—প্রতীকী ছবি।
এসডিপিও: ৫ লক্ষ ২০ হাজার টাকা।
সার্কল ইনস্পেক্টর (সিআই): ৫ লক্ষ ১০ হাজার টাকা।
স্থানীয় থানার ওসি: ৬ লক্ষ টাকা।
আদালতে ইডি-র তরফে দুর্নীতির ‘প্রমাণ’ হিসেবে জমা দেওয়া একটি ডায়েরির পাতায় লেখা রয়েছে এই তিনটি বাক্য। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাটির সূত্রে দাবি, এ আসলে কয়লা পাচারের পথ মসৃণ করতে পুলিশকে দেওয়া ‘প্রোটেকশন মানি’ বা ‘ভেট’-এর সামান্য ভগ্নাংশ মাত্র। ইডি সূত্রের দাবি, ২০১৯ সালের ৭ ডিসেম্বরে তা দেওয়া হয়েছে এক এসডিপিও, সিআই এবং এক স্থানীয় থানার ওসি-কে। অর্থাৎ, ওই এক দিনে মোট ১৬ লক্ষ ৩০ হাজার টাকা তুলে দেওয়া হয়েছে শুধু এই তিন পুলিশকর্তার হাতে। পদমর্যাদার বিচারে তাঁরা একেবারে উপরের দিকে, এমনটাও বলা চলে না।
কয়লা পাচার মসৃণ করতে বিভিন্ন জেলার পুলিশের একাংশকে এমন ‘ভেট’ দেওয়া হত বলে আগেও অভিযোগ করেছে ইডি। এ বার প্রাথমিক তদন্ত এবং বেশ কিছু অভিযুক্তের বয়ানের উপরে নির্ভর করে যে আনুমানিক হিসাব কষা হয়েছে, তার ভিত্তিতে ইডি সূত্রের দাবি, ‘নিচুতলার’ পুলিশকর্মীদের একাংশের সঙ্গে পাঁচ বছরে অভিযুক্তদের লেনদেনের অঙ্ক অন্তত ২০০ কোটি টাকা!
ইডি-র এক তদন্তকারী অফিসারের কথায়, “জেলার মহকুমা ও থানায় প্রতি মাসে নিচুতলার পুলিশকর্মীদের একাংশকে ‘প্রোটেকশন মানি’ দেওয়া হত। ওই টাকা দিয়ে নিশ্চিত করা হত যাতে কারও গায়ে হাত না পড়ে।” যে সব জেলা জুড়ে কয়লা পাচার হত, ২০১৯ সালে তেমনই একটি জেলার কয়লা পাচার অঞ্চলের মহকুমা পুলিশের ‘ছোট কর্তাদের’ একাংশের জন্য ‘মাসিক ভেটের’ একটি হিসাব জানিয়েছেন ওই তদন্তকারী অফিসার। ডায়েরির পাতায় ১৬ লক্ষ ৩০ হাজার টাকার হিসাব সেই সূত্রেই।
তদন্তকারীদের সূত্রে দাবি, তাঁদের প্রাথমিক অনুমান অনুয়ায়ী, ২০১৫ সাল থেকে ২০২০ পর্যন্ত পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম এবং দুর্গাপুর-আসানসোল এলাকায় ৫০টিরও বেশি থানায় ‘ছোট-মাঝারি’ পদের পুলিশকর্তাদের একাংশকে প্রতি মাসে লক্ষ-লক্ষ টাকার ‘ভেট’ দেওয়া হত। পাঁচ বছরে এ ভাবে অন্তত ২০০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে বলে ইডি কর্তাদের সূত্রে দাবি। তদন্তকারীদের সূত্রে ব্যাখ্যা, প্রতি থানায় গড়ে মাসে ৭-৮ লক্ষ টাকা দেওয়া হত বলে প্রাথমিক ভাবে তথ্য মিলেছে। অর্থাৎ, ৫০টি থানায় মাসে প্রায় ৪ কোটি টাকা। বছরে ৪৮-৫০ কোটি। পাঁচ বছরের মোট অঙ্ক ২০০ কোটিরও বেশি।
এক তদন্তকারী অফিসারের কথায়, “দুর্গাপুর-আসানসোল এলাকায় এমন অনেক থানাও রয়েছে, যেখানে ওই টাকার অঙ্ক অনেক বেশি ছিল বলে তদন্তে উঠে এসেছে। ফলে প্রাথমিক ভাবে মোট ‘ভেট’ অন্তত ২০০ কোটি টাকা মনে করা হলেও, আদতে মোট টাকার পরিমাণ আরও অনেকটাই বেশি হতে পারে।’’
তদন্তকারীদের সূত্রে দাবি, কয়লা পাচার মামলায় কলকাতা ছাড়াও পুরুলিয়া, আসানসোল, দুর্গাপুর এলাকার বেশ কয়েক জন অভিযুক্তের বাড়িতে ও অফিসে তল্লাশি চালানো হয় এবং তাতে পাওয়া গিয়েছে প্রচুর নথি। এ ছাড়া, পাচারে মূল অভিযুক্ত অনুপ মাজি ওরফে লালা এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ কয়লা মাফিয়াদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। নিচুতলার পুলিশকর্মীদের একাংশকে কী ভাবে প্রতি মাসে টাকা দেওয়া হত, তার আঁচ তখনই পাওয়া গিয়েছিল বলেই ইডি সূত্রের দাবি।
ইডি সূত্রের অভিযোগ, ছোট-বড় পুলিশকর্তাদের কাছে যাতে নিয়ম করে টাকা পৌঁছে যায়, তার জন্য জেলাগুলির সংশ্লিষ্ট মহকুমার জন্য এক জন হিসাবরক্ষক ও এক জন গাড়িচালককে দায়িত্ব দিয়েছিলেন পাচারকারীরা। প্রতি মহকুমায় এমন এক জন করে হিসাবরক্ষক ও গাড়িচালক ছিলেন। তাঁদের কাজ ছিল, প্রতি মাসে নিয়ম করে নির্দিষ্ট দিনে বিভিন্ন পুলিশকর্তা ও অন্যান্য অফিসারের কাছে টাকা পৌঁছে দেওয়া। টাকা পৌঁছে দেওয়ার পরে সেই সংক্রান্ত সমস্ত নথি কয়লা পাচারের মূল অভিযুক্তদের কাছে পাঠিয়ে দিতেন হিসাবরক্ষক ও গাড়িচালকেরা। এই সমস্ত তথ্য কয়লা পাচারের সঙ্গে জড়িতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গিয়েছে বলেই ইডি সূত্রের দাবি।
তদন্তকারীদের সূত্রে দাবি, হিসাবরক্ষক ও গাড়িচালকদের পাঠানো ওই সব নথি অনুযায়ী, পুলিশকর্তা এবং নিচুতলার পুলিশকর্মীদের কত টাকা করে দেওয়া হচ্ছে, তা নির্দিষ্ট নামে বা পরিচয়ে এক-একটি ডায়েরিতে নথিবদ্ধ করে রাখতেন পাচারকারীরা। তল্লাশিতে এমন বেশ কিছু ডায়েরি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে বলেও তদন্তকারীদের সূত্রে দাবি। ওই সব ডায়েরি থেকে পাওয়া নথির ভিত্তিতে একাধিক গাড়িচালক ও হিসাবরক্ষকের বয়ান ইতিমধ্যে নথিবদ্ধ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ইডি কর্তারা। যার ভিত্তিতে কয়লা পাচার অঞ্চলে কাজ করেছেন, এমন একাধিক পুলিশ অফিসার ও বিভিন্ন থানার ওসি-আইসিকে তলব করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে বলে ইডি সূত্রের খবর।
তদন্তকারীদের সূত্রে দাবি, ওই সব অফিসারদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের লেনদেন, সম্পত্তির নথি জমা নেওয়া হয়েছে। তাঁদের আত্মীয়-পরিজনদের নথি, সম্পত্তি এবং আয়-ব্যয়ের হিসাব খতিয়ে দেখার প্রস্তুতিও শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন এক তদন্তকারী অফিসার। আগামী দিনে ফের ওই সব পুলিশকর্তা ও অফিসারদের তলব করা হতে পারে বলেও ইডি সূত্রের খবর।