দুমড়েমুচড়ে: দুর্ঘটনার পরে দেবশ্রী চট্টোপাধ্যায়ের (ডান দিকে) গাড়ির অবস্থা। ছবি: তাপস ঘোষ
‘নিয়মবিরুদ্ধ’ ভাবে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাকের জন্য দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনার বিরাম নেই। এ বার একই কারণে বালুরঘাট থেকে বেহালার পর্ণশ্রীতে বাড়ি ফেরার পথে মৃত্যু হল কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার দেবশ্রী চট্টোপাধ্যায়ের (৫৫)। মারা গিয়েছেন তাঁর গাড়ির চালক মনোজ সাহা (৪৯) এবং দেহরক্ষী তাপস বর্মণও (২৯)।
শুক্রবার ভোরে হুগলির দাদপুরে ওই সড়কের বাঁ ধারে দাঁডিয়ে থাকা একটি বালিবোঝাই ট্রাকের পিছনে ধাক্কা মারে দেবশ্রীর গাড়ি। তিন জনকেই চুঁচুড়া ইমামবাড়া হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও বাঁচানো যায়নি।
এই দুর্ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এক শোকবার্তায় তিনি জানিয়েছেন, দক্ষ এই পুলিশ আধিকারিক পরিশ্রম ও নিষ্ঠার গুণে ডেপুটি কমিশনার পর্যায়ে উন্নীত হন। রাজ্য পুলিশেও তিনি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। মানবপাচার রোধে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য তিনি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান। দেবশ্রীর পরিবার-পরিজন ও অনুরাগীদের আন্তরিক সমবেদনাও জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
দেবশ্রী ছিলেন কলকাতা পুলিশের প্রথম মহিলা ওসি। প্রথমে হেয়ার স্ট্রিট থানার অতিরিক্ত ওসি, তার পরে নর্থ পোর্ট এবং তারাতলা থানার ওসি হয়েছিলেন। বহু বছর আগে ইকবালপুর থানায় কর্মরত থাকাকালীন গোষ্ঠী সংঘর্ষ রোধে সক্রিয় ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল তাঁকে। বর্তমানে জলপাইগুড়ির ডাবগ্রামে রাজ্য সশস্ত্র পুলিশের ১২ নম্বর ব্যাটেলিয়নের কমান্ড্যান্ট পদে ছিলেন দেবশ্রী। ছিলেন পুলিশ রিক্রুটমেন্ট বোর্ডের মেম্বার-সেক্রেটারি।
২০১৬-র বিধানসভা ভোটের পরে তাঁকে কলকাতা থেকে রায়গঞ্জে রাজ্য পুলিশের চতুর্থ সশস্ত্র ব্যাটেলিয়নের কমান্ড্যান্ট অফিসার পদে পাঠানো হয়। তাঁর সহকর্মী এক পুলিশকর্তা বলেন, ‘‘জেলায় বদলির পরে দেবশ্রী বলতেন, আমার আর ফেরা হবে না। সত্যি, রাজ্য পুলিশ থেকে আর কলকাতা পুলিশে ফেরা হল না তাঁর।’’
পুলিশ সুত্রের খবর, দেবশ্রী শিলিগুড়ি থেকে ৮ সেপ্টেম্বর রওনা হয়ে পর দিন সকালে বালুরঘাটে ঢোকেন। বালুরঘাটে মৌখিক পরীক্ষা ছিল। সেখানে সার্কিট হাউসে ছিলেন তিনি। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পরে বালুরঘাট থেকে গাড়িতে কলকাতা রওনা হন।
দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, দেবশ্রীর গাড়ির গতি অত্যন্ত বেশি ছিল। সামনের সিটে বসেছিলেন তাঁর দেহরক্ষী। মাঝের সিটে দেবশ্রী। হুগলি জেলা (গ্রামীণ) পুলিশ সুপার তথাগত বসু বলেন, ‘‘মনে হচ্ছে, ক্লান্তিতে দেবশ্রীর গাড়ির চালকের ঘুম এসে গিয়েছিল। শেষ মুহূর্তে আর তিনি গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি।’’
বেশ কয়েক বছর আগে এই সড়কেই দুর্ঘটনায় গুরুতর জখম হয়েছিলেন তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তার পরে দুর্ঘটনায় মারা যান সঙ্গীতশিল্পী কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্যও। গত মাসেই চণ্ডীতলার কাপাসহাড়িয়ায় একই রকম দুর্ঘটনায় প্রাণ গিয়েছিল মা-ছেলের। তার আগে ফেব্রুয়ারিতে সিঙ্গুরের কোলেপাড়ার কাছে দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন এক প্রৌঢ়। এমন উদাহরণ আরও রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, দ্রুত গতির ওই রাস্তার ধারে ‘বেআইনি’ ভাবে ট্রাক রাখার প্রবণতা বন্ধ না-হলে দুর্ঘটনা থামবে না।
দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প অধিকর্তা স্বপনকুমার মল্লিক বলেন, ‘‘রাস্তার ধারে ট্রাক দাঁড় করিয়ে রাখার কথা নয়। আমরা পুলিশের সঙ্গে পথ নিরাপত্তা নিয়ে সমন্বয় বৈঠকে এ কথা বলি। তবে সমস্যা কিছু আছে। আমরা ১৯টি লে-বাই (ট্রাক দাঁড়ানোর জায়গা) তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’’ জেলা পুলিশের দাবি, যে ট্রাকটির পিছনে দেবশ্রীর গাড়ি ধাক্কা মারে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সেটির চাকা ফেটে যায়।
বালি বোঝাই থাকায় পুলিশ নড়াতে পারেনি। তবে, ট্রাকটির জন্য রাস্তায় কোনও ‘বিপদ সঙ্কেত’ কেন ছিল না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই। তাঁরা মনে করছেন, এটা পুলিশের গাফিলতি।
দেবশ্রীর গাড়ির চালক মনোজের বাড়ি মালদহের হরিশ্চন্দ্রপুরে। দেহরক্ষী তাপস কোচবিহারের ফুলবাড়ি এলাকার বাসিন্দা ছিলেন। এ দিন তিনটি দেহই চুঁচুড়া পুলিশ লাইনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে রাজ্য পুলিশের তরফে ‘গান স্যালুট’ দেওয়া হয়। উপস্থিত ছিলেন কলকাতা ও রাজ্য পুলিশের পদস্থ কর্তারা। এসেছিলেন ডিজি বীরেন্দ্রও। দেবশ্রীর স্বামী, প্রাক্তন পুলিশকর্তা সলিল রায় ছেলে অধীপকে নিয়ে চুঁচুড়া থানা যান।