বাঘের-ঘর: আলো আঁধারি যে অরণ্যপথে ছিল বাঘের যাতায়াত, সেখানে আর তাদের খোঁজ মেলে না। ছবি: সন্দীপ পাল
সদ্য চাকরিতে যোগ দিয়ে জলদাপাড়ার দায়িত্ব পেয়েছেন তরুণ বনকর্তা। জঙ্গল চিনতে এ-প্রান্ত ও-প্রান্ত চষে বেড়াচ্ছেন। এমনই এক বিকেলে ওয়াচ টাওয়ার থেকে তার দেখা পেলেন তিনি! হলুদ-কালো ডোরাকাটা চেহারা নিয়ে হেলতে দুলতে ঘাস বন পেরিয়ে গভীর জঙ্গলে সেঁধিয়ে যাচ্ছেন।
তিনি উত্তরবঙ্গের ‘দক্ষিণরায়’! প্রায় তিন দশক আগে গোধূলির আলোয় দেখা সেই দৃশ্য আজও ভুলতে পারেননি ওই বনকর্তা। বছর দুয়েকের মধ্যে তিন-তিন বার ওই জঙ্গলে বাঘ দেখেছিলেন তিনি। উত্তরবঙ্গের মানুষ জানেন, এক সময়ে গরুমারা, জলদাপা়ড়া, বক্সায় বাঘের দেখা মিলত। বন দফতরের খাতাতেও এক সময় গরুমারা, জলদাপাড়ায় বাঘের অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু এখন সে সব নেহাতই গল্প হয়ে উঠেছে।
উত্তরবঙ্গে বাঘের ঠিকানা বলতে সবেধন নীলমণি বক্সা। কিন্তু সেখানেও বাঘ আছে কি না, তা নিয়ে ঘোরতর সন্দেহ বন দফতরের অন্দরেই। গত বছর নেওড়াভ্যালিতে বাঘের দেখা মিলেছিল। উত্তরবঙ্গ জুড়ে বাঘেদের হা-হুতাশের মাঝে সেটা কিছু়টা পাওনা।
কেন উত্তরবঙ্গের একের পর এক জঙ্গল থেকে হারিয়ে গেল বাঘেরা?
পরিবেশবিদদের অনেকেই এর পিছনে চোরাশিকারকে যেমন দায়ী করছেন, তেমনই দায়ী করছেন দূষণকে। শুধু শিকারির হানা নয়, লাগাতার দূষণেও অতিষ্ঠ হয়ে উত্তরবঙ্গের বাঘেরা ঠাঁইনাড়া হয়েছে বলে মনে করছেন তাঁরা। বনকর্তাদের একাংশের মতে, উত্তরবঙ্গে সামগ্রিক ভাবে অরণ্য নষ্ট হয়েছে। বাঘ স্পর্শকাতর প্রাণী। ফলে তার বাসস্থান নষ্ট হওয়ায় জঙ্গল থেকে ধীরে ধীরে সরে গিয়েছে। উত্তরবঙ্গের বাঘ নিয়ে এক ঘরোয়া আলোচনায় রাজ্যের অবসরপ্রাপ্ত বনকর্তা প্রণবেশ সান্যাল বলেছিলেন, ‘‘তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং পরিবেশ নষ্ট হওয়ার ফলে গরুমারার কিছু বাঘ নেওড়ার দিকে সরে গিয়েছিল বলে মনে করা হয়।’’
দর্শন: নেওড়াভ্যালিতে যে বাঘের দেখা মিলেছিল সম্প্রতি। নিজস্ব চিত্র
বক্সার ক্ষেত্রে অবসরপ্রাপ্ত বনকর্তাদের অনেকেই মনে করেন, পর্যটন এবং পরিবেশ নষ্ট হওয়ার ফলে খাদ্যাভাব ঘটেছে। ফলে বাঘেরা ওই এলাকা ছেড়ে লাগোয়া ভুটান এবং অসমে সরে গিয়েছে। ন্যাশনাল টাইগার কনজারভেশন অথরিটি সূত্রের খবর, অসমে কিন্তু বাঘের সংখ্যা বেড়েছে।
কোথায় কত
• গরুমারা (১৯৮৯) - ৮টি বাঘ
জলদাপাড়া (১৯৯২)- ৫টি বাঘ
বক্সা (২০১০)- ১৫টি বাঘ
(সূত্র: রাজ্য বন দফতর)
উত্তরবঙ্গ:
২০০৬ সালে: ৮-১২টি
২০১০ সালে: গণনা হয়নি
(সূত্র: ন্যাশনাল টাইগার কনজারভেশন অথরিটি)
বক্সায় বাঘ নেই এ কথা অবশ্য সরকারি ভাবে মানতে নারাজ বন দফতর। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে বক্সায় বাঘ দেখার কোনও নজির নেই। বাঘসুমারির কোনও সাম্প্রতিক তথ্যও বক্সার ক্ষেত্রে বেরোয়নি। আমজনতার অনেকেরই প্রশ্ন, বক্সায় যে ভাবে গরু চরে বে়ড়ায় তাতে বাঘ থাকলে দু’-একটি শিকার তো করত! কিন্তু তেমন ঘটনা তো শোনা যায় না। বক্সা নিয়ে ঘনিষ্ঠ মহলে বন দফতরের এক পদস্থ কর্তার মন্তব্য, ‘‘বক্সায় বাঘ নেই তা আমিও জানি, আপনিও জানেন। কিন্তু টাইগার রিজার্ভ তকমা রয়ে গিয়েছে!’’ প্রসঙ্গত, পর্যটনের নামে বক্সায় যে ভাবে পরিবেশ নষ্ট করা হয়েছে তা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছে জাতীয় পরিবেশ আদালতও। পরিবেশকর্মীদের অভিযোগ, যে ভাবে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে বক্সার অন্দরে পর্যটনকেন্দ্র, লজ, রিসর্ট গড়ে তোলা হয়েছে তাতেই পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বেআইনি ভাবে তৈরি করার দায়ে বক্সার সরকারি এবং বেসরকারি বেআইনি লজ, রিসর্ট ভেঙে ফেলারও নির্দেশ দিয়েছে পরিবেশ আদালত।
উত্তরবঙ্গের পরিবেশপ্রেমী সংগঠন ‘ন্যাফ’-এর কর্তা অনিমেষ বসু বলছেন, গোটা উত্তরবঙ্গ এক সময় বাঘের তল্লাট ছিল। কিন্তু মানুষের উপদ্রবেই ওদের বেশির ভাগ ভূটানে পা়ড়ি দিয়েছে। ‘‘আগে ভূটানে তেমন বাঘ দেখা যেত না। এখন তো শুনি ১২ হাজার ফুটের উপরেও ভূটানে বাঘের দেখা মিলছে,’’ বলছেন তিনি। এই প্রবীণ পরিবেশকর্মীর মতে, জঙ্গলের ভিতরে এবং জঙ্গল লাগোয়া এলাকায় যে ভাবে মানুষের যাতায়াত বে়ড়েছে তাতেই বাঘেরা বিরক্ত হয়ে সরে গিয়েছে। বাঘ জঙ্গলের রাজা হলেও মানুষের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলে। ফলে চিতাবাঘ যে ভাবে মানুষের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে টিকে থাকছে, বাঘ সেটা করেনি।
পরিবেশের অবক্ষয়ে বাঘের বিপন্ন হওয়াটা অবশ্য শুধু উত্তরবঙ্গে নয়, গোটা বিশ্বেরই সমস্যা। সুন্দরবনের ক্ষেত্রেও একই সমস্যা প্রকট হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি লালগড়ে যে আগন্তুক বাঘটি হাজির হয়েছিল এবং শেষমেশ খুন হয়েছে তার পিছনেও কিন্তু এই পরিবেশের অবক্ষয়ের কারণকেই দায়ী করছেন বাঘ বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, সম্ভবত ওই বাঘটি ওডিশার সিমলিপাল অরণ্য থেকে এসেছিল। সেই রাজ্যের বন দফতরের একটি রিপোর্ট বলছে, সিমলিপালের উত্তর ভাগে বাঘের সংখ্যা কমছে। তার পিছনেও কিন্তু পরিবেশগত কারণকেই দায়ী করছেন বন্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, পরিবেশ নষ্ট হওয়ার ফলেই বহু দূর পথ পাড়ি দিয়ে বাঘটি এ রাজ্যে চলে এসেছিল। ঠিক এমন ভাবেই উত্তরবঙ্গের জঙ্গল থেকে বাঘেরা পাততাড়ি গুটিয়ে নিয়েছে।
বন্যপ্রাণপ্রেমীদের অনেকেরই আশঙ্কা, এই পথ পাড়ি দেওয়ার পথে অনেক বাঘ হয়তো চোরাশিকারিদের কবলেও পড়েছে। এমনিতেই ভূটান, অসম থেকে চোরাশিকারিদের যাতায়াত রয়েছে। একাধিকবার বন দফতরের হাতে ধরাও পড়েছে তারা।
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, এই পরিস্থিতির বদল ঘটবে কি না? বক্সার জঙ্গলে বাঘ রয়েছে কি না তা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান। ফলে ভবিষ্যতে বক্সার কপালে ‘টাইগার রিজার্ভ’ বা বাঘের জন্য সংরক্ষিত প্রকল্পের তকমাটুকুও থাকবে কি না, সে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
বন দফতরও যে এই পরিস্থিতি নিয়ে ওয়াকিবহাল তার ইঙ্গিত মিলেছে শীর্ষকর্তাদের মন্তব্যেও। সম্প্রতি বনমন্ত্রী বিনয়কৃষ্ণ বর্মণ ঘোষণা করেছেন, অসম থেকে হেলিকপ্টারে চাপিয়ে বাঘ উড়িয়ে আনবেন বক্সায়। লালগড়ে গিয়ে ঘোষণা করেছিলেন, ভিন রাজ্যের অতিথি ডোরাকাটাকে ধরতে পারলেই তাকে বক্সায় পুনর্বাসন দেবেন তিনি। যদিও তাঁর সেই ইচ্ছে অপূর্ণ রয়ে গিয়েছে। বন দফতরের কর্তাদের একাংশ বলছেন, বক্সার কপাল থেকে ‘টাইগার রিজার্ভ’ তকমা যাতে না মুছে যায় তার জন্যই চেষ্টা করছে রাজ্য সরকার। বন দফতরের দাবি, শুধু বক্সা নয়, জলদাপাড়া এবং গরুমারার জঙ্গলেও বাঘকে ফেরানো যায় কি না, সেটাও ভাবা হচ্ছে। বাঘবাবাজির দেখা পাওয়ার পরে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে নেওড়াভ্যালির জঙ্গলেরও। এক পদস্থ কর্তার কথায়, ‘‘নেওডাভ্যালির উঁচু এলাকা দুর্গম বলে তবু রক্ষে। তা-ও যাতে চোরাশিকারিরা না যায় তা নজর রাখা হচ্ছে।’’
কিন্তু আমজনতার অনেকেরই প্রশ্ন, এ সব করার আগে উত্তরবঙ্গের জঙ্গলের পরিবেশ বাঁচানো উচিত নয় কি?