদিয়ায়। গত মাসে পঞ্চায়েত ভোটের পরেই নদিয়ার পলাশিপাড়া থানার তেহট্ট-২ ব্লকের সাহেবনগরে তৃণমূলমুক্ত পঞ্চায়েত গড়ার জন্য হাতে হাত রেখে শপথ নিতে দেখা গিয়েছিল সিপিএম, বিজেপি ও কংগ্রেসের বিজয়ীদের। পঞ্চায়েত বোর্ড গঠনের প্রাক্কালে সেই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে বাকি ত্রিশঙ্কু পঞ্চায়েতগুলিতেও। জাতীয় স্তরে বিরোধী দলগুলি যখন বিজেপির বিরুদ্ধে এককাট্টা হয়ে ‘ইন্ডিয়া’ নামে জোট গড়েছে, নদিয়ায় ঠিক তার বিপরীত অবস্থা নিয়ে সরব হয়েছে শাসক তৃণমূল। বিরোধীদের এই জোটকে ‘অশুভ আঁতাঁত’ বলে কটাক্ষ করতে শুরু করেছে তারা।

Advertisement

নদিয়ায় মোট ১৮৫টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে সরকারি হিসাবে ১১টি গ্রাম পঞ্চায়েতে ত্রিশঙ্কু অবস্থা। বিরোধীদের অবশ্য দাবি, সংখ্যাটা ২১ ছাড়িয়ে গিয়েছে। আগামী ১০ অগস্টের মধ্যেই জেলার সব পঞ্চায়েতে বোর্ড গঠনের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। সেই প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যে। তার মধ্যেই দেখা যাচ্ছে, বেশির ভাগ ত্রিশঙ্কু পঞ্চায়েতে শাসকদলকে আটকাতে কাছাকাছি আসতে শুরু করেছে বাম-বিজেপি। আপাতত যা পরিস্থিতি, তাতে নাকাশিপাড়া ব্লকের বীরপুর-১ ও মাঝের গ্রাম, ধর্মদা, নবদ্বীপ ব্লকের স্বরূপগঞ্জ, কৃষ্ণনগর-২ ব্লকের সাধন পাড়া-১, তেহট্ট-১ ব্লকের দু’টি গ্রাম পঞ্চায়েতে তৃণমূলকে আটকাতে বাম, বিজেপি ও নির্দলের জোট প্রায় নিশ্চিত। চাপড়া ব্লকের কলিঙ্গ গ্রাম পঞ্চায়েতে তৃণমূল বা বিজেপি— বামেরা যে দিকে ঝুঁকবে, সেই দলই গড়বে বোর্ড। পিঁপড়েগাছি গ্রাম পঞ্চায়েতেও একই অবস্থা। নিচুতলায় খোঁজ নিয়ে দেখা গিয়েছে, ওই দুই পঞ্চায়েতেও বিজেপির সঙ্গে সমঝোতার পথেই হাঁটছে বামেরা। পিঁপড়েগাছি গ্রাম পঞ্চায়েতের এক সিপিএম নেতার কথায়, ‘‘তৃণমূল যাতে ভয় দেখিয়ে পঞ্চায়েত দখল করতে না পারে, সে জন্যই আমরা একজোট হতে বাধ্য হচ্ছি।’’

পঞ্চায়েত ভোটের আগে রাজ্যের বেশ কিছু জায়গায় হওয়া সমবায় নির্বাচনেও বাম-বিজেপি সমঝোতা প্রকাশ্যে এসেছিল। বিশেষত, বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর জেলা পূর্ব মেদিনীপুরের বেশ কিছু সমবায়ে বিজেপি ও বামেরা নিজেদের মধ্যে আসন সমঝোতা করেছে। নন্দকুমারের সমবায়ে সেই জোট শাসকদলকে ধরাশায়ী করায় তা নিয়ে বিস্তর আলোচনাও শুরু হয়েছিল রাজ্য-রাজনীতিতে। যা কালক্রমে ‘নন্দকুমার মডেল’ হিসাবে পরিচিতি পায়। রাম-বাম জোটের ‘তত্ত্ব’ প্রচারের আলোয় চলে আসায় তার আঁচ এসে পড়ে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটেও। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে অভ্যন্তরীণ কমিশন গড়ার সিদ্ধান্ত নেন সিপিএম নেতৃত্ব। নিচুতলাকে সাফ বার্তা দেওয়া হয়, নন্দকুমার মডেলের পুনরাবৃত্তি যেন না হয়! দলীয় ‘লাইন’ না মানলে নিচুতলার সংশ্লিষ্ট নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করা হবে বলেও জারি করা হয় ‘লাল সতর্কতা’।

Advertisement

যদিও ভোট-বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, সমবায় নির্বাচনের মতো পঞ্চায়েত নির্বাচনেরও বাস্তবতা হল, এই ধরনের ভোটে স্থানীয় ভিত্তিতে কার সঙ্গে কার জোট হবে, তার উপরে রাজনৈতিক দলগুলির শীর্ষ স্তরের নিয়ন্ত্রণ খুব একটা থাকে না। উঁচুতলা দলীয় নীতিতে অনড় থাকলেও নিচুতলা বাস্তবতা দেখে। স্থানীয় বিষয়গুলিই বেশি প্রাধান্য পায় সেখানে। তার ভিত্তিতেই তৃণমূল স্তরে সমীকরণ তৈরি হয়। বস্তুত, বোর্ড গঠনের মুখে তা-ই ঘটছে নদিয়ায়। শুধু গ্রাম পঞ্চায়েতই নয়, তেহট্ট-১ ও কৃষ্ণনগর-১ ব্লকের পঞ্চায়েত সমিতিতেও বোর্ড গড়তে বামেদের সাহায্য দরকার বিজেপির। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, তৃণমূলকে আটকাতে দু’টি পঞ্চায়েত সমিতিতেই বিজেপিকে নিঃশর্ত সমর্থন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বামেরা। সিপিএমের ব্লক স্তরের এক নেতা বলেন, ‘‘এখনও দলের বহু কর্মী শীর্ষ নেতৃত্বের উপর ভরসা করতে পারছেন না। সেই ভরসা জোগাতে ব্যর্থ হচ্ছেন নেতৃত্ব। স্থানীয় নেতৃত্ব সেই কারণে শাসকদলকে ঠেকাতে নিচু স্তরে সঙ্গ খুঁজছেন।’’ শীর্ষ নেতৃত্বের নজর এড়িয়ে যে ভাবে তলে তলে বিজেপির সঙ্গে সমীকরণ তৈরি হয়েছে, তাতে বেজায় অস্বস্তিতে পড়ার কথা সিপিএমের জেলা নেতৃত্বের। যদিও বিজেপিকে সমর্থন দেওয়ার দাবি অস্বীকার করে সিপিএমের নদিয়া জেলা সম্পাদক সুমিত দে বলেন, ‘‘ত্রিশঙ্কু পঞ্চায়েতে বিজেপি বা তৃণমূল— কোনও দলকেই আমরা সমর্থন করব না। প্রয়োজনে বিরোধী আসনে থেকে জনবিরোধী নীতির গঠনমূলক বিরোধিতা করব।’’

বাম আমলের শেষ দিকে তৎকালীন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি পঞ্চায়েত ভোটে ‘মানুষের জোট’ গড়ার ডাক দিয়েছিলেন। সেই পথে হেঁটে রাজ্য বিজেপির শীর্ষ নেতারাও এখন তৃণমূলের বিরুদ্ধে লাগাতার এক ছাতার তলায় এসে লড়াইয়ের বার্তা দিচ্ছেন। সম্প্রতি শুভেন্দু এবং বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার সিপিএমের নিচুতলার কর্মী-সমর্থকদের বিজেপির ঝান্ডার নীচে এসে তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে জোট গড়ার ডাক দিয়েছেন। কৃষ্ণনগর-১ ব্লকের এক বিজেপি নেতা বলেন, ‘‘বামেদের মতো আমাদের সেই অর্থে কোনও ঘোষিত নীতি নেই। ছুঁৎমার্গও নেই। তৃণমূলের শাসনকালে গ্রাম বাংলার বহু মানুষ অত্যাচারিত, লাঞ্ছিত। তাঁরা যদি আমাদের ঝান্ডার তলায় আসতে চান বা নিচু স্তরে হাত ধরাধরি করে চলতে চান, তা হলে আমাদেরও আপত্তি থাকার কথা নয়। এতে দু’পক্ষের শক্তিবৃদ্ধিও হয়। আর লক্ষ্য তো একটাই, শাসকদলকে ক্ষমতাচ্যুত করা।’’

জেলার রাজনৈতিক বৃত্তে যাঁরা ঘোরাফেরা করেন, তাঁদের একাংশের মত, জোট নিয়ে নিচুতলার বিজেপি নেতৃত্বের এমন ‘নমনীয়’ মনোভাবই সম্ভবত স্থানীয় বাম নেতৃত্বকে উৎসাহিত করছে। সিপিএম এক পা এগোলে বিজেপি দু’পা এগোতে রাজি থাকছে। যদিও প্রকাশ্যে বাম-বিজেপি সমঝোতার কথা স্বীকার করতে নারাজ বিজেপি। জাতীয় স্তরে বিরোধী জোটের প্রসঙ্গ টেনে রানাঘাটের বিজেপি সংসদ জগন্নাথ সরকার বলেন, ‘‘আমরা বামেদের সঙ্গে কী ভাবে জোটে যাব! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো আগেই জাতীয় স্তরে বামেদের সঙ্গে জোট করে বসে আছেন।’’ নিচু স্তরের এই সমঝোতাকে ‘মানুষের জোট’ বলেই তুলে ধরতে চাইছে বিজেপি। জগন্নাথের কথায়, ‘‘নিচু স্তরে সাধারণ মানুষ জোট তৈরি করে। তৃণমূলের অত্যাচারে আতঙ্কিত মানুষেরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটা মঞ্চ তৈরি করেছে। এখানে প্রতীক খুব একটা বড় ইস্যু নয়।’’

শাসকদলের অবশ্য দাবি, সাধারণ মানুষ বিরোধীদের এই ‘অশুভ আঁতাঁত’কে প্রত্যাখ্যানই করবেন। তৃণমূলের কৃষ্ণনগর সাংগঠনিক জেলা চেয়ারম্যান নাসিরুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘জগাই-মাধাই-গদাই পঞ্চায়েত ভোটে জোট করেই লড়েছে। বাম বিজেপির অশুভ আঁতাত মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং ভবিষ্যতেও করবেন। সে সব উপেক্ষা করেই এরা নির্লজ্জের মতো ক্ষমতা দখল করতে চাইছে। সংখ্যালঘু মানুষদের সঙ্গে কার্যত প্রতারণা করছে বামেরা।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement