ক্ষোভ ছড়াল ইন্দিরা আবাসেও

বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নির্মাণের ছবির সঙ্গে উপভোক্তার ছবি। কিন্তু, ছবি থেকেই স্পষ্ট, একই নির্মাণের ছবি ব্যবহার করা হয়েছে একাধিক উপভোক্তার নামে! অর্থাৎ, পিছনে বাড়িটি থাকছে এক। শুধু বদলে যাচ্ছে উপভোক্তার ছবি।

Advertisement

অর্ঘ্য ঘোষ

ময়ূরেশ্বর শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০১৬ ০৮:৫৭
Share:

উপভোক্তাদের তালিকায় দেওয়া এমন সব ছবি দেখিয়েই ফোটোশপের অভিযোগ তুলেছে বিজেপি।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নির্মাণের ছবির সঙ্গে উপভোক্তার ছবি। কিন্তু, ছবি থেকেই স্পষ্ট, একই নির্মাণের ছবি ব্যবহার করা হয়েছে একাধিক উপভোক্তার নামে! অর্থাৎ, পিছনে বাড়িটি থাকছে এক। শুধু বদলে যাচ্ছে উপভোক্তার ছবি। এমনকী, নির্মাণের বিভিন্ন পর্যায়ের অগ্রগতির ছবিতে ব্যবহৃত হয়েছে একই ছবি। অথচ যাঁর নামে বাড়ি তৈরির জন্য এতগুলো টাকা খরচ করল সরকার, সেই তিনি-ই জানতে পারলেন না সে কথা!

Advertisement

এমনই অভিনব পদ্ধতিতে কেন্দ্রীয় সরকারের ইন্দিরা আবাস যোজনায় লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠল ময়ূরেশ্বর ২ ব্লকের ষাটপলশা পঞ্চায়েতে। শুক্রবারই এলাকায় গিয়ে এই অভিযোগে সরব হয়েছেন বিজেপি নেত্রী লকেট চট্টোপাধ্যায়। তাঁর দাবি, বেশির ভাগ ছবিতেই ফোটোশপ-এর সাহায্যে ‘কারসাজি’ করে একই বাড়ির সামনে আলাদা আলাদা উপভোক্তার ছবি আপলোড করা হয়েছে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের ওয়েবসাইটে। লকেট বলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় সরকার উন্নয়নের জন্য টাকা দিচ্ছে। সেই উন্নয়নের নামে তৃণমূল জালিয়াতি করছে। আমরা কম্পিউটারে ফোটোশপ রাখি ভাল কিছু করার জন্য। সেখানে ফোটোশপ করা ছবি দিয়ে সরকারের লক্ষ লক্ষ টাকা তুলে নেওয়া হচ্ছে। গরিব মানুষকে বোকা বানিয়ে তৃণমূল টাকা লুঠ করছে!’’ যদিও ঘটনার সঙ্গে দলের কেউ যুক্ত নন বলেই দাবি করেছেন তৃণমূল নেতৃত্ব।

লিখিত অভিযোগ পেলে বিষয়টি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন বীরভূমের জেলাশাসক পি মোহন গাঁধী। আজ, শনিবারই ‘বঞ্চিত’ উপভোক্তাদের একাংশ এবং বিজেপি নেতৃত্বের তরফে প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ হবে বলে সূত্রের খবর। বিডিও (ময়ূরেশ্বর ২) সৈয়দ মাসুদুর রহমান কিন্তু বলেছেন, ‘‘সংবাদমাধ্যমে বিষয়টি জানার পরেই ওই পঞ্চায়েত এলাকায় উপভোক্তাদের দ্বিতীয় দফার টাকা আটকে দেওয়া হয়েছে।’’

Advertisement

প্রশাসন সূত্রের খবর, ২০১৫-১৬ আর্থিক বছরে ওই পঞ্চায়েত এলাকায় ইন্দিরা আবাস যোজনায় প্রথম দফায় ১৫৪ জনের নামে টাকা বরাদ্দ হয়। পঞ্চায়েতের পরিদর্শনের পরে উপভোক্তা-সহ নির্মীয়মাণ বাড়ির ছবি জমার পরে দ্বিতীয় দফায় ৫৫ জনের নামে টাকা বরাদ্দ হয়। তৃতীয় দফায় মাত্র এক জনের নামেই বরাদ্দ হয়েছে অনুদান। কাজ শেষ হওয়ার পরে পরিদর্শন হওয়া যে ৫৪টি বাড়ির ছবি সরকারি ওয়েবসাইটে আপলোড করা হয়েছে, তার বেশির ভাগই ফোটোশপ করা বলে দাবি লকেটের। যেমন, তালিকায় ৫৩ নম্বরে থাকা বিল্টু ভল্লা। দেখা যাচ্ছে, প্রথম দফার কাজের পরে বিল্টুর যে ছবি তালিকায় রয়েছে, দু’বছর পরে নির্মাণ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও হুবহু এক ছবি। পরনের লুঙ্গি, জামা ও মুখভঙ্গি এতটুকুও বদলায়নি। এমনকী, পিছনে থাকা নির্মাণের ছবিটিও এক। ২৭ নম্বরে থাকা মিনতি হেমব্রমের ক্ষেত্রে আগে-পরে দেওয়া দু’টি ছবিই আবার এক বৃদ্ধের। এ দিকে, ২৬ নম্বরে থাকা চাঁদ ভল্লার দু’টি ছবিতেই এক লুঙ্গি-জামা, লাঠি ধরে ঝুঁকে থাকার ভঙ্গীও এক। প্রথম দফার টাকা পেয়ে নির্মাণের যে তালিকা তৈরি হয়েছে, তাতে আবার দেখা যাচ্ছে ৫৭, ৫৮ ও ৫৯ নম্বরে একই নির্মীয়মাণ বাড়ির ছবি আপলোড হয়েছে! শুধু সামনে উপভোক্তার ছবিগুলি আলাদা।

ঘটনা হল, ২০০৫ সালে আর্থিক স্থিতির উপরে যে সমীক্ষা হয়েছিল, তার ভিত্তিতে দেশে বিপিএল তালিকাভুক্ত গৃহহীন পরিবারের তালিকা তৈরি হয়েছিল। সেখান থেকে প্রতি বছর চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করে জেলা। সেই তালিকা অনুযায়ী উপভোক্তা পিছু বরাদ্দের ৭০ হাজার টাকা আসে ব্লকে। ৩৫, ২৮ ও ৭ হাজার করে তিন দফায় ওই টাকা দেওয়া হয়। প্রথম দফার টাকা সরাসরি উপভোক্তার অ্যাকাউন্টে যায়। ওই টাকা যথাযথ খরচের পরে নির্মাণের পরিদর্শন করেন সংশ্লিষ্ট পঞ্চায়েতের অস্থায়ী কর্মী ‘কমিউনিটি সার্ভিস প্রোভাইডার’রা। তাঁরা নির্মীয়মাণ বাড়ি-সহ উপভোক্তার ছবি এবং শংসাপত্র দেওয়ার পরেই দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফার টাকা মঞ্জুর করে ব্লক প্রশাসন।

কী ভাবে জালিয়াতি?

তালিকায় থাকা উপভোক্তার নাম ব্যবহার করেই যাবতীয় দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ। লকেটের দাবি, স্থানীয় কিছু তৃণমূল নেতা, পঞ্চায়েত ও ব্লক প্রশাসনের কর্মী থেকে ব্যাঙ্কের কর্মীদের একাংশ যুক্ত না থাকলে এই দুর্নীতি করা সম্ভব নয়। স্থানীয় অনেক বাসিন্দাও জানিয়েছেন, চক্রটি প্রথমেই ভুল বুঝিয়ে বা অল্প টাকাপয়সা দিয়ে উপভোক্তার পাসবই নিজেদের হেফাজতে নিয়ে নেয়। পাসবই হাতে থাকায় ব্যাঙ্ক কর্মীদের একাংশের সাহায্যে সহজেই প্রথম দফার মোটা টাকাটা তুলে নেওয়া হয়। শেষ ধাপে অস্থায়ী কর্মীদের একাংশের সঙ্গে যোগসাজস করে পরিদর্শনের সার্টিফিকেট এবং ফোটোশপ করা ছবি দফায় দফায় আপলোড করে বাকি টাকাটাও হাতিয়ে নেওয়া হয়।

দুর্নীতির অভিযোগ যে খুব মিথ্যা নয়, এ দিনই মনোহরপুর গ্রামে গিয়ে তা বোঝা গেল। গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, এই গ্রামেই প্রায় ১৫ জনের নামে ইন্দিরা আবাস প্রকল্পের দু’দফার টাকা বরাদ্দ হয়েছে। সে টাকা উঠেও গিয়েছে। অথচ সে কথা জানেনই না উপভোক্তা তালিকায় নাম থাকা ওই গ্রামের ফুলকলি হাজরা, মনিকা হাজরা, মিনতি হাজরা, বেবি হাজরা, রথিকা হাজরারা! তাঁদের ক্ষোভ, ‘‘আমাদের পাসবই, জবকার্ড বাপ্পার কাছে জমা রয়েছে। ১০০ দিনের প্রকল্পে যখন যেমন কাজ হয়, বাপ্পা-সহ তৃণমূলের কিছু ছেলে কিছু করে টাকা দিয়ে যায়। জানতেও পারিনি, আমাদের নামে বাড়ির অনুদান বরাদ্দ হয়েছে। পরে জানতে পেরে ব্যাঙ্কে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, সব টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। অথচ আমরা এখনও ভাঙাচোরা বাড়িতেই থাকছি।’’

কে এই বাপ্পা?

স্থানীয় বাসিন্দা তথা জেলা পরিষদের খাদ্য কর্মধ্যক্ষ জটিল মণ্ডলের ডান হাত বলেই পরিচিত সুরথ মণ্ডল ওরফে বাপ্পা। সম্প্রতি ১০০ দিনের প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগকে ঘিরে ষাটপলসা পঞ্চায়েত এলাকার গ্রামে গ্রামে বিক্ষোভ হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যন্ত্র দিয়ে কাজ করে মজুরদের কয়েক কোটি টাকা লুঠের অভিযোগ উঠেছিল বাপ্পার বিরুদ্ধে। বাপ্পার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তবে, তিনি কোনও রকম দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত নন বলেই দাবি জটিলের। ইন্দিরা আবাস যোজনার দুর্নীতি প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, ‘‘কারা এর সঙ্গে যুক্ত, তা প্রশাসন তদন্ত করে দেখলেই বোঝা যাবে।’’ সঠিক ভাবে পরিদর্শন করেই রিপোর্ট দিয়েছেন বলে দাবি করেছেন পঞ্চায়েতে বাড়ি পরিদর্শনের দায়িত্বে থাকা রয়েছেন মিঠু মণ্ডল ও সুমিতা মণ্ডল। তাঁদের প্রতিক্রিয়া, ‘‘কী করে কী হল, বলতে পারব না।’’ ষাটপলসার প্রধান নন্দদুলাল দাসের আবার বক্তব্য, ‘‘ব্লক প্রশাসনই এর দায়িত্বে। এখানে পঞ্চায়েতের কোনও ভূমিকাই নেই।’’

যেখান থেকে উপভোক্তাদের টাকা তোলা হয়েছে বলে অভিযোগ, সেই পশ্চিমবঙ্গ গ্রামীণ ব্যাঙ্কের ষাটপলশা শাখার ম্যানেজার বাবলু দত্ত জানিয়েছেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা না বলে কিছু বলা যাবে না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement